শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের মুখনিঃসৃত বাণী, যা ওনার যে কোনো সিটিং-এ স্বতঃউৎসারিত নির্ঝরিণীর মতো অনবরত ঝরে পড়তো – তারই কিছু কিছু অংশ বিশেষতঃ ‘মহাদেব শিব’ সম্পর্কিত কথাগুলি এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷

গত ২০২৩ সালের প্রথমসংখ্যা চরৈবেতি (বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা)-তে দেখলাম তৃষাণ মহারাজ (স্বামী পরমেশ্বরানন্দ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট) নানাকথার মাঝে ‘শিব’ সম্পর্কিত কিছু কথা লিখেছেন – যা উনি স্বয়ং গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের শ্রীমুখ থেকে শ্রবণ করেছিলেন ৷ গুরুমহারাজের এইবারের লীলা ‘বাউলভাব’-এর লীলা ! আর বাউলগণ দেহতত্ত্ব থেকেই ঈশ্বরতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্বের উৎস খুঁজে পাওয়ার সাধনা করেন ৷ তাই ওইদিনের আলোচনায় (যেদিন তৃষাণ মহারাজ ‘শিবতত্ত্ব’ সম্বন্ধে শুনেছিলেন) গুরুমহারাজ শিবতত্ত্বকে দেহতত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করেছিলেন ৷ উনি যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হোলো এই যে, ‘ সদগুরু প্রদত্ত বীজমন্ত্র জপ-ধ্যান ও প্রাণায়াম সাধনের ফলে সাধকের কুলকুন্ডলিনী শক্তির জাগরণ ঘটে এবং সেই মহাশক্তি ঊর্ধ্বগতি লাভ করে মূলাধার থেকে যথাক্রমে স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ এগুলি অতিক্রম করে আজ্ঞাচক্রে পৌঁছায় এবং সাধনার আরো গভীরে গেলে সাধকের চেতনা সেখানে স্থায়ী হয় – তখন দেহস্থ রেতঃশক্তি ওজঃশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় ৷ এই অবস্থাতে স্বতঃপ্রনোদিত যোগ-প্রাণায়াম ক্রিয়ার নিয়মিত অভ্যাসে সাধকের মেধানাড়ী খুলে যায় এবং সাধকের আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রার পর্যন্ত উজ্জ্বল জ্যোতির প্রকাশ ঘটে ৷ ঐ জ্যোতিই প্রকৃত জ্যোতির্লিঙ্গ যা রূপকাকারে স্থুলে শিবলিঙ্গ হিসাবে পূজিত হ’ন ৷

এতদূর বলার পর গুরু মহারাজ এই বলে সিদ্ধান্ত করেছেন – ‘ তাই শিবলিঙ্গ কোনো দেবদেবীর মূর্তি নয় – এটি প্রতিটি মানবের চেতনার পূর্ণ প্রকাশের এক পূর্ণ অবস্থা।’

