শ্রীশ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত ও লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র নবম পরিচ্ছেদের (সম্ভবতঃ এটাই শেষ পরিচ্ছেদ) কথায় ৷ এই অংশে গুরুমহারাজ আমাদেরকে বাউল দর্শন বোঝাতে গিয়ে বাউলের ‘বোল’ বা বাউলগান নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, ‘বাউলদের গান-ই হোলো বাউল দর্শন, বাউল সাধনার গুপ্ত সংকেত, বাউলদের জীবনের গীতি-আলেখ্য ৷ বাউলের মর্মকথা সংরক্ষিত থাকে ওই বাউলগানের মধ্যেই’ ৷৷
এবার আমরা দেখি গুরুমহারাজ “বাউলের মর্মকথা” সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন ৷ এরপরে তিনি বলেছেন – “প্রিয় আত্মন্ ! পাঁকাল মাছের মতো নির্লিপ্ত বাউলের সামাজিক অবস্থান ৷ বাউলের হাতের একতারাটি শুধু বাদ্যযন্ত্রই নয়, ওটা একাগ্রতার প্রতীক ৷ একতারার একটি তারের মতো বাউলের জীবনে একটি সুরই বাজে – সেই অধর – মনের মানুষকে ধরার সাধনা – যা অধরা মাধুরী ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এর আগে আমরা একবার শুনেছিলাম যে, বাউলের একতারা হোলো মানব শরীরের ইরা, পিঙ্গলা ও সুষুম্নার প্রতীক ৷ একতারার দুইপাশের দুটি উপর নিচে খাড়া অংশ ইরা ও পিঙ্গলার প্রতীক মধ্যিখানে একতারাটি সুষুম্নার প্রতীক ৷ সাধককে ওই সুষুম্নায় সুর তুলতে হবে – তবেই মনের মানুষের সুরে নিজের সুর মেলানো যাবে ৷ কিন্তু এখানে গুরুমহারাজ ‘বাউল’ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই বললেন যে, বাউলগণ সংসারে নির্লিপ্ত থাকে, পাঁকাল মাছের মতো থাকে ৷ দেখুন – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু গৃহী ভক্তদেরকে উদ্দেশ্য করে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন – “সংসারে থাকবে, কিন্তু পাঁকাল মাছের মতো ৷” দেখেছেন তো – বাউলগণই ঠিক ঠিক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অনুসারী ৷ আর আমাদের শুধু নাচা-কোদাই সার !
যাইহোক, এরপরেই গুরুমহারাজ বাউলদের একতারার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন – ‘একতারা হোলো একাগ্রতার প্রতীক’ ৷ একতারার যেমন একটিই তার – ঠিক তেমনি বাউলগণের একটাই লক্ষ্য – সেই অধর মানুষ, সেই মনের মানুষ অর্থাৎ যা অধরা-মাধুরী – তার অন্বেষণ, সেই এক লক্ষ্যে জীবনের জয়যাত্রা ৷
যাইহোক, এইবার আমরা দেখি গুরুমহারাজ এইসব সম্বন্ধে আরও কি কি বলেছেন ৷ এরপরে উনি বলেছেন – “বাউলদের মধ্যে নারীর স্থান খুব উঁচুতে এবং নারীর ভূমিকাও অপরিহার্য ৷ বাউলরা মনে করেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর সকলেই নারী বা প্রকৃতি ৷ বাউলের সাধনাও সেইহেতু নারীরূপে – প্রকৃতিভাবে ৷ বাউলরা নারীর প্রতীক হিসাবে লম্বা চুল চূড়া করে বাঁধে, কাছাহীন কাপড় পড়ে, হাতে ও গলায় গহনা পরে ৷ আর কাপড়ের গৈরিক রং বাউলের নিরাসক্তির প্রতীক ৷ বাউলের পরিধেয় কৌপীন রজ:স্বলা নারীর প্রতীক ৷ সেইহেতু বাউলদের ভিতর ‘কৌপীন’-কে বলা হয় রাধা, আর ‘ডোর’-কে বলা হয় কৃষ্ণ ৷ দুইজনাই দুইজনের পরিপূরক।”
