শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ বেশ কিছুদিন ধরে আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত গ্রন্থদ্বয় ‘সহজতা ও প্রেম’ এবং ‘বাউলের মর্মকথা’ থেকে লাইন তুলে তুলে – সেগুলিকে ভালো করে যাতে বুঝতে পারি অর্থাৎ উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে গুরুমহারাজ সমগ্র মানবজাতির জন্য কি সম্পদ রেখে গেছেন – সেইগুলি ধারণা করতে পারি__তার চেষ্টা করছিলাম ৷ আসলে ব্যাপারটা হোলো – আমাদের সকলেরই (পরমানন্দ ভক্তরা) বাড়িতে ওই গ্রন্থ দুটি রয়েছে, হয়তো একাধিকই রয়েছে, এমনকি আমরা হয়তো আমাদের দু-চার জন বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনকে ঐ বইগুলি gift-ও করেছি ! আমরাও যে বইগুলি আগাগোড়া একবার করে reading পড়িনি – তাও নয় ! কিন্তু ঐ এক-আধবার পড়ে গ্রন্থগুলিতে পরিবেশিত তত্ত্ব বা তথ্যের সম্যক ধারণা আমাদের প্রায় কারোরই হয়নি ৷ গুরুমহারাজ আমাদেরকে ওই বইগুলি বারবার পড়তে বলেছিলেন ! আমরা তাও করতে পারি না ! সেইজন্যেই একটু চেষ্টা করা হোলো – যাতে গুরুমহারাজের নিজের হাতে লিখিত গ্রন্থদুটিকে একটু একটু করে ভালোভাবে পড়া হয় এবং উক্ত গ্রন্থদুটিতে পরিবেশিত তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে ধারণা আনার চেষ্টা করা যায় ৷
এখন আমরা আবার ফিরে যাবো ‘পুরোনো বনগ্রামের কথা’ -য় অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত গুরুমহারাজের কথায়, তাঁর পার্ষদসমূহ ও তাঁর ভক্তবৃন্দের কথায় ! তাছাড়াও গুরু মহারাজের স্থুলশরীরের অন্তর্ধানের পর থেকে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে আজ (২০২৩ সাল) পর্যন্ত যত পুরোনো পরমানন্দ ভক্তদের সাথে গুরুমহারাজ সংক্রান্ত কথা হয়েছে সেগুলিও তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। সেই সমস্ত ভক্তদের জীবনে স্বামী পরমানন্দের প্রভাব ও তাদের পরমানন্দ-বোধ বা বিশ্লেষণ – এইগুলি সবই থাকবে এই আলোচনা সমূহে ৷ তাহলে আসুন এখন আমরা সেই চেষ্টায় ব্রতী হই ৷৷
গুরুমহারাজ ভক্তবৃন্দদের সাথে করে নিয়ে বেশ কয়েকটি tour programme করেছিলেন ৷ উত্তর ভারতের ভক্তবৃন্দ এবং দক্ষিণ ভারতের ভক্তবৃন্দদেরকে নিয়ে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা এমনই প্রোগ্রাম করেছিলেন গুরুজী – যেগুলির কিছু কিছু কথা আমরা আগে জেনেছি ৷ তাছাড়া দক্ষিণ ভারতের ভক্তরা ভিডিও-র মাধ্যমেও সেগুলির কিছু কিছু অংশ ধরেও রেখেছেন। তবু আমরা সেগুলিরও টুকরো টুকরো কথা যেমন তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ঠিক তেমনি আমাদের এখানকার ভক্তদেরকে নিয়ে (বিশেষতঃ সিঙ্গুর তত্ত্বমসি যোগাশ্রমের কর্মকর্তাদের উদ্যোগে পরিচালিত tour programme-গূলি) যে সমস্ত এই ধরনের প্রোগ্রামে উনি অংশগ্রহণ করেছিলেন – সেইগুলির কিছু কিছু ঘটনা এখন তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
কিছুদিন আগে পূর্ণানন্দ মহারাজ (বর্তমানে রায়না তপোবন আশ্রমের অধ্যক্ষ)-এর সাথে গুরুমহারাজকে সাথে নিয়ে ওনাদের সুন্দরবন tour Programme-এর অভিজ্ঞতার কথা হচ্ছিলো ৷ যদিও সেই ঘটনাগুলি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের কথা– তবুও গুরুমহারাজ সম্পর্কিত কথা তো – তাই পূর্ণানন্দ মহারাজ এমনভাবে বলছিলেন, যেন মনে হচ্ছিলো এই সবে ঘটনাগুলি ঘটেছে ৷ আসলে “স্বামী পরমানন্দ” তো নিত্য বর্তমান – তাই তাঁর কথা বলার সময় বা তাঁর স্মৃতিচারণ করার সময় পরমানন্দ ভক্তমন্ডলীও যেন ‘সেই বর্তমানে’ পৌঁছে যায় – তাই ঘটনাগুলির স্মৃতিচারণ এতোটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে !
