গুরুমহারাজের সিটিং-এ একদিন দেবাদিদেব সদাশিব মহাদেবের সম্বন্ধে কথা হচ্ছিলো। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেছিল — ” মহাদেব শিব কি সত্যিই কোনো পুরাণ-পুরুষ – নাকি কোনো কাল্পনিক চরিত্র !” এর উত্তরে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “কোনো কল্পনাকে আশ্রয় করে কখনো কল্পনা করা যায় না ৷ যা আছে অর্থাৎ ‘অস্তি’ (বর্তমানে বিলুপ্ত হোলেও হয়তো আগে ছিল) -কে নিয়েই কল্পনা করা সম্ভব ৷ সুতরাং তুমি যে বলছো, ‘কাল্পনিক চরিত্র’ – এই ধরনের কাল্পনিক চরিত্র চিত্রায়ন করতে গেলেও কোনো না কোনো বাস্তব চরিত্রকে অনুসরণ করেই করতে হয়েছে।”
এরপর গুরুমহারাজ তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্তর্গত তিব্বতে শরীর ধারণকারী মহাযোগী সদাশিব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন ৷ যার সবটা শ্রোতা (যিনি আমাকে বলেছিলেন – নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বলে জানানো হলো না)-র স্মরণে নাই, তাই সবটা প্রকাশ করা গেল না ৷ তবে যেটুকু বললেন, তা হোলো -” তিব্বতের মহাযোগী ‘সদাশিব’, ওই অঞ্চলের তৎকালীন মানুষের বাহন ইয়াক্ (চমরী গরু)-এর পিঠে চড়ে আর্যাবর্তের বিভিন্ন স্থান, বিশেষতঃ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন ৷ উনি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গাতেও গিয়েছিলেন। তৎকালীন উত্তর ভারতের সবচাইতে শক্তিশালী নৃপতি রাজা দক্ষে-র (প্রজাপতি দক্ষ বলা হয়, কিন্তু গুরুজী বলেছিলেন – ওটা হবে ‘প্রজাপিতা’, যার অর্থ ‘রাজা’ ৷ দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর দেহত্যাগ হওয়ার পর শিবের অনুচরেরা ‘প্রজাপিতা’ বা ‘রাজা’ দক্ষের মুন্ড-কে ‘ছাগমুন্ড’ বানিয়েছিলেন ৷ এখানে গুরুমহারাজ বলেছিলেন যে, ‘ছাগমুন্ড’ কথাটির অর্থ হোলো__ ওই ঘটনার পর থেকে রাজা দক্ষের আর কোনো সম্মান ছিল না, তাঁর কথা আর কেউ শুনতো না, তাঁর কথা যেন ছাগলের ব্যা-ব্যা করে ডাকের মতো শোনাতো — তাই রূপকাকারে বলা হয়েছে ‘ছাগমুন্ড’ ৷
গুরুমহারাজ এই বিষয়ে আরো বলেছিলেন যে,আজ থেকে ১০-১২ হাজার বছর আগে বা হয়তো আরো বেশি সময় আগে সত্যি সত্যিই সদাশিব শরীর ধারণ করেছিলেন পৃথিবীতে ৷ উনি তৎকালীন অখন্ড ভারতবর্ষের মধ্যে আর্য এবং নিষাদ বা অন্যান্য যে সমস্ত রাজত্ব এবং সংস্কৃতি তখন ছিল — উনি সেইসবগুলির মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করেছিলেন ৷ তাছাড়া কৃষি, চিকিৎসা, শস্ত্রবিদ্যা, বিভিন্ন প্রকারের তন্ত্র বা আগম শাস্ত্র এবং বেদাদি নিগমশাস্ত্র ইত্যাদি অনেক কিছুর প্রবক্তা ছিলেন সাদাশিব ৷ তিনি মনুষ্যসমাজ সহ সমস্ত পশু-পাখি বা বলা চলে সমগ্র প্রাণীসমাজের মঙ্গলার্থে বহু কাজ করে গেছিলেন।
এইজন্যেই একজন শিব ভক্ত গন্ধর্ব ‘পুষ্পদন্ত’ তাঁর বিখ্যাত ‘শিবমহিম্ম স্তোত্র’-এ লিখেছিলেন – ” অসিতগিরি সমংস্যাৎ কজ্জ্বলং সিন্ধুপাত্রে, সুরতরুবরশাখা লিখনি পত্রমূর্বী ৷ লিখিতং যদি গৃহীত্মা সারদা সর্বকালং, তদপি তব গুণানাং ইশ পারং না যাতি ৷৷” এর বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়াবে – “পৃথিবীর যত কালো কালো পর্বত রয়েছে, সেগুলি যদি কালির ‘বড়ি’ হয় এবং সমুদ্রগুলি যদি কালির দোয়াত হয় (আগেকার দিনে কালির দোয়াতে কালো বা নীল রঙের ‘বড়ি’ ফেলে কালি তৈরি করে কলমের সাহায্যে লেখা হোতো।), পৃথিবীর সমগ্র বনরাজির কাঠ দিয়ে যদি লেখনি অর্থাৎ কলম তৈরি করা হয় এবং স্বয়ং মা সরস্বতী যদি লেখিকা হ’ন – তাহলেও হে শিব! তোমার মহিমা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না ৷” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শিবের মহিমার কথা বলতে গিয়ে – এক লাইনে বলেছিলেন – ” শিব গো – তোমার গুণের কথা আমি একমুখে বলতে পারবো না !”
সুতরাং এটা বোঝাই যাচ্ছে যে_ মহাদেব শিবের মহিমার কথা, গুণের কথা বলে বা লিখে বর্ণনা করা যায় না ৷ তাই এখনো পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে যত কথা বলা হয়েছে – তা সবই অপ্রতুল ! তবু আমরা এখানে ‘দেবাদিদেব মহাদেব শিব’ সম্বন্ধে যে সমস্ত কথা উল্লেখ করছি – সেগুলি গুরুমহারাজের কাছ থেকে শোনা – তাই এই ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস ৷ আজ এই পর্যন্তই থাক্ – আগামী দিনে ‘শিব’ সম্বন্ধে আরও আলোচনা হবে ৷৷