শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের নিজের হাতে লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র অষ্টম পরিচ্ছেদের কথায় ছিলাম ৷ আমরা এর আগে দেখেছি গুরুমহারাজ বহিরঙ্গা, অন্তরঙ্গা ও তটস্থা শক্তি অথবা যথাক্রমে মায়াশক্তি, চিৎশক্তি ও জীবশক্তি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন ৷ তাছাড়া কিভাবে জীব (মানুষ) বহিরঙ্গা মায়াশক্তির বন্ধন মুক্ত হয়ে অন্তরঙ্গা বা চিৎশক্তির রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে – সে সম্বন্ধেও আমাদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছেন ৷ এখন আমরা দেখবো এরপরে গুরুমহারাজ নিজেই জিজ্ঞাসা তুলে সেই জিজ্ঞাসার কি উত্তর দিয়েছেন !
এরপরে গুরুমহারাজ জিজ্ঞাসার আকারে শিষ্যের মাধ্যমে জানতে চেয়েছেন – ” মানব তথা জীব আনন্দস্বরূপ হয়েও ওই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে ‘অভাব’ স্থিতিতে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে – তাহলে কিভাবে সে ওই অবস্থা থেকে উত্তরিত হয়ে ‘স্বভাব’ স্থিতিতে আসবে এবং আপন মাধুর্য্যরস আস্বাদন করতে পারবে ?’
এর উত্তরে গুরুমহারাজ আবার বলতে শুরু করলেন – ” প্রিয় আত্মন্ ! আমি ওই বিষয়ে সম্পর্কে আরো কিছু আলোচনা করছি, তুমি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হয়ে তা শ্রবন করো ৷
মাধুর্য্যরস আস্বাদন করবার আকাঙ্ক্ষা সংসারের প্রতিটি জীবের ৷ সেই জীবগণের ভেতর আবার অতি শ্রেষ্ঠ জীব মানব, কারণ ভগবৎতত্ত্ব বোধে বোধের জন্য একমাত্র তারাই উপযুক্ত ৷ কারণ তারা উত্তম অঙ্গপ্রাপ্ত হয়েছে। সেইহেতু সংসারে প্রতিটি মানব জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে চাচ্ছে ওই রসের আস্বাদন ৷ কিন্ত আস্বাদন করার সামর্থ্য জীবের নাই ৷ সেইহেতু আস্বাদন করতে গিয়ে জীবের যৌবন পড়ে যায় ৷ জীবন খসে পড়ে ৷ তবুও রসাস্বাদন হয় না ৷ তার কারণ জীব (মানব) ‘সচল’ বিন্দুকে ‘অটল’ করে প্রকৃতি-সঙ্গে সেই অটলতা রক্ষা করতে পারে না ৷ সেই কারণেই তার রসাস্বাদনের পূর্ণতা নাই ৷ পূর্ণতার অভাবে মানব তৃপ্তি-অতৃপ্তির বেগ নিয়ে অপূর্ণতাবশতঃ হাহাকার করে – কষ্ট পায় ৷ এটাই অসহজতা ৷ স্বভাব-বিকৃতির কারণও এটা ৷ সংসারে যাবতীয় দুর্ঘটনার মূলে এই বিকৃতি ৷৷
আর এই স্বভাব-বিকৃতি হেতু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দ্বন্দ্ব, পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক সংঘর্ষ এবং রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় ৷ মানব জীবনের বিপর্যয়ের মূলেও এই স্বভাব-বিকৃতি ৷ স্বভাব বিকৃতিই মানবকে করে দানব, সে পরিবারের অন্য সকলের অশান্তির কারণ হয়ে পড়ে, সামাজিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় আর পৃথিবীতে অধিক অশান্তি উৎপন্ন হয় ৷৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এখানে যে জিজ্ঞাসার উত্তর গুরুমহারাজ দিচ্ছিলেন সেটা হোলো যে, মানুষ (জীব) স্বয়ং আনন্দস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও তার সেই পরম আনন্দের বা স্বরূপ-আনন্দের taste নাই কেন ? আর কি করলে মানুষ সেই মাধুর্য্যরস আস্বাদনে সক্ষম হবে ? এই জিজ্ঞাসার উত্তরে গুরুমহারাজ যে কথা বললেন, তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় লক্ষ্য করার মতো আর তা হোলো – মানুষসহ সংসারে প্রতিটি জীবের ওই মাধুর্য্যরস আস্বাদন করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে ৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ায় এবং মানব শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সর্বাপেক্ষা উন্নত হওয়ায় (কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করে ষটচক্র এবং সহস্রারে পৌঁছানো একমাত্র মানবদেহেই সম্ভব ৷ তাছাড়া পঞ্চকোষের অর্থাৎ অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় কোষের ক্রিয়াশীলতাও মানবদেহেই পরিপূর্ণতা পায় ৷) মানবশরীরই ভগবৎতত্ত্ব বোধে বোধ করার জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ৷ কিন্তু সমগ্র জীবের ন্যায় আমরা মানবেরা (পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার সুবাদে)-ও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মাধুর্য্যরস আস্বাদন করতে চাইছি, কিন্তু সাধনা না থাকায় আমাদের সেই সামর্থ্য লাভ হচ্ছে না ৷
মানব রসসাধনার দ্বারা শরীরস্থ বিন্দুকে অটল করতে পারে এবং শিবাবস্থা লাভ করতে পারে (গুরুমহারাজ আগেই বলেছিলেন – ” বিন্দু টললে জীব, অটলে শিব ৷”) ৷ কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা বিন্দুকে অটল করতে পারি না – অথচ প্রকৃতি-সঙ্গের দ্বারা মাধুর্য্য রস আস্বাদন করতে গিয়ে যৌবন পুড়িয়ে ফেলি ৷ পূর্ণতার অভাবে আমরা মনোজগতে তৃপ্তি এবং অতৃপ্তির বেগ নিয়ে হাহাকার করি, কষ্ট পাই ৷ এই কারণেই আমরা অসহজ হয়ে পড়েছি, আমাদের স্বভাব বিকৃত হয়ে গেছে ৷
গুরুমহারাজ বলেছেন যে, এই যে মানবের স্বভাব বিকৃতি – এর জন্যেই ব্যক্তি ব্যক্তিতে দ্বন্দ্ব হয়, পারিবারিক অশান্তি হয়, এমনকি সামাজিক সংঘর্ষ এবং রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের জন্যও দায়ী ঐ মানবের অসহজতা এবং স্বভাবের বিকৃতি ৷ স্বভাব-বিকৃতি হেতুই মানব দানবে পরিণত হয় ৷ সমস্ত রকমের রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় এবং পৃথিবীর যাবতীয় অশান্তি ঘটায় ঐরূপ অসহজ, স্বভাব-বিকৃত মানবেরাই ৷
এইজন্যেই অন্যত্র গুরুমহারাজ বারবার আমাদের কে মনে পাড়াতেন যে, “এই পৃথিবী গ্রহটি যেন কয়েকশো কোটি বছরের শিশু ! সুতরাং এই পৃথিবীগ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষেরও চেতনাও খুবই নিচু অবস্থায় রয়েছে ৷
গুরুমহারাজ খুব দুঃখ করে একবার বলেছিলেন – “এই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের সাথে Communication করার সময় আমাকে খুবই নিচু হয়ে দেখতে হয় ৷”