প্রিয় পাঠক – শুনলেন তো কি সব অদ্ভুত কথা ! কতসব রহস্য উন্মোচিত করেছেন গুরুমহারাজ ! মানবসভ্যতার একটা অন্যতম শর্ত হোলো – সমাজে নারীর মর্যাদা, নারীর সম্মান, নারীর উচ্চস্থান ! কারণ ভারতীয় শাস্ত্রে রয়েছে যে, দুই পক্ষ নিয়েই যেমন পক্ষী সম্পূর্ণতা পায় এবং তার বেঁচে থাকা এবং বিকাশপ্রাপ্ত হওয়া, ঠিক তেমনি মানবসমাজের শরীরও পূর্ণতা পাবার জন্য, সম্যকরূপে বিকশিত হবার জন্য নারী ও পুরুষের সমানভাবে ভূমিকা থাকা প্রয়োজন ৷ অবশ্য এই যে কথাগুলি বলা হোচ্ছে, এটা বর্তমান সমাজব্যবস্থার নিরিখে ! প্রকৃতিতে দেখা যায় নারী ও পুরুষ উভয় উভয়েরই পরিপূরক হয়েই বর্তমান থাকে ৷ মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্বেও – শুধুমাত্র শরীরের শক্তিতে পুরুষ সামান্য এগিয়ে থাকার সুবাদে, তারা বহুকাল আগে থাকতেই নারীর উপর অকারণ অত্যাচার করেছে, তাদেরকে নানারকম শাসন ও বাঁধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে ! এটা একপ্রকার মানসিক বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
পুরুষমানুষ তার নিজের চেতনার উন্নতি করার কথা না ভেবে নারীদেরকে ঘরবন্দী, পোশাকবন্দী করতে চেয়ে উভয়কেই (নারী ও পুরুষ) আরো বেশি বিকৃতমনস্ক করে তুলেছে ৷ আমরা গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম যে, আদিম মানুষ এখনো যেসব অঞ্চলে বসবাস করে (আন্দামানের ওংগি-জারোয়া-সেন্টিনেলিজ , মধ্যপ্রদেশের বস্তার অঞ্চলের গোন্দ – আভুজ মারিয়া জনজাতি, আফ্রিকার পিগমী ইত্যাদি) অর্থাৎ যারা এখনো উলঙ্গ বা অর্ধউলঙ্গ হয়েই জীবন যাপন করে –কিন্তু তাদের মধ্যে কোন যৌনরোগ নাই ৷ তাহলেই ভাবুন – ঢাকা-ঢুকো দিয়ে নারীকে রেখে, বা ঘরের মধ্যে অসূর্যমস্পর্শ্যা করে বদ্ধ করে রাখার চেষ্টা তো কয়েক হাজার বছর ধরে চলছে – কিন্তু তার ফলটা কি ? এখনো তো নারীরা পুরুষদের দ্বারা শুধুমাত্র অত্যাচারিতই হয়ে চলেছে – নারীরা ঠিক সেইভাবে কি এখনো সমাজের কাছে মর্যাদা পেয়েছে ?
না — পায়নি ! তাইতো গুরুমহারাজ বাউলদের জীবনে নারীর সুউচ্চ স্থানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন ৷ বাউলগণের বিশেষ বিশেষত্ব এই যে, তাঁরা সমাজের অন্যান্য মানুষের ন্যায় নারী-পুরুষ ভেদ করেন না। তারা মানেন যে, একমাত্র পরমেশ্বরের রূপ শ্রীকৃষ্ণই পুরুষ, বাকি সবাই প্রকৃতি বা নারী ৷ তাই তাঁরা নিজেদেরকেও নারী ভাবে – নারীর ন্যায় চুল বাঁধে, পোশাক পরে, গহনা পরে – নারীভাব অবলম্বন করে জীবন কাটায় ৷ এটি বৈষ্ণবগণের রাধাভাবে সাধনার কথা মনে পাড়ায় ৷ পুরুষ হয়েও নারীবেশ ধারণ করে নিজেদেরকেও নারী ভাবা – এর থেকে নারীদেরকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদাদান আর কি-ই বা হোতে পারে !!