আপনারা যারা নিয়মিত গুরুমহারাজের তৎকালীন ঘটে যাওয়া ঘটনা বা তাঁর কথা পড়েন বা শোনেন — দেখবেন আপনারাও যেন কালের সরণী বেয়ে ঠিক পৌঁছে যান ‘পুরোনো সেই বনগ্রামে’ ! হয় না কি – বলুন ! নিশ্চয় হয় !!
যাইহোক, এখন আমরা শুরু করছি ‘লঞ্চযোগে গুরুমহারাজের সুন্দরবন ভ্রমণের কাহিনী’ ৷৷ এই ভ্রমনের সময় গুরু মহারাজকে কেন্দ্র করে এমন কিছু অত্যাশ্চর্য ঘটনাসমূহ ঘটেছিল_যেগুলি সবার সাথে শেয়ার করতে পারলে, গুরু মহারাজের লীলা আস্বাদনের আনন্দ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলেই আমার মনে হয় ‌।।
সিঙ্গুর আশ্রমের ভক্তগণ অর্থাৎ বাবু মহারাজ বা পূর্ণানন্দ মহারাজের ভাই, পাপু, রঞ্জন (অতি সম্প্রতি পরমানন্দলোক প্রাপ্ত হয়েছেন), বসু (বসুদেব পাকিরা), আনন্দ, পল্লব (পেলু), ভোলা (ছোট ও বড়), তপন অধিকারী, সব্যসাচী মান্না প্রমুখ ইয়ং বিগ্রেড এবং রিতাদি (পূর্ণানন্দ মহারাজের বোন), পার্বতী, রাণুদি, শ্যামলী, দীপালী, কাজল, কল্পনা প্রমুখ আর বয়স্ক ভক্তগণ ভাতু দা, ধীরেনদা, পশুপতিদা প্রমুখদেরকে নিয়ে তৎকালীন সিঙ্গুর তত্ত্বমসি যোগাশ্রম যেন সবসময় জমজমাট হয়ে থাকতো ৷ ওখানে তখন স্বামী শংকরানন্দ মহারাজ প্রায়শঃই থাকতেন। পূর্ণানন্দ মহারাজের ওখানেই পূর্বাশ্রম হওয়ায় এবং পিতা-মাতা জীবিত থাকায় উনিও প্রায়ই ওই আশ্রমে যেতেন ৷ মিহির মহারাজ বা স্বামী প্রজ্ঞানন্দ হিমাচল থেকে প্রত্যেক শীতকালে বাংলায় চলে আসতেন এবং মাসাধিককাল সিঙ্গুর আশ্রমে বা ওই আশ্রমকে কেন্দ্র করেই কাটিয়ে দিতেন। আর এই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে ছিলেন গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ !!!
উনি প্রত্যেক বছর (দেশে থাকলে) একবার অথবা দুই বা তিনবার সিঙ্গুর আশ্রমে যেতেনই। আর উনি যাওয়া মানেই ভক্তের ঢল নামা !! কতশত মানুষ যে আসতো ওনার সিটিং-এ, তা গুনে শেষ করা যাবে না ৷ সিঙ্গুর অঞ্চলের হাজার হাজার ভক্ত তখন গুরু মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিল ৷ নদীয়ার করিমপুর আশ্রম এবং হুগলির সিঙ্গুর আশ্রম, এই দুটি আশ্রমেই__গুরু মহারাজ গেলে সত্যি সত্যিই ভক্তের ঢল্ নামতো !! কি যে সুন্দর দিন কাটতো সেই সময় – তা কি মুখে বলে প্রকাশ করা যায় ! যারা সেই দিনগুলি কাটিয়েছেন – তাদের চোখে যদি এই লেখা পড়ে – তাহলে হয়তো তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে – কিন্তু প্রকাশ করতে চাইলেও পারবে না !! হয়তো তাদের উচ্ছাসটুকু প্রকাশ পাবে – কিন্তু প্রকৃত আনন্দের স্বাদ তো আর কারো সাথে শেয়ার করতে পারা যাবে না – সেই অনুভূতি অন্তরজগতেই থেকে যাবে চিরকাল ! আর ইউরোপীয় কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেমন মাত্র একবার পাহাড়ী পথের উপত্যকায় ড্যাফোডিল ফুলের বন্যা দেখেছিলেন কিন্তু সেই সুখকর স্মৃতি তিনি যখন-তখন একান্তে চোখ বুজলেই অনুভব করতে পারতেন__আমাদেরও সেই অবস্থাই হয় ! ঐ কবির সাথে আমাদের শুধু পার্থক্য এই যে, আমরা একান্তে বসেই শুধু নয়__দু-একজন গুরু ভাই-বোন একত্রিত হোলেই পরমানন্দ রসের আস্বাদন হয় ৷৷
(আজকে গৌড়চন্দ্রিকাতেই গেল, কাল থেকে গুরুমহারাজের সুন্দরবন যাত্রার কথা শুরু হবে।)