শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের স্বমুখের কথা এবং ওনার স্বহস্ত রচিত গ্রন্থে উল্লেখিত কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা ছিলাম ওনার রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বাউলের মর্মকথা’-র শেষ পরিচ্ছদের কথায় ৷ এই অংশে গুরুমহারাজ ‘কাম’ এবং ‘প্রেম’-এর সম্বন্ধে সুন্দরভাবে আলোচনা করে আমাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন ৷ এখন আমরা দেখবো গুরুমহারাজ এইসব সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন ৷
এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রাকৃত নরনারীর পরস্পর দুর্জয় আকর্ষণ যদি আচ্ছন্নতা মুক্ত হয়, তাহলে তাও মঙ্গলের কারণ হয়ে উঠবে ৷ কিন্তু যদি ওই আকর্ষণ প্রাকৃত আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে এবং জীবনে অমঙ্গল নেমে আসে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! নরনারীর পরস্পরে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সম্বন্ধে আমাদের সকলেরই কম-বেশি ধারণা রয়েছে ! মানুষ ছাড়াও মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যেও আমরা এই আকর্ষণ দেখে থাকি ৷ কিন্তু গুরুমহারাজের কথা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, আমাদের এই আকর্ষণ প্রবৃত্তিজাত এবং আবেশ বা আচ্ছন্নতার দোষে দুষ্ট ৷ আমরা অর্থাৎ মানবেরা, প্রাণীকুলের শ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্ত্বেও__ এই আচ্ছন্নতা বা আবেশ মুক্ত হোতে পারছি না ৷ কারণ, আমরা এর হাত থেকে মুক্ত হোতে চাইছি না ! আর এর ফলেই আমাদের বেশিরভাগের জীবনে ঘটে থাকে নানারকম দুর্ঘটনা, জীবনে নেমে আসে নানান অমঙ্গল ৷ কিন্তু নরনারীর পারস্পরিক এই দুর্জয় আকর্ষণ যদি ওই আবেশ বা আকর্ষণ মুক্ত হয় – তাহলে তা মঙ্গলের কারণ হয়ে ওঠে। তাহলে এটাই বোঝা গেল যে, মানুষের জীবন মঙ্গলময় হয়ে উঠতে গেলে একমাত্র শর্তই হোলো – কামপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করা ৷
যাইহোক, এরপর আমরা দেখি গুরুমহারাজ ওনার ‘বাউলের মর্মকথা’ গ্রন্থের নবম পরিচ্ছেদের শেষভাগে এই সম্বন্ধে আরও কি কি বলেছেন ৷ এরপরে উনি বলেছেন – “প্রেম শুধু নরনারীর ভালবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সমস্ত মিলনের সেতুস্বরূপ ৷ সমস্ত বিরোধের অবসান করতে একমাত্র প্রেমই পারে ৷ প্রেমকে আশ্রয় করেই মানবকে বাঁচতে হবে ৷ যতদিন সৃষ্টি থাকবে, ততদিন প্রেম থাকবে – এর স্থায়িত্ব জীবনের প্রলয়কাল পর্যন্ত ৷”
প্রিয় পাঠক – গুরুমহারাজ এই অংশে প্রেমের আরো কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন ৷ উনি বলেছেন – নরনারীর আকর্ষণজনিত মিলন-ই শুধু ভালবাসা নয় – প্রকৃতপক্ষে ‘প্রেম’ সমস্ত প্রকারের মিলনের সেতুস্বরূপ ৷৷ এখানে ‘সমস্ত প্রকারের মিলন’ বলতে গুরুমহারাজ কি কি মিলন বলতে চেয়েছেন সেটা রহস্যাবৃতই থাকলো, কারণ গুরুমহারাজ এটাকে খোলসা করেন নি ! কিন্তু তারপরে উনি বলেছেন যে, পৃথিবীতে যত প্রকারের বিরোধ রয়েছে – তার অবসান করতে পারে একমাত্র ‘প্রেম’ ! সুতরাং মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচতে গেলে ‘কাম’-কে আশ্রয় করে নয় – প্রেমকে আশ্রয় করেই বাঁচতে হবে। কারণ ‘কাম’ স্থায়ী নয় – ‘প্রেম’-ই স্থায়ী। এই ‘প্রেম’– যতদিন সৃষ্টি থাকবে – ততদিন স্থায়ী, এটি জীবনের প্রলয়কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।
এতদূর বলার পর গুরুমহারাজ আবার বলতে শুরু করেছেন – ” ভালোবাসাই মানবজাতির শেষ উপায়। পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসলেই মানবকৃত অপরাধ বা অনিষ্ট পৃথিবীতে থাকবে না ৷ চিত্তের যে অবস্থায় মানব আত্মসুখ বিসর্জন দেয়, অপরের সুখের জন্য যে অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন দিতেও কুন্ঠিত হয় না – তাই প্রকৃত ভালোবাসা ৷
মানবের ভালবাসা যদি স্বাধীন হয় এবং সেই ভালোবাসায় যদি কোনো পার্থিব কারণ না থাকে, তাহলে সেই ভালোবাসা ক্রমে ঘনতর হয়ে বিশুদ্ধ প্রেমভাব গ্রহণ করে ৷ ভালবাসা মানবকে সুখে সহিষ্ণু এবং দুঃখে সংযত করে এবং মঙ্গলময় কার্য্যে রত করে ৷৷ সার্বিক মঙ্গলের জন্য ভালোবাসাই আত্মত্যাগের প্রেরণা দেয় ৷৷
ভালোবাসার বেগ সকলেরই অনুভূত হয় এবং ভালোবাসার অর্থ সকলেই বুঝতে পারে – ভালোবেসে দ্যাখো ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ এই অংশে একেবারে সিদ্ধান্তের কথা বললেন ৷ মানবের জীবনে করা সাংসারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক – যতরকম অপরাধ বা অনিষ্ট প্রতিনিয়ত সংঘটিত হয়ে চলেছে, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে যত কিছু অপরাধ হোচ্ছে– তাও প্রশমিত হয়ে যাবে একমাত্র প্রেমের দ্বারা ৷৷ গুরুমহারাজ প্রেমের আরো যে মহান দিকটির কথা তুলে ধরেছেন, তা হোলো – ‘প্রেম অবস্থায় মানবের আত্মসুখের ইচ্ছা থাকে না, একে অপরের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনও দিতে পারে ৷’ যেটা আমরা যে কোনো মহাপুরুষদের জীবনে প্রকটিত হোতে দেখি। জীবজগতের কল্যানের কারণে তাঁরা হাসতে হাসতে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন।
যাই হোক, এরপরে উনি বললেন _’এইরূপ প্রেম-ই ধীরে ধীরে আরো ঘনীভূত হয় এবং বিশুদ্ধ প্রেমভাবে পরিণত হয় ৷’ তবে তারপরে গুরুমহারাজ একটি অসাধারণ কথা বলেছেন। আর সেটা হোলো – ‘প্রেম মানবকে সুখে সহিষ্ণু — দুঃখে সংযত করে এবং মঙ্গলময় কার্য্যে রত করে, সার্বিক মঙ্গলের জন্য ভালোবাসাই আত্মত্যাগের প্রেরণা দেয় ৷’