গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ একদিন সিঙ্গুরে বিখ্যাত ভক্ত-পন্ডিত অনিলরতন কবিরাজ মহাশয়ের বাড়িতে সিটিং (ধর্মালোচনা) করছিলেন ৷ কবিরাজ মশাই নিজে একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন , তাছাড়া তিনি একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন ৷ তাই তাঁকে কেন্দ্র করে একটি ভক্তমহল (যারা সমাজের জ্ঞানী-গুণী-শিক্ষিতও বটে) গড়ে উঠেছিল ৷ সুতরাং গুরু মহারাজ যেদিন অনিলরতন বাবুর বাড়িতে ধর্মালোচনার জন্য গিয়েছিলেন – সেদিন ঐ পন্ডিতমহলও ওখানে উপস্থিত ছিলেন ।
ফলতঃ , নানারকম প্রশ্নবাণে ওরা সবাই গুরু মহারাজকে অতিষ্ট করে তুলেছিল ৷ গুরু মহারাজ শান্তকণ্ঠে সবার সব জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন ৷ পন্ডিতকুল তাদের শাস্ত্র-জ্ঞান কার কতটা তা জানানোর জন্য গীতা-পুরান-দর্শন-বেদ-উপনিষদ ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি দিয়ে যাচ্ছিলেন ৷ স্মিতহাসি আর মধুরকন্ঠে গুরু মহারাজ সেগুলির সহজ বাংলায় ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন ।
এরপর একসময় দেখা গেল – শুধু গুরু মহারাজই কথা বলছেন – বাকিরা সব চুপচাপ ! গুরু মহারাজ ওনাদেরই জিজ্ঞাসার সূত্র ধরে একে একে জগৎ-জীবন-ঈশ্বর এইক্রমে জড়তত্ত্ব , জীবনতত্ত্ব , ঈশ্বরতত্ত্ব সুন্দরভাবে বোঝাতে শুরু করলেন ৷ এরপর এগুলি থেকে চলে গেলেন শক্তিতত্ত্বে ! প্রাণতত্ত্ব , আত্মতত্ত্ব হয়ে – সবার শেষে ব্রহ্ম ! “সর্বং খলু ঈদৎ ব্রহ্ম”!
এরপরই গুরু মহারাজ চুপ করে গেলেন ! ঘরের বাকিরাও চুপচাপ ! একটা পিন পড়লেও যেন শোনা যায় ! অখন্ড নিস্তব্ধতা – নীরবতা ! ঐ মুখর পণ্ডিত ব্যক্তিগুলো , যারা আশেপাশের লোকজনকে জ্ঞান দেওয়ার ছলে শুধু কথা বলেই যায় – তারা আজকে বাক্যহারা হয়ে চুপ করে বসে আছে ! গুরু মহারাজও চুপ করে মিটিমিটি হাসছেন ৷ হঠাৎ করে সেই অখণ্ড নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মাষ্টারমশাই বলে উঠলেন – ” সবই তো বুঝলাম মহারাজ ! কিন্তু ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে !” কথাটা শোনামাত্রই গুরু মহারাজ হেসে ফেললেন – ঘরের সবাই (অনিলরতন বাবু ছাড়া) নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে হো-হো করে হেসে উঠল !
আমরা সাধারণ মানুষেরা – যেন ওই মাষ্টারমশাই ! আমরা সব-ই বুঝি ! কোনটা ভালো – কোনটা মন্দ , তা কি আমরা বুঝি না ? খুবই বুঝি ! কিন্তু রাজহংস হতে পারছি কি ? অসারের মধ্যে ‘সার’ আছে , তা তো আমরা জানি – কিন্তু ‘সারে – মাতে’ (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা)-র মধ্যে শুধু ‘সার’ -টা নিতে পারছি কই ? যখন আমাদের এই ‘না-পারা’ -টা প্রকট হচ্ছে , তখন ঐ রকম একটা মন্তব্য করে দায় সারি – “ব্যাপারটা খুব গোলমেলে”!
