শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্তে লিখিত ‘বাউলের মর্মকথা’ গ্রন্থের নবম পরিচ্ছেদের কথায় ৷ এই অংশে উনি ‘প্রেম’ বিষয়ে গূঢ় ও রহস্যপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন। যেগুলি শুনলে আমাদের মতো যেকোনো মানুষই অবাক হবে, বিস্মিত হবে। সুতরাং আমরা তাড়াতাড়ি চলে যাবো এর পরবর্তী অংশে, দ্যাখা যাক্ গুরুমহারাজ এইসব বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রেম মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারে এবং ভয়কে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে পারে ৷ প্রেমই জীবনের সমগ্র বাধা-বিপত্তি এবং ক্ষতিকে তুচ্ছ করতে পারে ৷ আত্মদানে অপরকে সুখী করবার সার্বিক আকাঙ্ক্ষা বা প্রবণতা প্রেমিকের মজ্জাগত, তার শিরায় শিরায় শোণিতাকারে তা প্রবাহিত হোতে থাকে।
প্রকৃত প্রেম মনুষ্যত্বকে ব্যাপ্ত করে ৷ প্রেম প্রতিদান চায় না – সেবা করেই সুখী ৷ যোগ্য-অযোগ্য বিচারও প্রেম করে না। একমাত্র এই প্রেমই মানবের সমস্ত জ্বালা জুড়াতে পারে। প্রেম অবিনশ্বর – প্রেম সুন্দর ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ ‘প্রেম’ সম্বন্ধে কতো গৌরবমন্ডিত বাক্যসমূহ বলছেন – দেখেছেন ! ‘প্রেম’কে গুরুমহারাজ বলেছেন মৃত্যুঞ্জয়, যার দ্বারা মৃত্যুকে এবং যে কোনো ভয়কে জয় করা যায়। প্রেমের দ্বারাই জীবনের সমস্ত বাধা-বিপত্তি এবং ক্ষতি তুচ্ছ হয়ে যায়। একমাত্র প্রেমিক-ই পারে স্বার্থশূন্য আত্মদানের মাধ্যমে অপরকে সুখী করতে ৷
এছাড়াও গুরুমহারাজ বলেছেন – ‘প্রেম মানুষকে কখনোই সংকীর্ণ করে না, প্রেম মানুষকে ব্যাপ্ত করে – বিস্তারিত করে ৷ যোগ্য-অযোগ্যের বিচার করে না প্রেম, কারণ প্রেম অবিনশ্বর – প্রেম সুন্দর ! প্রেমের দ্বারাই মানবের সমস্ত প্রকার (আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক) জ্বালা দূরীভূত হয়ে যায়৷’
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ ! উপনিষদে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে ‘রস’ I যথা – ‘ রসো বৈ সঃ’ ৷ (তিনিই রসস্বরূপ– তৈত্তিরীয়োপনিষদ- ২/৭)৷ যা হোতে সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তি হয় – তাই রস ৷ এই বিশ্বে যা কিছু সুন্দর – তার মূলে এই রস। এই রস(ই), সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মূলীভূত কারণ ৷ আর আত্মারও সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মুলীভূত কারণ ওই রস। সেইজন্যেই প্রেম অবিনশ্বর – প্রেম সুন্দর ৷”
প্রিয় পাঠক — গুরুমহারাজ আগের প্যারাতেও বলেছিলেন, ” ‘প্রেম’ অবিনশ্বর — প্রেম সুন্দর!”— এই প্যারাতেও আবার ওই একই কথার পুনরাবৃত্তিক করলেন এবং সেটার কারণসহ ব্যাখ্যাও করলেন ৷ কি সুন্দর কথা বললেন গুরুজী – ‘যা হোতে সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তি হয় – তাই রস৷’ উনি আরো বলেছেন – ‘এই বিশ্বে যা কিছু সুন্দর, তার মূলে এই রস। এই রস, সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মুলীভূত কারণ!’ এর সাথেই গুরুজী আরো বলেছেন যে, ‘আত্মারও সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মুলীভূত কারণ ওই রসই!’
