শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের সঙ্গে সিঙ্গুর তত্ত্বমসি যোগাশ্রমের ব্যবস্থাপনায় কিছু সৌভাগ্যবান ভক্তগণের যে সুন্দরবন ভ্রমণ( tour programme) হয়েছিল – তারই বর্ণনায় আমরা ছিলাম ৷ আমরা আগের আলোচনায় দেখেছিলাম যে, গুরুমহারাজের উপস্থিতিতে যাত্রীগণসহ লঞ্চ দুটি (যে দুটি লঞ্চে যাত্রীগণ ছিলেন) ভয়ংকর সামুদ্রিক টর্নেডোর সম্মুখীন হয়েছিল ৷ যাত্রীসহ ছোটো লঞ্চটি সেই টর্নেডোর প্রভাবে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছিল – কিন্তু বড় লঞ্চটি এবং তার মধ্যে থাকা আরোহীরা সেই ঝড়ের ভয়ংকরতা দূর থেকে অবলোকন করেছিল – কেউ কেউ enjoy-ও করেছিল, কিন্তু কোনোভাবেই ওই ঝড়ের প্রকোপে পড়েনি ! যেহেতু দুটি লঞ্চ‌ই টর্নেডো শুরুর আগেই একটি খাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কাও তেমন খেতে হয় নি ৷
যদিও গুরুমহারাজ সকলকে কেবিনের মধ্যে থাকতে বলেছিলেন এবং ওই বিপদের মুহূর্তে সকলকে নিজ নিজ ইষ্টমন্ত্র জপ করতে বলেছিলেন – তবু সিঙ্গুর তত্ত্বমসি যোগাশ্রমের young brigade-এর কেউ কেউ ডেকের উপরে উঠে বা অন্য কোনোভাবে ওই টর্নেডোর গতিবিধি এবং ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করেছিল। শ্রীমান পাপু (দেবব্রত দাস)-র ঐ ভ্রমণকালীন সময়ের ক্ষীণ স্মৃতি এখনও রয়েছে (‘এখন বয়সের কারণে ওনার স্মৃতিশক্তি অনেকটাই ‘টাল’ খাচ্ছে’ __তবু সেই থেকেই উনি কিছু কিছু কথা বলছিলেন), তার কাছেই এসব কথা শুনেছিলাম ৷ ও বলছিল যে হাতির শুঁড়ের মতো মেঘের একটা স্তম্ভ মেঘমন্ডল থেকে একেবারে জলস্তর পর্যন্ত নেমে এসেছিল ৷ তারপর সেটা জলের উপরেই ধীরে ধীরে ডানদিক বাঁ-দিক করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ৷ এর ফলে সমুদ্রের জল উত্তাল হয়ে উঠছিল এবং বিকট গর্জন করে প্রবল বাতাস চারিদিক থেকে ছুটে আসছিল ৷ আর এতেই ছোটো লঞ্চটি দূরে সরে গিয়েছিল।
যাইহোক, আমরা আগে আপনাদের কথা দিয়েছিলাম যে, জম্বুদ্বীপে (যে দ্বীপে সাধারণতঃ পর্যটকদের নামতে দেওয়া হয় না, তাছাড়া কোনো জেটিও নাই৷) গুরুমহারাজের পদার্পণের কথা আপনাদেরকে সবিস্তারে বলবো [যেহেতু তপিমার (পবিত্রপ্রাণা) কাছ থেকে (ভায়া সৌরভজী) in detail তথ্য পাওয়া গেছে।] – আজ সেটাই শুরু করি ৷
পাপু মহারাজ (দেবব্রত দাস বাবু) যা বলেছিলেন তাতে করে জেনেছিলাম যে, গুরুমহারাজের সাথে মাত্র দু-তিনজন ওখানে গিয়েছিলেন (যেহেতু পাপু মহারাজ কষ্ট করে কাদায় নামাটা পছন্দ করেন নি, তাই কে কে গুরুজীর সাথে গেল__ এই নিয়ে ওনার দামী মস্তিষ্ক ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি ৷ আর ‘পেলু’ অর্থাৎ সিঙ্গুরের পল্লব বললো – ” তখন কি জানতুম যে, এই ৩০ বছর পরে ‘শ্রীধরদা’ নামক একজন এসে __স্মৃতির চাকে বাঁশ দিয়ে খোঁচা মারবে, তাহলে সবকিছুই note করে রাখতুম ৷” এখন আর তার অতোটা মনে নাই ৷
