শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র অষ্টম পরিচ্ছেদের শেষভাগের কথায় ৷ আমরা আগে দেখেছি যে, গুরুমহারাজ নিজেই একটা জিজ্ঞাসা তুলে নিজেই তার উপর উত্তর দিচ্ছিলেন ৷ মানুষ স্বয়ং আনন্দস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও সে পরমানন্দের স্বাদ, অপার্থিব মাধুর্য্যরসের আস্বাদন পায় না কেন – এটাই ছিল জিজ্ঞাসা, আর গুরুমহারাজ এরই উত্তর দিচ্ছিলেন ৷ এখন আমরা দেখবো গুরুমহারাজ এরপরে আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” অসহজতা হোতে সহজতায় উত্তরণই হোলো জীবনের কলা ৷ মানব যখন সহজতাকে আশ্রয় করে, তখন সমস্ত বিকৃতির সূচনা বা সূত্রপাতের অভাবহেতু সে সহজ সাবলীল ধারাতে, স্বতঃস্ফূর্ত জীবনে উপস্থিত হয় – এক অপূর্ব রূপান্তর ঘটে থাকে – এই হোলো স্বভাবের জাগরণ ৷ তারপর নিদ্রিত সুপ্ত মহাভাব ওই স্বভাব হোতেই জাগ্রত হয়ে ওঠে আর এই রূপান্তর নিয়ে আসে জীবনে অদ্ভুত পরিবর্তন। মানব হয়ে ওঠে মহামানব ৷
যেমন কয়লা রূপান্তরিত হয়ে হীরাতে পরিণত হয়, সেইরূপ অসহজ বিকৃত স্বভাববিশিষ্ট পশুমানব রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হ’ন মহাভাবময় দিব্য প্রেমাপ্লুত মহামানবে ৷ ওই মহামানবগণই পৃথিবীর জীবনস্বরূপ ৷ এঁরাই সর্বজীবের আদর্শ এবং এঁদের স্থিতিলাভই (মানবের) উদ্দেশ্য ৷ এঁদের আবির্ভাবে পৃথিবীর জীবনীশক্তি বর্ধিত হয় – মানুষ প্রকৃত জীবনের তাৎপর্য এবং উদ্দেশ্য খুঁজে পায়।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ একবার অন্যত্র বলেছিলেন – “আধ্যাত্মিকতা হোলো জীবনের কলা বা বাঁচার কলা ৷” উনি এই কথা ইউরোপীয় ভক্তদেরকে বলেছিলেন – ” spirituality is nothing but the art of life and art of living !” আবার এখানে উনি বললেন – ” অসহজতা হোতে সহজতায় উত্তরণই জীবনের কলা ৷” তাহলে এটাও বোঝা গেল যে, অসহজ মানব (অর্থাৎ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ)-এর সাধনার সহায়তায় সহজ মানবে পরিণত হওয়াটাই আধ্যাত্মিকতা বা art of life !
এর পরের লাইনটা গুরুমহারাজ Complex sentence -এ পরিবেশন করেছেন, তাই একবার পড়লে ঠিক ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না ! সুতরাং আমরা ঐ sentence-টাকে একটু ভেঙ্গে ভেঙ্গে বোঝার চেষ্টা করি ! উনি একটা কথা বলেছেন – ‘মানব যখন সহজতাকে আশ্রয় করে’, কিন্তু এই সহজতাকে আশ্রয় করার ব্যাপারটা_ একমাত্র গুরুকৃপায় হয়, মানুষ কখনোই গুরুর সান্নিধ্য বা সাহায্য ছাড়া তার স্বভাবের উত্তরণ ঘটাতে পারে না ৷ তবে এখানে ‘গুরু’ বলতে প্রাথমিকভাবে পিতা-মাতা-শিক্ষাগুরু বা অন্য কোনো আদর্শ মানব হোতে পারে ! এমনকি সদগ্রন্থ পাঠেও মানবের জীবনের একভাবে চলতে থাকা অসহজ ছন্দ – সহজ ছন্দের দিকে turn নিতে পারে, কারণ মহাপুরুষদের রচিত গ্রন্থ বা যেকোনো সদগ্রন্থ বা আধ্যাত্মিক গ্রন্থে আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পুটিত করা থাকে। এরফলেই সদগ্রন্থ পাঠে মানবের উপকার হয়ে থাকে।
যাইহোক, আমরা এরপর গুরুমহারাজের অন্যান্য কথায় যাবো ৷ গুরুমহারাজ বলেছেন – ” সহজতাকে আশ্রয় করলেই মানবের সংস্কারে থাকা সমস্ত প্রকার বিকৃতির সূচনা-ই বন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ বিকৃতির অভাব ঘটতে থাকে। এরফলে মানব স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের সহজ-সাবলীল ধারায় ফিরে আসে। ফলে মানবজীবনে খুব দ্রুত রূপান্তর ঘটতে থাকে – মানবের স্বভাবের জাগরণ ঘটে (‘অভাব’ থেকে ‘স্বভাবে’ উত্তরণ) ৷ মানবের অন্তর্জগতে যে ‘মহাভাব’ এতদিন সুপ্ত অবস্থায় ছিল, মানবের স্বভাবে এর জাগরণের সাথে সাথে তা জাগ্রত হয়ে ওঠে ৷ মানব জীবনের এ এক অদ্ভুত পরিবর্তন ! এই মহাভাব জাগ্রত হোলেই ‘মানব’ – মহামানবে পরিণত হয়।
গুরুমহারাজ উদাহরণ সহযোগে বুঝিয়েছেন যে, কলুষযুক্ত কালো সহজলভ্য কয়লা যেমন কলুষমুক্ত উজ্জ্বল মূল্যবান হীরকে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি অসহজ বিকৃত স্বভাববিশিষ্ট পশুমানব – মহাভাবময় দিব্য প্রেমাপ্লুত মহামানবের রূপান্তরিত হয়ে যান।
কি সব কথা ! কি সাংঘাতিক প্রেরণামূলক কথা !! এই ধরনের কথা শুনলে যে কোনো মানুষ তো আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশ করতে চাইবেই – তাই না ?গুরুমহারাজ বলেছেন ওই ধরনের মহামানবরাই ‘পৃথিবী গ্রহের জীবনস্বরূপ’! উনি আরো বলেছেন – ‘এঁরা সর্বজীবের আদর্শ এবং ওঁরা যে স্থিতি লাভ করেছেন, সেই স্থিতিতে পৌঁছানোই মানব জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ! এই ধরনের মহামানব পৃথিবীতে অবতীর্ণ হ’ন বা তাঁদের উত্তরণ হয় যখন, তখন পৃথিবীগ্রহের জীবনীশক্তি বর্ধিত হয় – এঁদেরকে দেখেই সাধারণ মানুষ জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য এবং উদ্দেশ্য খুঁজে পায়।
এতোদূর পর্যন্ত শোনার পর আমরা এবার দেখবো গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে পরিশেষে কি বলেছেন ৷ এরপরে উনি আমাদেরকে বোঝানোর জন্য বলেছেন – ” এখন বুঝলে তো যে, বিকৃত বিফল স্বভাবকে সহজতা অবলম্বন করে বিকৃতিহীন ‘সহজ স্বভাবে’ পরিণত করতে হবে। আর ওই স্বভাবেই জাগ্রত হবে ‘মহাভাব’ যা আনয়ন করবে মানবে রূপান্তর – সমাজে রূপান্তর ও জগতে রূপান্তর !”
[অষ্টম পরিচ্ছেদ সমাপ্ত]