এবার আমরা দেখি গুরুমহারাজ “বাউলের মর্মকথা” সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন ৷ এরপরে তিনি বলেছেন – “প্রিয় আত্মন্ ! পাঁকাল মাছের মতো নির্লিপ্ত বাউলের সামাজিক অবস্থান ৷ বাউলের হাতের একতারাটি শুধু বাদ্যযন্ত্রই নয়, ওটা একাগ্রতার প্রতীক ৷ একতারার একটি তারের মতো বাউলের জীবনে একটি সুরই বাজে – সেই অধর – মনের মানুষকে ধরার সাধনা – যা অধরা মাধুরী ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এর আগে আমরা একবার শুনেছিলাম যে, বাউলের একতারা হোলো মানব শরীরের ইরা, পিঙ্গলা ও সুষুম্নার প্রতীক ৷ একতারার দুইপাশের দুটি উপর নিচে খাড়া অংশ ইরা ও পিঙ্গলার প্রতীক মধ্যিখানে একতারাটি সুষুম্নার প্রতীক ৷ সাধককে ওই সুষুম্নায় সুর তুলতে হবে – তবেই মনের মানুষের সুরে নিজের সুর মেলানো যাবে ৷ কিন্তু এখানে গুরুমহারাজ ‘বাউল’ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই বললেন যে, বাউলগণ সংসারে নির্লিপ্ত থাকে, পাঁকাল মাছের মতো থাকে ৷ দেখুন – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু গৃহী ভক্তদেরকে উদ্দেশ্য করে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন – “সংসারে থাকবে, কিন্তু পাঁকাল মাছের মতো ৷” দেখেছেন তো – বাউলগণই ঠিক ঠিক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অনুসারী ৷ আর আমাদের শুধু নাচা-কোদাই সার !
যাইহোক, এরপরেই গুরুমহারাজ বাউলদের একতারার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন – ‘একতারা হোলো একাগ্রতার প্রতীক’ ৷ একতারার যেমন একটিই তার – ঠিক তেমনি বাউলগণের একটাই লক্ষ্য – সেই অধর মানুষ, সেই মনের মানুষ অর্থাৎ যা অধরা-মাধুরী – তার অন্বেষণ, সেই এক লক্ষ্যে জীবনের জয়যাত্রা ৷
যাইহোক, এইবার আমরা দেখি গুরুমহারাজ এইসব সম্বন্ধে আরও কি কি বলেছেন ৷ এরপরে উনি বলেছেন – “বাউলদের মধ্যে নারীর স্থান খুব উঁচুতে এবং নারীর ভূমিকাও অপরিহার্য ৷ বাউলরা মনে করেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর সকলেই নারী বা প্রকৃতি ৷ বাউলের সাধনাও সেইহেতু নারীরূপে – প্রকৃতিভাবে ৷ বাউলরা নারীর প্রতীক হিসাবে লম্বা চুল চূড়া করে বাঁধে, কাছাহীন কাপড় পড়ে, হাতে ও গলায় গহনা পরে ৷ আর কাপড়ের গৈরিক রং বাউলের নিরাসক্তির প্রতীক ৷ বাউলের পরিধেয় কৌপীন রজ:স্বলা নারীর প্রতীক ৷ সেইহেতু বাউলদের ভিতর ‘কৌপীন’-কে বলা হয় রাধা, আর ‘ডোর’-কে বলা হয় কৃষ্ণ ৷ দুইজনাই দুইজনের পরিপূরক।”