এখন এখানে একটা জিজ্ঞাসা আসতেই পারে যে, গুরুমহারাজ ‘প্রেম’ ও ‘কাম’ সম্বন্ধে কথা বলছিলেন – সেখানে হঠাৎ করে একটা Para-য় ‘রস’ সম্বন্ধে আলোচনা করলেন কেন ? আর তাছাড়া উনি এই ‘রস’- সম্পর্কিত আলোচনা দিয়েই ‘প্রেম যে অবিনশ্বর এবং প্রেম যে সুন্দর’– তা প্রতিষ্ঠা করলেন ৷ সুতরাং এই ব্যাপারটায় একটু বিস্তার করার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
গুরুমহারাজ এই Para-র প্রথমেই তৈত্তিরিয় উপনিষদের একটা লাইনের উল্লেখ করে বলেছেন – ‘রস বৈ সঃ’ ৷ এখানে ‘সঃ’ অর্থে ব্রহ্ম ! আর তাছাড়া ‘বাউলের মর্মকথা’ গ্রন্থের প্রথম অংশে আমরা দেখেছি বারবার গুরুমহারাজ উল্লেখ করেছেন যে, রস-সাধনাই বাউলদের চূড়ান্ত পথ এবং লক্ষ্য ‘রসিক’ হয়ে ওঠা ৷ কারণ ‘রসিক’ ভিন্ন রসের আস্বাদন হয় না ৷ এই ‘রসিক’ অবস্থা কেমন ? না – যখন ‘বিন্দু’ অটল হয়, নিস্কম্প হয় – তখন তা ঈশ্বর ভাব ৷ যে অবস্থা শুকদেব-সনক-সনাতন-সনন্দ-আদিরা লাভ করেছিলেন কৌমার্য্যব্রত ও বৈরাগ্য অবলম্বন করে ! তাঁরা ‘অটল’ অবস্থা লাভ করেছিলেন – যেটাকে বলা হয়েছে ঈশ্বরস্থিতি ! কিন্তু ‘রসিক’ অবস্থা এই ঈশ্বরস্থিতিরও পরের অবস্থা !
তাহলে বোঝা গেল তো – কেন ব্রহ্মকে রসস্বরূপ বলা হয়েছে ! ওই যে বলা হয়েছে ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি !’ – এখানে ‘রসিক’ অবস্থা মানেই হোচ্ছে – ব্রহ্মবিদ্ ৷ আর তিনিও তখন রসস্বরূপ বা ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান। সেইজন্যই বলা হয়েছে ‘রস বৈ সঃ’ ! আর এইজন্যেই গুরুমহারাজ তাঁর ‘বাউলের মর্মকথা’ নামক মহাগ্রন্থের একেবারে শেষভাগে সব কিছুর মহামিলন ঘটিয়ে দিয়েছেন ৷৷
এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রেম মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারে এবং ভয়কে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে পারে ৷ প্রেমই জীবনের সমগ্র বাধা-বিপত্তি এবং ক্ষতিকে তুচ্ছ করতে পারে ৷ আত্মদানে অপরকে সুখী করবার সার্বিক আকাঙ্ক্ষা বা প্রবণতা প্রেমিকের মজ্জাগত, তার শিরায় শিরায় শোণিতাকারে তা প্রবাহিত হোতে থাকে।
প্রকৃত প্রেম মনুষ্যত্বকে ব্যাপ্ত করে ৷ প্রেম প্রতিদান চায় না – সেবা করেই সুখী ৷ যোগ্য-অযোগ্য বিচারও প্রেম করে না। একমাত্র এই প্রেমই মানবের সমস্ত জ্বালা জুড়াতে পারে। প্রেম অবিনশ্বর – প্রেম সুন্দর ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ ‘প্রেম’ সম্বন্ধে কতো গৌরবমন্ডিত বাক্যসমূহ বলছেন – দেখেছেন ! ‘প্রেম’কে গুরুমহারাজ বলেছেন মৃত্যুঞ্জয়, যার দ্বারা মৃত্যুকে এবং যে কোনো ভয়কে জয় করা যায়। প্রেমের দ্বারাই জীবনের সমস্ত বাধা-বিপত্তি এবং ক্ষতি তুচ্ছ হয়ে যায়। একমাত্র প্রেমিক-ই পারে স্বার্থশূন্য আত্মদানের মাধ্যমে অপরকে সুখী করতে ৷
এছাড়াও গুরুমহারাজ বলেছেন – ‘প্রেম মানুষকে কখনোই সংকীর্ণ করে না, প্রেম মানুষকে ব্যাপ্ত করে – বিস্তারিত করে ৷ যোগ্য-অযোগ্যের বিচার করে না প্রেম, কারণ প্রেম অবিনশ্বর – প্রেম সুন্দর ! প্রেমের দ্বারাই মানবের সমস্ত প্রকার (আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক) জ্বালা দূরীভূত হয়ে যায়৷’
