শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা এখানে আলোচনা করেছিলাম। আমরা কিছুদিন ধরে স্বামী পূর্ণানন্দ মহারাজের গুরুমহারাজ সম্পর্কিত আলোচনার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছিলাম। আজকে আমরা চলে যাবো শ্রীধরপুরের আশীষ মাস্টারমশাই (আশীষ ব্যানার্জি, বর্তমানে মেমারিতে থাকেন)-এর সাথে কথা প্রসঙ্গে গুরুমহারাজের যেসব আলোচনা হয়েছিল — সেই কথায় ৷
আশীষ মাষ্টার গুরুমহারাজের কথা বলতে খুবই ভালোবাসেন ৷ উনি সুযোগ পেলেই গুরুজীর কথা, ওনার সাথে গুরুমহারাজের কাটানো মুহূর্তগুলি অপরের সাথে শেয়ার করতে ভালোবাসেন ৷ সেইসময় গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রমে থাকলে উনি প্রায়ই বিকালের দিকে বনগ্রামে যেতেন ৷ বিকালের দিকে যেতেন মানে হোচ্ছে — যেহেতু উনি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন, তাই স্কুল ছুটি হবার পরই সাইকেল নিয়ে দে ছুট্ ! ওনার গ্রাম শ্রীধরপুরের হাইস্কুল থেকে বনগ্রাম আশ্রম রাস্তাটা কম নয়(প্রায় ১৫ কিমি) – তবু উনি ছুটে ছুটে আসতেন ভগবানের প্রেমের টানে ৷৷ অনেক সময় ওনার Colligue-রা বলতো – ” কি ব্যাপার আশীষ ! ছুটি হোতে না হোতেই তোমার ছুুটোছুটি পড়ে যায় – ব্যাপারটা কি ? কোথাও নতুন করে ভালবাসার সম্পর্ক গড়েছো নাকি ভাই ?”
আশীষ মাস্টার বলতো – ” হ্যাঁ, ভালোবাসাই তো ! নতুন নতুন ভালোবাসা – আমার যে এখন ‘নব অনুরাগের বর্ষা’ নেমেছে !” এইরকমই একদিন বিকালের সিটিং-এ আশীষ মাস্টারমশাই গেছেন এবং সিটিং-এ বসে গুরুমহারাজের কন্ঠের অমৃত ভাষণ শুনছেন, সেই সময় গুরুমহারাজ আলোচনা করছিলেন ভারতীয় ঋষিদের যোগ-উপলব্ধ নক্ষত্রবিজ্ঞান, সূর্যবিজ্ঞান, চন্দ্রবিজ্ঞান ইত্যাদি প্রসঙ্গে ! নক্ষত্রবিদ্যা-সমুদ্রবিদ্যা অধিগত করলে মানুষ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানতে পারে, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং ফল-মূল-ফসলের ফলন কেমন হবে – ইত্যাদি সবকিছুর ভবিষ্যৎ-দর্শন বা ভবিষ্যৎ-কথন‌ও করতে পারে ৷
সূর্যবিজ্ঞান যিনি জানেন – তাঁর আর কোনরূপ খাদ্যগ্রহণের প্রয়োজন হয় না ৷ তাছাড়া তাঁর মধ্যে অনন্ত শক্তির প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। চন্দ্রবিজ্ঞান যাঁর করায়ত্ত – তাঁর মধ্যে অপরূপ রূপের প্রকাশ ঘটে, তাছাড়া তাঁর মধ্যে মোহিনী শক্তি–আকর্ষণী শক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন শক্তির উপরেও অধিকার জন্মায় ৷ তাঁর যেমন নিজের মনের উপর control আসে তেমনি অন্য ব্যক্তির মনকেও উপরেও control আসে ৷ গুরুমহারাজের বিভিন্ন আলোচনা শুনে আশীষ মাস্টারমশাই খুবই impressed হয়েছিলেন। ওনার মনে হয়েছিল যে, ওই সমস্ত বিজ্ঞান গুরুমহারাজ নিজে হয়তো জানেন –কিন্তু তিনি তা কি অপরকেও শেখাতে পারেন ??!!
এইরকম একটা ভাবনা থেকে উনি sitting ভেঙে যাবার পর অপেক্ষা করেছিলেন__ কখন গুরুমহারাজ ঘরে গিয়ে একটু free হ’ন, তাহলে উনি গুরুমহারাজের সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে পারেন !
তেমন সুযোগও ঘটে গেল — উনি দেখলেন দু-একজন মানুষ (ভক্ত) গুরুমহারাজের ঘরে ঢুকছে এবং তারা তাদের প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে বেরিয়ে আসছে। সময় বুঝে আশীষ মাস্টারমশাই গুরুজীর ঘরে ঢুকে প্রনামাদি সারার পর বলে বসলেন – ” আপনি তো চন্দ্রবিজ্ঞান জানেন – সবার মনের কথাও পড়তে পারেন, তাহলে আমাকেও ওই বিদ্যা শিখিয়ে দিন !” গুরুমহারাজ একটু হেসে বলেছিলেন – ” যার ক্ষেত্রে যেটা প্রযোজ্য, আমি তাকে সেই বিদ্যা শিক্ষা করতে বলি ! মানুষের জীবনে Purpose একটাই – আর সেটা হোলো ইশ্বরলাভ ৷ বাকিগুলো তো অনুসঙ্গ ! যেমন ধরো – তুমি কোলকাতা গিয়েছিলে একটা বিশেষ purpose-এ, কিন্তু বরানগরে গিয়ে সিঙ্গারা খাবার জন্য তো আর কোলকাতা যাওনি !!!”
এইবার তো আশীষ মাস্টারমশাইয়ের হতবাক হবার পালা ! সত্যিই তো – উনি কয়েকদিন আগে সস্ত্রীক কোলকাতা গিয়েছিলেন কোনো একটা আত্মীয় বাড়িতে কোনো উৎসব উপলক্ষে ! সেখানে দু-এক দিন থাকার পর ওনার এক বন্ধুস্থানীয় আত্মীয় মাস্টারমশাইকে বলেন যে, ” বুঝলে আশীষ-দা ! বরানগরে একজায়গায় এমন ভালো সিঙ্গারা বানায় যে, – সেই সিঙ্গারা না খেলে কোলকাতা আসাই বৃথা হয়ে যায়।”
কলকাতার যে অঞ্চলে মাস্টারমশাইরা ছিলেন – সেখান থেকে বরানগর (উত্তর কলকাতা) অনেকটাই দূর ! তবু মাস্টারমশাই সেই আত্মীয়ের কথায় উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন – ” তাহলে চলো – কলকাতা সফর বৃথা করে আর কাজ নাই – ওই সিঙ্গারা একবার খেয়েই দেখি !” এই বলে ওনারা সত্যি সত্যিই বরানগরে গিয়ে – সেই বিশেষ স্থানের, বিশেষ ব্যক্তির হাতের সিঙ্গারা খেয়ে এসেছিলেন ৷
কিন্তু আশীষ মাস্টারমশাই অবাক হোলেন এই ভেবে যে, এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ কথাটি তো আর যারই জানা থাকুক না কেন – গুরুমহারাজের তো জানা উচিৎ নয় ! উনি জানলেন কি করে ?
তারপরে ওনার মনে পড়েছিল — গুরুজীর তো সবই করায়ত্ত ! ওনার মনে একটু সংশয় ছিল যে, ‘গুরুজী যে কথাগুলি বলেন – সেগুলি ওনার জীবনে অধিকৃত রয়েছে তো !’ ঐদিন গুরুমহারাজ সেই সন্দেহের-ই নিরসন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।।