প্রকৃতপক্ষে বাউলমতের সারকথা – ” ভান্ডে (দেহভান্ড) ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব!” সুতরাং শিবতত্ত্বও রয়েছে দেহতত্ত্বে ! আর থাকাটাই তো স্বাভাবিক ৷ শিবতত্ত্ব, কালীতত্ত্ব, হরিতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, চৈতন্যতত্ত্ব, রামকৃষ্ণতত্ত্ব, এমনকি পরমানন্দতত্ত্বও দেহতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ৷ এইখানেই তো বাউলমত, বাউল-পথ আর সবার চাইতে এগিয়ে এবং এইজন্যেই বর্তমান যুগের যুগধর্ম হোলো – ‘বাউল মত’ ! তুমি যে কোনো ধর্মমতেরই হও না কেন – অর্থাৎ তুমি খ্রীষ্টান, মুসলমান, হিন্দু বা সনাতনী যাই হও না কেন, – মুসলমান হয়ে যদি তোমার মধ্যে খোদা, আল্লাহ বা নবী-মুহাম্মদের অনুভূতি না হয়, খ্রীস্টান হয়ে যদি তোমার মধ্যে God-এর অথবা খ্রীষ্টের অনুভূতি না হয়, হিন্দু বা সনাতনী হয়ে যদি তোমার মধ্যে ব্রহ্ম অথবা ঈশ্বরের অনুভূতি-উপলব্ধি না হয় — তাহলে তোমার ওই ধর্মাচরণ বৃথা হয়ে গেল ৷ কারণ গুরু মহারাজ বারবার বলেছেন – “ধর্মের (ধর্মমতগুলির) প্রাণ হোলো অনুভূতি ৷” অনুভূতিহীন ধর্মাচরণ নিষ্প্রাণ, নিরর্থক, অন্তঃসারশূন্য একটা নিছকই অভ্যাস মাত্র ! এই অনুভূতিহীন ধর্মাচরণই জগতে যত কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে ৷ ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোঁড়ামী, ধর্মভীরুতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, নিজের নিজের ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য সংঘাত সৃষ্টি করা, রক্তপাত ঘটানো – ইত্যাদি নানান অঘটন ঘটিয়ে থাকে ৷

যাইহোক, অনেক কথা বলা হোলো – এবার আবার ফিরে যাই গুরু মহারাজের কথায় ৷ এখন উনি ‘মহাদেব শিব’ সম্বন্ধে কথা বলছিলেন – আমরা জানবো সেইসব আলোচনায় উনি ‘শিব’ সম্বন্ধে আরও কি কি বলেছিলেন ! ‘শিব’কে বলা হয়েছে ‘ব্যোমকেশ’, বলা হয়েছে ‘ধূর্জটি’ ৷ ‘ধূর্জটি’ কথাটি এসেছে ‘ধূর’ থেকে যার অর্থ জটাভার ৷ জগতের সমস্ত চিন্তার ভার যাঁর শিরে (অর্থাৎ শিরের জটায়) – তিনিই ধূর্জটি ! আগেই বলা হয়েছিল যে, আজ্ঞাচক্রে স্থিত হোলে অর্থাৎ শিব স্থিতি লাভ করলেই সেই সাধক আর সাধারণ মানব থাকেন না, তিনিও সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ হয়ে যান এবং তখন জগতের – সমস্ত জীবজগতের কল্যাণের ভার এসে পড়ে ওই শিবস্বরূপ মহাযোগীর উপর ৷ তাইতো তিনি ‘ধূর্জটি’ !

‘শিব’ ব্যোমকেশ অর্থাৎ তাঁর জটাভার যেন উর্ধ্ব-অধ: সহ সমস্ত দিক পরিব্যপ্ত করে রেখেছে ! ব্যোম্ বা আকাশতত্ত্ব – সমস্তকিছুতে ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে। এইজন্যেই মহাদেব শিবের মূর্তিতে দেখা যায় ব্যোমকেশের জটাভার ঊর্ধদিকে প্রসারিত – যা ধরে গঙ্গার ধারা (স্বর্গের মন্দাকিনী) নিম্নদিকে প্রবাহিত হোতে পারছে ৷ ২০২৩ সালের প্রথম সংখ্যার চরৈবেতি পত্রিকায় তৃষাণ মহারাজ (স্বামী পরমেশ্বরানন্দ)-এর লেখায় ‘শিব’ সংক্রান্ত আলোচনাতেও আমরা আরও পেয়েছিলাম যে, যোগসাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলে অর্থাৎ নির্বিকল্প স্থিতিলাভ করলে মস্তিষ্ক থেকে (সহস্রার থেকে) সুধারস বা চন্দ্রবারুণী সুধা নিঃসরণ হয়। আর আমরা আগে দেখেছিলাম যে, গুরুমহারাজ আলোচনা করেছিলেন – মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গার নিম্নমুখী ধারা যেন জ্ঞানীর মধ্যে থেকে উৎসারিত প্রেমরস ! এই দুই তত্ত্বই এক – তবে তা বোধের বিষয় ৷।