প্রিয় পাঠক – শুনলেন তো কি সব অদ্ভুত কথা ! কতসব রহস্য উন্মোচিত করেছেন গুরুমহারাজ ! মানবসভ্যতার একটা অন্যতম শর্ত হোলো – সমাজে নারীর মর্যাদা, নারীর সম্মান, নারীর উচ্চস্থান ! কারণ ভারতীয় শাস্ত্রে রয়েছে যে, দুই পক্ষ নিয়েই যেমন পক্ষী সম্পূর্ণতা পায় এবং তার বেঁচে থাকা এবং বিকাশপ্রাপ্ত হওয়া, ঠিক তেমনি মানবসমাজের শরীরও পূর্ণতা পাবার জন্য, সম্যকরূপে বিকশিত হবার জন্য নারী ও পুরুষের সমানভাবে ভূমিকা থাকা প্রয়োজন ৷ অবশ্য এই যে কথাগুলি বলা হোচ্ছে, এটা বর্তমান সমাজব্যবস্থার নিরিখে ! প্রকৃতিতে দেখা যায় নারী ও পুরুষ উভয় উভয়েরই পরিপূরক হয়েই বর্তমান থাকে ৷ মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্বেও – শুধুমাত্র শরীরের শক্তিতে পুরুষ সামান্য এগিয়ে থাকার সুবাদে, তারা বহুকাল আগে থাকতেই নারীর উপর অকারণ অত্যাচার করেছে, তাদেরকে নানারকম শাসন ও বাঁধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছে ! এটা একপ্রকার মানসিক বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
পুরুষমানুষ তার নিজের চেতনার উন্নতি করার কথা না ভেবে নারীদেরকে ঘরবন্দী, পোশাকবন্দী করতে চেয়ে উভয়কেই (নারী ও পুরুষ) আরো বেশি বিকৃতমনস্ক করে তুলেছে ৷ আমরা গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম যে, আদিম মানুষ এখনো যেসব অঞ্চলে বসবাস করে (আন্দামানের ওংগি-জারোয়া-সেন্টিনেলিজ , মধ্যপ্রদেশের বস্তার অঞ্চলের গোন্দ – আভুজ মারিয়া জনজাতি, আফ্রিকার পিগমী ইত্যাদি) অর্থাৎ যারা এখনো উলঙ্গ বা অর্ধউলঙ্গ হয়েই জীবন যাপন করে –কিন্তু তাদের মধ্যে কোন যৌনরোগ নাই ৷ তাহলেই ভাবুন – ঢাকা-ঢুকো দিয়ে নারীকে রেখে, বা ঘরের মধ্যে অসূর্যমস্পর্শ্যা করে বদ্ধ করে রাখার চেষ্টা তো কয়েক হাজার বছর ধরে চলছে – কিন্তু তার ফলটা কি ? এখনো তো নারীরা পুরুষদের দ্বারা শুধুমাত্র অত্যাচারিতই হয়ে চলেছে – নারীরা ঠিক সেইভাবে কি এখনো সমাজের কাছে মর্যাদা পেয়েছে ?
না — পায়নি ! তাইতো গুরুমহারাজ বাউলদের জীবনে নারীর সুউচ্চ স্থানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন ৷ বাউলগণের বিশেষ বিশেষত্ব এই যে, তাঁরা সমাজের অন্যান্য মানুষের ন্যায় নারী-পুরুষ ভেদ করেন না। তারা মানেন যে, একমাত্র পরমেশ্বরের রূপ শ্রীকৃষ্ণই পুরুষ, বাকি সবাই প্রকৃতি বা নারী ৷ তাই তাঁরা নিজেদেরকেও নারী ভাবে – নারীর ন্যায় চুল বাঁধে, পোশাক পরে, গহনা পরে – নারীভাব অবলম্বন করে জীবন কাটায় ৷ এটি বৈষ্ণবগণের রাধাভাবে সাধনার কথা মনে পাড়ায় ৷ পুরুষ হয়েও নারীবেশ ধারণ করে নিজেদেরকেও নারী ভাবা – এর থেকে নারীদেরকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদাদান আর কি-ই বা হোতে পারে !!