শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা এতদিন ধরে ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথার* শেষ পরিচ্ছেদের কথায় ৷ আজকেই আমাদের এই গ্রন্থের শেষ অংশ নিয়ে আলোচনা হবে ৷ এরপরে আমরা এই গ্রন্থের পরিশিষ্টতে সন্নিবেশিত ওনার লেখা কবিতাবলীর মধ্যে দুটি কবিতা পরপর দু’দিনে পরিবেশন করা হবে ৷ যাইহোক, এখন দেখা যাক্ এই গ্রন্থটির একেবারে শেষ দুটি stanza-য় গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন ৷
এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ ! মানবের ইচ্ছাশক্তির আবেগকে সুনিয়ন্ত্রিত করে স্থায়ীভাবে রূপান্তর করতে পারলে ঐ প্রেমলাভ হয় ৷ তখন প্রকৃতি সকল রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং মানব আত্মসংযমী হয় ৷ সেই কারণেই এটা ভাবাবেগ নয়, এটা একান্ত সুনিয়ন্ত্রিত ভাব বা স্থিতি, আর এটাই সহজতা ৷

এই সহজস্থিতির উদয় হলে বিশ্বচরাচর মাধুর্যময় – আনন্দময় – রসময় হয়ে ওঠে ! প্রেম ভিন্ন আনন্দ নাই, আবার আনন্দ ভিন্ন প্রেম নাই ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এই অংশে গুরুমহারাজ *প্রেমলাভে*-র উপায় কি – এই সম্বন্ধে মাত্র একটি বাক্য ব্যবহার করেছেন ৷ উনি বলেছেন – ‘মানবের ইচ্ছাশক্তির আবেগকে সুনিয়ন্ত্রিত করতে হবে এবং তাকে স্থায়ীভাবে রূপান্তর করতে হবে ৷’ তবে গুরুজী একটা মাত্র বাক্যে কথাগুলি বললেও আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, আমাদের অন্তর্জগতে উত্থিত ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে স্থায়ীভাবে রূপান্তর করতে কঠিন সাধনার প্রয়োজন ৷ ওই স্থিতিতে পৌঁছানো অতটা সহজ কথা নয় ! কিন্তু গুরুজী বলেছেন – ‘কামে’-র প্রভাব, প্রবৃত্তির দাসত্বের জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে চিরস্বাধীন হবার উপায় একমাত্র এটিই অর্থাৎ মানবের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে স্থায়ীভাবে রূপান্তর করা !
গুরুজী আরো বলেছেন যে, এই অবস্থা বা স্থিতি প্রাপ্ত হলে মানবের স্বভাব বা প্রকৃতির পরিবর্তন হয়ে যায় এবং মানব আত্মসংযবী হয় ! সেই অর্থে আমরা অনেক সময় *প্রেম*-কে যে ‘মানবের ভাবাবেগ’ বলে মনে করে থাকি – কিন্তু গুরুজী এই জায়গায় আমাদের ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছে। উনি বলেছেন – *প্রেম* হলো সুনিয়ন্ত্রিত ভাব এবং এটি একটি বিশেষ স্থিতি, যা মানবের সহজতা ৷৷
আর এরফলে অর্থাৎ সহজস্থিতি-তে স্থিত হলে তবেই মানবের কাছে সমগ্র বিশ্বচরাচর মাধুর্যময় – আনন্দময় – রসময় হয়ে ওঠে ৷ তখন আর কোনোরূপ দ্বৈতসত্ত্বা, কোনরূপ বিচার বা ভেদাভেদ ক্রিয়াশীল থাকে না ৷ তখন একটা অখণ্ড, অভেদ ভাব আসে এবং বিশ্বচরাচরের সমস্তকিছুকেই ভালোবাসা সম্ভব হয়। সুতরাং *প্রেমে*-ই আনন্দ এবং যেখানে আনন্দ সেখানেই *প্রেম* ৷
এইবার আমরা দেখবো গুরুমহারাজ এই গ্রন্থের একেবারে শেষ ভাগে আরো কি কি বলেছেন ৷ এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রাণঢালা ভালোবাসাতেই – আত্মদানেই তৃপ্তি ৷ প্রেমিকহৃদয় বেসাতি করতে জানে না ৷ প্রেমের মৃত্যু নাই – প্রেম চিরন্তন ৷
প্রেম না থাকলে এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেতো ৷ এতো মানুষ যে পাশাপাশি রয়েছে বা থাকছে – এটাই প্রেমশক্তির প্রমাণস্বরূপ ৷
প্রিয় আত্মন্‌ ! প্রতিটি মানবের মধ্যে এই মঙ্গলবোধ নিহিত আর ঐ মঙ্গলবোধের দিকটিই প্রেমে জাগরুক হয়ে ওঠে ৷ প্রেম-ই আত্মিকশক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি যা মানবের ভিতর দেখা যায় ৷
প্রিয় আত্মন্‌ ! অমূর্ত ভগবান প্রেমরূপেই জগতে মূর্ত হয়ে ওঠেন আর মানবের মাঝেই তাঁর পূর্ণ অভিব্যক্তি !”
************”””””***********”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! ‘মানবের পূর্ণ অভিব্যক্তি’-র কথা বলেই গুরুমহারাজ তাঁর *বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থটি শেষ করেছেন। তার আগে উনি *প্রেম*-এর মহত্ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন – ‘প্রেমিক হৃদয় বেসাতি করতে জানে না – তার আত্মদানেই তৃপ্তি ! আহা-হা ! কি অপূর্ব কথার ব্যঞ্জনা দেখেছেন ! গুরুজী খুব সহজকথায় সহজভাবে *প্রেম* যে এই বিশ্বসংসারে প্রকটিত রয়েছে, তার একটা উদাহরণ দিয়েছেন। উনি বলেছেন – “এই যে সমগ্র বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ পাশাপাশি বসবাস করে চলেছে, তারা একসাথে চলছে, একসাথে বলছে, একে অপরকে সহ্য করছে – গ্রাহ্য করছে, একে অপরের গুণের কদর করছে, একে অপরের আদর্শ অনুসরণ করছে – এইগুলিই তো *প্রেম*-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এইজন্যেই তো বলা যায় ‘কহনা প্যার হ্যায়’– Believe in love !
প্রতিটি মানবের মধ্যে এই যে পরস্পর পরস্পরকে মেনে নেওয়া – গ্রহণ করা রূপ মঙ্গলজনক দিকটি রয়েছে – সেটাই *প্রেম*-এর জন্যেই, আর *প্রেম*-ই মানবের আত্মিকশক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি ঘটাতে পারে ৷ এরপরে গুরুমহারাজ *ভগবান* বা ঈশ্বরের অবতরিত রূপের কথা বলেছেন – যাঁরা সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপ হয়ে ধরার ধুলায় অবতীর্ণ হন ৷৷