গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ, স্থূল শরীরে এসে কিছু দিনের জন্য এই মর্ত্ত্যধামে লীলা করে গেলেন ৷ তিনি বহু মানুষের সাথে বহুরকম সম্পর্কস্থাপন করলেন- মিশলেন , তাদেরকে নিয়ে কিছুটা পথও চললেন – কিন্তু দেখা গেল পরে তিনি যখন ‘বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন’ – প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের হাতে মিশনের সমস্ত ভার সঁপে দিলেন , দায়িত্ব দিলেন তাদের — তাঁর আরব্ধ কাজ চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য! কিন্তু একটা কথা বলে গেলেন – “এবার আমার আশ্রম, এই কয়েকটা মিশনের শাখা-ই নয় , এবার শত শত গৃহস্থাশ্রমও আমার আশ্রম হিসাবে কাজ করবে ৷”
দায়িত্ব বেড়ে গেল গৃহস্থীদেরও ! এখানে আমরা আলোচনা করছিলাম যে , ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তার আরব্ধ কাজের ভার শুধুমাত্র সন্ন্যাসীদের উপর দিয়েছিলেন ৷ প্রায় ১০০ বছর বা তার একটু বেশী সময় পরে স্বামী পরমানন্দ বললেন “সন্ন্যাসী ও গৃহী”– উভয়েই তাঁর কাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে ৷ আর আমরা যদি ৫০০ বছর পিছেয়ে যাই , তাহলে দেখবো – সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আবাল্য ব্রহ্মচারী , চিরকুমার, সন্ন্যাসী, অবধূত নিত্যানন্দকে যখন তাঁর আরব্ধ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার ভার দিচ্ছেন , তখন তাকে প্রথমেই বলছেন , ” যাও ! তুমি বাংলায় ফিরে গিয়ে প্রথমে বিবাহ কর ! তারপর সঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে নেচে নেচে গান গেয়ে নাম প্রচার কর ৷”
কিন্তু ব্যাপারটা যাই হোক, গৃহীই হোক বা সন্ন্যাসীই হোক _ব্রহ্মচর্য্য চাইই চাই ! মেরুদন্ডের হাড় বরাবর ঘন কালচে লাল মজ্জার ঠাসা বুনন চাই ! গুরু মহারাজের আলোচনা থেকে জেনেছিলাম যে , ধ্যান করার সময় Perineum to Penial অর্থাৎ মূলাধার থেকে সহস্রার – এই দুটি মেরুর মধ্যে charging হয় ! সুষুম্নার মধ্যে মজ্জার বুনন যত ঘন , যত ঠাসা হবে , ততই charging ভালো হবে ! কুলকুন্ডলিনী চড়চড় করে উপরে উঠবে ! উঠবে কিন্তু সহসা নামবে না । সুষুম্নার মজ্জা যত ঘনত্ব হারাবে(ব্রহ্মচর্য‍্য হীনতার ফলে) ততই কুন্ডলিনী উপরে উঠলেও আবার ফরফর করে নেমে আসবে! এইজন্যই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গৃহী মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির খামতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন — জমিতে যদি ঘোগ (জমির আলে যদি ফুটো বা ফাঁক থাকে) থাকে , তাহলে সেই জমিতে জলসেচ করলেও তা স্থায়ী হয় না ৷ আবার বলেছিলেন — নোঙর না তুলে নৌকা বাইলে , দাঁড় টানলে কি নৌকা আগায় ?
