সাধারণ অর্থে ‘তুমি-তোমার’ অবস্থা বা জ্ঞানী অবস্থাকেই শিব-স্থিতি বলা হয়, যা সাধকের সাধনপথে অগ্রগতি হোতে হোতে আজ্ঞাচক্রে স্থিত হবার পরে লাভ হোতে পারে ৷ সমাজে আমরা বিদ্বান ব্যক্তি, পন্ডিত ব্যক্তি, বাগ্মী, সুলেখক, ভালো কথক – ইত্যাদি অনেককেই পাই এবং আমরা তাদের অনেককেই ‘জ্ঞানী’ বলে ভুল করি ! প্রকৃতপক্ষে ‘জ্ঞানী’ হোলেন – আজ্ঞাচক্রে স্থিত ‘সিদ্ধ’ মহামানবেরাই ৷
‘শিব’ অর্থে ‘মঙ্গল’৷ আর প্রকৃত জ্ঞানীগণই পারেন জীবজগতের অর্থাৎ সকলের, সর্বস্তরের জীবের মঙ্গল সাধন করতে ৷ সেইজন্যেই বলা হয় শিব মঙ্গলদায়ক ৷ শিবনাম করলে, শিবপূজা করলে, শিবস্তুতি পাঠ করলে মানবের মঙ্গল হয় ৷ আবার শিবকে বলা হয় ‘আশুতোষ’ – অর্থাৎ যিনি অল্পেই সন্তুষ্ট হ’ন ! শিবকে বলা হয় পশুপতি, শিবকে বলা হয় ভূতনাথ – আবার শিব হোলো দেবাদিদেব ৷ তার মানেটা দাঁড়ালো যে শিব হোচ্ছেন সবার দেবতা, সবার নাথ, সবার আরাধ্য – তা সে মানুষই হোক বা মনুষ্যেতর প্রাণী বা মনুষ্যোত্তর কিছু হোক অথবা সূক্ষ্ম বা কারণশরীরধারীই হোক__সবার দেবতা শিব ৷ শিবের গুণের বর্ণনা করতে গিয়ে পরম শিবভক্ত গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ পুষ্পদন্ত এইজন্যেই শেষ কথা বলে দিয়েছেন যে, “শিবের মহিমার কথা বর্ণনা করা যায় না”।
গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ স্বয়ং শিবস্বরূপ (আবার তিনিই হরির অবতার) হয়ে যখন শিবের কথা বলতেন – তখন তা সত্যিই আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হোতো ! মনে হোতো – আমরাও যেন তাঁর সাথে হিমালয়ের কন্দরে কন্দরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, অথবা উনি কৈলাস পর্বতের সুউচ্চ শিখরে বসে বসে সিটিং করছেন আর আমরা তাঁর পদপ্রান্তে বসে বসে শুনছি ৷
সদাশিব মহাদেব যে বিশালকায় একটি ইয়াক্-এর পিঠে চড়ে হিমালয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন – সেইকথা বলেছিলেন গুরুমহারাজ ৷ যে কৈলাস পর্বত এখনোও গোটা পৃথিবীর কাছে বিস্ময়, যে কৈলাসের কোনো অংশেই এখনোও পর্যন্ত কোনো পর্বতারোহীরা পা রাখতেও পারেনি — সেই কৈলাসেই যে সদাশিব মহাদেবের সাধনস্থল ছিল – সেকথাও উনি বলেছিলেন ৷ একদিন বিভিন্ন কথা বলতে বলতে গুরুজী বললেন যে, উনি কৈলাসের চূড়ায় গিয়ে (হয়তো সূক্ষশরীরে) সাক্ষাৎ হর-গৌরীর দর্শন করেছিলেন ! তাছাড়া সেখানে আরো যাঁরা ছিলেন – তাঁরাও (যাদেরকে শাস্ত্রে শিবানুচর বলেছে) শিবস্থিতির-ই উচ্চকোটির সাধক !
গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে আরো যা বলেছিলেন তা হোলো – হিমালয়ে (কৈলাস পর্বত সহ) মোট সাতটি এমন point রয়েছে – যেখানে শিবস্থিতির সাধক ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশাধিকারই পাবে না ! আসলে সেগুলো যেন এক-একটা বিশেষ শক্তির ক্ষেত্র বা field ! যেসব field-এ সিদ্ধযোগীরা কোনো উচ্চ-আধারসম্পন্ন সাধারণ সাধক বা সাধারণ মানুষকে নিয়ে গিয়ে, তার মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা প্রবেশ করিয়ে – তাকে দিয়ে মনুষ্যসমাজের প্রয়োজনে কিছু কাজ করিয়ে নিতে পারেন। এইসব স্থানেরই একটি স্থানকে মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের গুরুদেব স্বামী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস (গন্ধবাবা) “জ্ঞানগঞ্জ” হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন ৷
গুরুমহারাজ যা বলেছিলেন – তা থেকে আমরা এটাই বুঝেছিলাম যে, ঐসব স্থানে (হিমালয়ের সাতটি বিশেষ point-এ) স্থূলদেহধারী মানুষেরা কখনোই নিজেরা যেতে পারে না, একমাত্র যাঁরা স্থূলদেহের মায়া-মোহ অতিক্রম করে ইচ্ছামাত্রই সূক্ষ্মাবস্থায় শরীরকে নিয়ে যেতে সক্ষম – তাঁরাই ঐ স্থানগুলিতে যেতে পারেন ! ওখানে যাঁরা থাকেন তাঁরাই পৃথিবীগ্রহের ভালো-মন্দের বিশেষতঃ আধ্যাত্মিক জগতের মানুষদের নিয়ন্ত্রণের কাজটিও করে থাকেন ৷৷