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ ! উপনিষদে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে ‘রস’ I যথা – ‘ রসো বৈ সঃ’ ৷ (তিনিই রসস্বরূপ– তৈত্তিরীয়োপনিষদ- ২/৭)৷ যা হোতে সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তি হয় – তাই রস ৷ এই বিশ্বে যা কিছু সুন্দর – তার মূলে এই রস। এই রস(ই), সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মূলীভূত কারণ ৷ আর আত্মারও সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মুলীভূত কারণ ওই রস। সেইজন্যেই প্রেম অবিনশ্বর – প্রেম সুন্দর ৷”
প্রিয় পাঠক — গুরুমহারাজ আগের প্যারাতেও বলেছিলেন, ” ‘প্রেম’ অবিনশ্বর — প্রেম সুন্দর!”— এই প্যারাতেও আবার ওই একই কথার পুনরাবৃত্তিক করলেন এবং সেটার কারণসহ ব্যাখ্যাও করলেন ৷ কি সুন্দর কথা বললেন গুরুজী – ‘যা হোতে সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তি হয় – তাই রস৷’ উনি আরো বলেছেন – ‘এই বিশ্বে যা কিছু সুন্দর, তার মূলে এই রস। এই রস, সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মুলীভূত কারণ!’ এর সাথেই গুরুজী আরো বলেছেন যে, ‘আত্মারও সৌন্দর্য্য আস্বাদনের মুলীভূত কারণ ওই রসই!’
এখন এখানে একটা জিজ্ঞাসা আসতেই পারে যে, গুরুমহারাজ ‘প্রেম’ ও ‘কাম’ সম্বন্ধে কথা বলছিলেন – সেখানে হঠাৎ করে একটা Para-য় ‘রস’ সম্বন্ধে আলোচনা করলেন কেন ? আর তাছাড়া উনি এই ‘রস’- সম্পর্কিত আলোচনা দিয়েই ‘প্রেম যে অবিনশ্বর এবং প্রেম যে সুন্দর’– তা প্রতিষ্ঠা করলেন ৷ সুতরাং এই ব্যাপারটায় একটু বিস্তার করার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
গুরুমহারাজ এই Para-র প্রথমেই তৈত্তিরিয় উপনিষদের একটা লাইনের উল্লেখ করে বলেছেন – ‘রস বৈ সঃ’ ৷ এখানে ‘সঃ’ অর্থে ব্রহ্ম ! আর তাছাড়া ‘বাউলের মর্মকথা’ গ্রন্থের প্রথম অংশে আমরা দেখেছি বারবার গুরুমহারাজ উল্লেখ করেছেন যে, রস-সাধনাই বাউলদের চূড়ান্ত পথ এবং লক্ষ্য ‘রসিক’ হয়ে ওঠা ৷ কারণ ‘রসিক’ ভিন্ন রসের আস্বাদন হয় না ৷ এই ‘রসিক’ অবস্থা কেমন ? না – যখন ‘বিন্দু’ অটল হয়, নিস্কম্প হয় – তখন তা ঈশ্বর ভাব ৷ যে অবস্থা শুকদেব-সনক-সনাতন-সনন্দ-আদিরা লাভ করেছিলেন কৌমার্য্যব্রত ও বৈরাগ্য অবলম্বন করে ! তাঁরা ‘অটল’ অবস্থা লাভ করেছিলেন – যেটাকে বলা হয়েছে ঈশ্বরস্থিতি ! কিন্তু ‘রসিক’ অবস্থা এই ঈশ্বরস্থিতিরও পরের অবস্থা !
তাহলে বোঝা গেল তো – কেন ব্রহ্মকে রসস্বরূপ বলা হয়েছে ! ওই যে বলা হয়েছে ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি !’ – এখানে ‘রসিক’ অবস্থা মানেই হোচ্ছে – ব্রহ্মবিদ্ ৷ আর তিনিও তখন রসস্বরূপ বা ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান। সেইজন্যই বলা হয়েছে ‘রস বৈ সঃ’ ! আর এইজন্যেই গুরুমহারাজ তাঁর ‘বাউলের মর্মকথা’ নামক মহাগ্রন্থের একেবারে শেষভাগে সব কিছুর মহামিলন ঘটিয়ে দিয়েছেন ৷৷