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” গোলের মধ্যেই মাল আছে ।” এখানে ‘গোল’ মানে কি Round- Shaped অথবা ‘গোল’ মানে ‘গন্ডগোল’ , ‘বিশৃঙ্খল অবস্থা’ বা ‘অনেক লোকের একত্র চিৎকার-চেঁচামেচি’ ইত্যাদি ? আমার মনে হয় দুটোই হতে পারে ! ‘গোল’ বা Round Shaped বলতে উনি হয়তো পৃথিবীকেই বোঝাতে চেয়েছেন ! এই পৃথিবীতে কত বৈচিত্র্য , তবু তার মধ্যেই রয়েছে ‘একতা’র সুর – আর সেই সুর খুঁজে পেয়েছেন , এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয় ! আবার ‘গোল’ মানে যদি disharmony হয়, তাহলে disharmony-র মধ্যে harmony-কে প্রাপ্ত হওয়াই ‘গোলের’ মধ্যে ‘মাল’ -কে প্রাপ্তি !
যে কোন মতে বা পদ্ধতিতে সাধনার তো এটাই উদ্দেশ্য ! মন বিশৃঙ্খলায় রয়েছে , মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে শৃঙ্খলা নাই , শরীরের অভ্যন্তরে কফ-পিত্ত-বায়ুর বিশৃঙ্খল অবস্থা , শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যে ঊনপঞ্চাশ বায়ু-র ক্রিয়া থাকার কথা – সেগুলিরও শৃঙ্খলা নাই – এইভাবে শুধুই বিশৃঙ্খলা , বিশৃঙ্খলা আর বিশৃঙ্খলা !
তাহলে কি করলে বিশৃঙ্খলা শৃঙ্খলায় আসবে ? গুরু বলছেন , ” সাধন করো ! আগে চুপ করে একটা নির্জন স্থানে বস । তারপর ডান নাসারন্ধ্র চেপে ধরে বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে যতটা পারো শ্বাস টানো – তারপর বাম নাসারন্ধ্র চেপে ধরে ডান নাসারন্ধ্র দিয়ে সমস্ত বায়ুটা ছেড়ে দাও! এইভাবে শুরু করো প্রানায়াম! রেচক-পূরক-কুম্ভকযুক্ত প্রানায়াম পরে শিখবে! আগে ‘সহজ প্রানায়াম’ শিখে নাও! এই পদ্ধতিতে প্রান-অপান বায়ু কে আগে শৃঙ্খলায় আনো! তাহলেই ‘সমান’ বায়ু ও সাম্যে আসবে।
এইভাবে প্রথমে ‘পঞ্চবায়ুর’ সাম্য আসুক_তাহলে দেহাভ্যন্তরস্থ ঊনপঞ্চাশ বায়ু ধীরে ধীরে এমনিতেই শৃঙ্খলায় আসবে। আর এরকমটা যদি হয়েই যায় _তাহলে আর চাই কি!! তুমি তো যোগী হয়েই গেলে!! তখন কি হবে?? __যোগলব্ধ নানান সিদ্ধি, আপনা-আপনি তোমার করায়ত্ত হবে! প্রথমে যে ঝবলা হয়েছিল “ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে”, _এতদিনে অর্থাৎ এই অবস্থায় ‘গোলে’-র মধ্যে ‘মাল’ – টিকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সত্যি সত্যিই পাওয়া যাবে!
প্রানায়াম শিক্ষার পর গুরু বললেন _বৎস! এবার বিশেষ মুদ্রা শেখো! খেচরী মুদ্রা, ব্রহ্মযোনী মুদ্রা ইত্যাদি! মুদ্রায় সিদ্ধ হলে তবে তো হবে ধ্যান! আর ধ্যান জমলে তবে তো তোমার চিত্ত শান্ত হবে! এবারে ঐ চিত্ত শান্ত হলে সমস্ত রকম ‘বিকার’ মুক্ত হবে বাছা _তুমি!
বিকার-ই তো বিশৃঙ্খলা বা ‘গোলমাল’! বিকার না থাকলে বিশৃঙ্খলা নাই, ফলে নাই কোন গোলমাল ও!
তাই সিঙ্গুরের কবিরাজ মশাই-এর বাড়ির সিটিং-এর মাষ্টারমশাইয়ের মতো আমরা বেশিরভাগেরাই সবকিছু না হোলেও অনেকখানি জানি বা বুঝি! কিন্তু সবকিছু বুঝেও শুধুমাত্র আলস্যে ‘কাজের কাজটি’ করা হয় না বলেই _’ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে’-বলে ছেড়ে দিই! ফলস্বরূপ বারবার জন্মমৃত্যুর আবর্তে ফিরে ফিরে আসা! ‘পুনরপি জনমম্ পুনরপি মরনম্ পুনরপি জননী জঠরে শয়নম্!!! (ক্রমশঃ)