শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের সিঙ্গুর তত্ত্বমসি যোগাশ্রমের ব্যবস্থাপনায় সুন্দরবন ভ্রমণের বিভিন্ন বৃত্তান্ত এখানে পরিবেশন করা হচ্ছিল। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের জম্বুদ্বীপে থাকাকালীন সময়ে কি কি ঘটেছিল সেই সব কথায় !

আমরা আগেই আলোচনা করেছিলাম যে, জম্বুদ্বীপে গুরুমহারাজ এমন একটা স্থানে বসেছিলেন – যেখানে কয়েক ঘর মেছুয়ারা বাস করতো ৷ তারা গুরুজীর কাছে উপস্থিত হয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা নিবেদন করে ৷ গুরুজী ওদের সকলের সব কথা মন দিয়ে শোনেন এবং ওদেরকে কেন্দ্র করেই সৎসঙ্গ (sitting) শুরু করে দেন ৷ কিন্তু ওনার সঙ্গের ভক্তদের মধ্যেই দু-একজনের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে – ওখান থেকে উঠে পড়েন এবং ডিঙির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ৷

তবে, ওইরকম একটা নির্জন দ্বীপে ঐ কয়েক ঘর মানুষের অপরিসীম দুঃখ-দূর্দশা ওনাকে খুবই স্পর্শ করেছিল ৷ উনি তপি-মা (পবিত্রপ্রাণা)-দের বলেছিলেন যে, ‘ঐ মানুষগুলো প্রারব্ধবশত: এইরকম দুঃখ ভোগ করছে ৷ প্রকৃত অর্থেই ওদের –’নুন আনতে পান্তা ফুরায়’! ওদের সাধারণ খাদ্যসামগ্রীরই প্রচন্ড অভাব তো বিলাস-ব্যসনের দ্রব্য পাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না ! তাছাড়া সবসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা ! সুনামী, সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদি দুর্যোগের সময় যে পরিমাণ জলোচ্ছ্বাস হয় – তাতে প্রায় দ্বীপটির স্থলভাগ ডুবে যায় ৷ তাছাড়া ওদের নৌকা (যেগুলির সাহায্যে ওরা মাছ ধরে সেগুলি শুকিয়ে রেখে বিক্রি করে এবং এইভাবেই নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে ৷

গুরুমহারাজ দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন – “এই মানুষগুলি ইচ্ছা করলে ভারতবর্ষের যে কোনো প্রান্তে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এমন স্থানে বসবাস করতেই পারতো ! সেখানে কায়িকশ্রম দিলে যা পারিশ্রমিক পাওয়া যায় – তাতে ওদের পরিবার স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারতো ৷ ওরাও নাগরিক আবহে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সুরক্ষার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে পারতো। কিন্তু ওরা যেন এই দুঃখময় জীবনকেই বেছে নিতে ভালোবেসেছে ৷– এটা দেখেই বোঝা যায় যে, প্রারব্ধ কর্মবশত:ই ওরা এই দুর্ভোগ ভোগ করছে ৷”

যাইহোক, সুন্দরবন ভ্রমণের অসাধারণ স্মৃতি নিয়ে ঐ Trip-এর ভক্তগণ একেবারে আপ্লুত ছিল ৷ কারণটা অবশ্যই সদা আনন্দময় গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের মধুর উপস্থিতি। দু-একজন ভক্তের একটু-আধটু অসহিষ্ণুতা প্রকাশের ঘটনা ছাড়া বাকি সবকিছুই খুবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছিল ৷ লঞ্চের দুইজন সারেং প্রথমবারের জন্য গুরুমহারাজকে দেখেছিল, কিন্তু দু-একটি ঘটনার পরই বুঝতে পেরেছিল যে – ইনি একজন মহাপুরুষ। ফলে তারা দক্ষ সারেং হওয়া সত্বেও এবং ওই সুন্দরবন অঞ্চলে বহুবার বা বলা যায় নিয়মিতভাবে লঞ্চ নিয়ে চলাফেরা করার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ওই সারেংরা প্রথমদিনেই বা দ্বিতীয় দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল যে, লঞ্চে অধিষ্ঠিত এই পরম রূপবান, পরম শ্রদ্ধেয়, পরমজ্ঞানী ব্যক্তিটি some one different ! ফলে তারাও গুরুমহারাজকে তাদের (অর্থাৎ সারেং-দের) গুরু হিসাবে মেনে নিয়েছিল ৷

অবশ্য অন্যত্র কথা বলার সময় গুরুমহারাজ একবার বলেছিলেন – ” জানিস তো ! এবার (পরমানন্দ লীলায়) যেহেতু আমার *গুরুভাব*– তাই আমি যখন যে fild-এ থাকি, তখন আমি সেই fild-এর অন্তর্বর্তী জনদের কাছে *গুরু* বনে যায় অর্থাৎ তারাই আমাকে তাদের *গুরু* বা নেতা বলে মেনে নেয়।” গুরুজী উদাহরণ হিসাবে যেমন হিমালয়ের বিভিন্ন পরম্পরার সাধু-সন্ত-যোগী-তান্ত্রিক-কাপালিক-অঘোরী ইত্যাদি সাধক বা সিদ্ধকুলের উল্লেখ করেছিলেন, তেমনি আবার তিনি পকেটমার, গুণ্ডা-বদমাইশদের কথাও বলেছিলেন। এমনকি তিনি বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখিরাও যে তাঁকে তাদের ‘নেতা’ বা ‘রাজা’ ভাবছে – এমন উদাহরণও দিয়েছিলেন। আসলে পরমানন্দের যেন সবই অদ্ভুত – সবই বিচিত্র – সবই মধুর ! “মধুরম্ – মধুরম্ – সকলং – মধুরম্!”

আমরা এবার ওনাদের সুন্দরবন ভ্রমণকাহিনীর ইতি টানবো, কিন্তু ফেরার শেষদিনে তৎকালীন সরকারে (বামফ্রন্ট) থাকা ব্যক্তিরা ‘বন্ধ’ ডেকেছিল (ঐসময় বন্ধ্ ব্যাপারটা প্রায়ই সংঘটিত হতো এবং স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত-দোকানপাট-যানবাহন সবই বন্ধ থাকতো৷ মানুষের চূড়ান্ত নাকাল অবস্থা হতো৷) ফলে ওনাদেরকে নামখানায় থেকে যেতে হয়েছিল ৷ আয়োজকেরা লঞ্চ দুটোকে ছেড়ে দিয়েছিল এবং তীরে কোনো ভালো জায়গা দেখে সারাদিন কাটানো এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ৷ সারাদিন গুরুসঙ্গে কাটানোর সুযোগ পেয়ে উপস্থিত ভক্তজনেরা খুবই আনন্দলাভ করেছিল ৷

সেইদিন সন্ধ্যার পর বাস (বাসদুটি আগে থাকতেই ওখানে উপস্থিত ছিল।) ছেড়েছিল এবং নিরাপদে সিঙ্গুর আশ্রমে এসে পৌঁছে গেছিলো ৷ আশ্রমের কাছাকাছি যাদের বাড়ি বা যাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুবিধা ছিল – তারা ফিরে গিয়েছিল এবং বাকিরা আশ্রমে রাত্রি কাটিয়ে নিজের নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল ৷৷