সুতরাং মহাপ্রভুর নিত্যানন্দ-ই হোক আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী – ব্রহ্মচারী-রা হোক , অথবা গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের সন্ন্যাসী – ব্রহ্মচারী এবং গৃহীরাই হোক, ব্রহ্মচর্য্য Must ! আর ব্রহ্মচর্য্য বলতে গুরু মহারাজ অবশ্য শুধুমাত্র বীর্যধারণকেই বলেন নি , উনি Mainly যেটা বলেছিলেন সেটা হোল “সংযম” ! সবেতেই সংযম ! দেখা-শোনা , কথা বলা , চলা-ফেরা , আহার-নিদ্রা , বিহার-বিলাস – সবেতেই সংযম! সব দিক দিয়ে সংযত ব্যক্তিই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক ।
এইজন্যেই গুরু মহারাজ বলেছিলেন — ভারতীয় ধারায় বা সনাতন পরম্পরায় যে গুরুকুলের উল্লেখ রয়েছে , যে মন্ত্র সন্ন্যাসীরাও প্রতিদিন স্মরণ করেন বা পাঠ করেন ( ওঁ নারায়ণং , পদ্মভবং ……..”) এই পরম্পরায় অনেকে রয়েছেন সন্ন্যাসী , অনেকে রয়েছেন গৃহী বা সংসারী মানুষ যাদের স্ত্রী-পুত্র-সংসার ছিল ! কিন্তু অতি অবশ্যই তাঁরা ‘সংযমী’ ছিলেন । সুতরাং ব্রহ্মচর্য্যের প্রথম এবং প্রধান শর্ত “সংযম” ৷
গুরু মহারাজ আরও যেটা বলেছিলেন যে অন্নদান , বস্ত্রদান , শিক্ষাদান অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানদান (যেটা আগে বলা হয়েছিল) ! সেটাও উনি সিটিং-য়েই আলোচনা করেছিলেন ৷ তারপর উনি যে সমস্ত সাধু-ব্রহ্মচারীরা গ্রামে-গঞ্জে-শহরে মানুষের বাড়ী বাড়ী গিয়ে কাজ করেন (চরৈবেতি পত্রিকার কাজ , আশ্রমের Collection-এর কাজ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “তোরা তো কেউ ব্রহ্মজ্ঞানী নস্ _তবু তোদেরকে আশ্রমের কাজের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেতে হবে ! এতে তোদের গৃহী মানুষদের সাথে মেলামেশা করতে হবে, যেখানে সেখানে খাওয়া – যে কোন বিছানায় শোওয়া _এগুলি করতে হবে। সেখানে এই জগৎ সংসারের অন্যান্য প্রলোভনও তোদের আকর্ষণ করতে পারে। তাই তোদের আত্নরক্ষার একমাত্র অস্ত্র ‘সংযম’।
তোরা সবসময় মনে রাখবি_ব্রহ্মচর্য নেবার সময় তোরা সংযমী থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিস! ঈশ্বরের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত হবার সংকল্প গ্রহণ করেছিস-এটা বিস্মৃত হবি না! মনে রাখবি আগে কান্ডজ্ঞান(common sense) পরে ব্রহ্মজ্ঞান।ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসীর গৃহীসূলভ আচরন শোভনীয় নয় _তেমন করলে তুই-ই হাস্যাস্পদ হবি।
তাছাড়া তোদেরকে আরও একটা কথা বলছি _ধর তোরা কোন ভক্তের বাড়ীতে গেছিস, যে হয়তো আশ্রমের কাজে তোকে সাহায্য করে! সেখানে গিয়ে দেখলি যে, সেই ব্যক্তি সাংসারিক কোন কাজে একটু ফেঁসে গেছে _ব্যস্ত হয়ে পড়েছে _তখন তোরা বিরক্ত হবি না। তোর প্রয়োজনে তুই ঐ ব্যক্তির সাথে কাজে হাত লাগাবি_তাকে সহযোগিতা করবি! কাজটা হয়ে গেলে আনন্দের সঙ্গে তাকে নিয়ে তোর নিজের কাজে বেড়িয়ে পরবি!
যেখানে যাবি, সেখানে আমার কাছে যেসব কথা শুনেছিস সেইসব কথা আলোচনা করবি_তাতে ওরাও অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর পাবে। ছোটখাটো সমস্যা থাকলে মেটানোর চেষ্টা করবি। শারীরিক সমস্যা থাকলে ‘জীবনতত্ব’ _আসনগুলো করতে বলবি। আহার – বিহার change করলেই মানুষের অনেক শারীরিক সমস্যা দূর হয়ে যায়। আমি যেরকম বলছি _এইরকম ভাবে কাজ করলে আমি খুবই প্রসন্ন হব। “আমি সাধু” – “আমি ব্রহ্মচারী” এই sentiment রাখবি না _এসব থাকলে তোদের অগ্রগতি রুদ্ধ হবে। যে কোন পরিবারে গিয়ে বাড়ির Senior member – দের ‘মা’ বা ‘বাবা’ – বলে সম্বোধন করবি এবং মর্যাদা দিবি। কিন্তু সাবধান! যা একবার ছেড়ে এসেছিস _আবার তাতেই যেন ফাঁসিস না। কোনরকম ইন্দ্রিয়লিপ্সাকে যেন প্রশ্রয় দিবি না।
দ্যাখ্, সংসারী মানুষ যদি কোন ভুল করে তাদের মাফ আছে কিন্তু সাধু-সন্ন্যাসীদের এই ধরনের ভুলের কোন মাফ হয় না ! ব্রহ্মচারী অবস্থায় অর্থাৎ সাদা কাপড় পরা অবস্থায় কোন ভুল করে ফেললে মাফ হয় কিন্তু ‘গেরূয়া’ কাপড় পরার পর হয় না! ‘গেরূয়া’ – ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতীক, তাই কেউ ত্যাগ-বৈরাগ্যের ব্রত গ্রহণ করে যদি পুনরায় ভোগে ফাঁসে _তাহলে ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করে না! তার জন্য চরম শাস্তি অপেক্ষা করে! তাই তো বলা হয় _”সাধু সাবধান”।(ক্রমশঃ)