কিন্তু – তপিমা যেহেতু ঐ যাত্রায় গুরুজীর সঙ্গে সঙ্গেই সবসময় ছিলেন, তাই উনি পুরো ঘটনাটাই জানেন এবং তাঁর সব কিছুই মনে আছে ৷ লঞ্চ থেকে জম্বুদ্বীপের কিনারায় যাবার জন্য ছোট ডিঙিতে করে যেতে হয়েছিল। লঞ্চেই ঐরকম ছোটো ছোটো ডিঙি থাকে ৷
গুরুজী ওই দ্বীপে যেতে চান_ এই কথা জানতে পেরে সারেং-রাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ৷ গুরুজী লঞ্চ থেকে ডিঙিতে লাফ মেরে নামতেই তপি-মা এবং অঞ্জু-মা প্রথমেই গুরুমহারাজের সঙ্গ ধরেছিল ৷ তারপর একে একে রানা (সুখচরের মানিক বোসের ছেলে), হীরুদা (বর্ধমান), আনন্দ (সিঙ্গুর), ধীরেন (কুড়মুন), সন্ধ্যা মা (রায়না) – প্রমুখরা প্রায় ১০/১১ জন জম্বুদ্বীপে যাওয়ার জন্য ready হয়ে গেছিলো। গুরুজী প্রথমটায় কাউকে কিছু বলেন নি কিন্তু যখন ডিঙিতে অনেক কজন হয়ে গেল – তখন ডিঙি ছেড়ে দিতে বলেছিলেন ৷ কিছুটা যেতেই তীরে ভিড়েছিল ডিঙি – কিন্তু সেইসময় ভাটা থাকায় জল অনেকটা নেমে এসেছিল ৷ ফলে ডিঙি থেকে নেমেই প্রায় এক হাঁটু করে কাদা আর জল !! ঐ জল-কাদার মধ্যে অনেকখানি যেতে হবে_ তারপর দ্বীপের শুকনো ডাঙা পাওয়া যাবে ৷
এইটা দেখে বর্ধমানের হীরুদা ও ধীরেনদা গুরুমহারাজকে খুবই অনুরোধ করেছিল_ যাতে তপিমাকে ওই কাদার মধ্যে দিয়ে না নিয়ে যেতে ৷ কিন্তু তপিমা জোর দিয়ে বলেন যে, ‘ তিনি পারবেনই !’
এরপরে গুরুজী আর আপত্তি করেন নি ৷ কিন্তু এরপরে যেটা হয়েছিল – সেটাই আশ্চর্য্যের ! কেননা গুরুজীর সাথে ঐ এক হাঁটু জল-কাদার মধ্যে দিয়ে গুরুজীর সাথে সাথে তপিমা এবং অঞ্জুমা-ই সবার আগে পাড়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং কোথাও না দাঁড়িয়ে ওনারা প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার হেঁটে দ্বীপটির প্রায় অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন ৷ হাঁটু পর্যন্ত গোটা পা ভর্তি কাদা, কাপড়ের নিচের অংশ জল-কাদায় ভেজা – সেই অবস্থায় অতোটা হাঁটা ! তার উপর সেই সময় ছিল সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপ ! এর ফলে সকলেই একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিল ৷ বাকিরাও গুরু মহারাজের পিছু ধরে ওই রকম কষ্ট করেই আসছিল_কিন্তু কাদার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে__ তারা গুরুজীকে চোখের আড়াল করে ফেলেছিল। ফলে তাদের অনেকেই অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। কেউ কেউ ধীরে ধীরে আসছিল – ফলে প্রথম দিকটায় বাকিরা কেউই গুরুজীকে ধরতে পারে নি।
এদিকে গুরুমহারাজ তপিমা এবং অঞ্জুমা সোজা হাঁটতে হাঁটতে কয়েকঘর মেছুয়ারা যেখানে বাস করে – সেখানে এসে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে একটা টিউবওয়েল ছিল। তাতেই ওনারা তিনজন হাত-পা ভালো করে ধুয়ে নিয়েছিলেন। সবাই ওই টিউবয়েলের জল খেয়ে একটু সুস্থ হয়েছিলেন। এরপরে ওখানে একটা ছোটো হনুমান মন্দির বা দেবী মন্দির মতো ছিল, সেখানে বসে গুরুমহারাজ মৌজ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন ৷ এইসব করতে করতেই একে একে বাকিরা এসে ওনাদের সাথে যোগদান করতে শুরু করেছিল ৷৷(ক্রমশঃ)