আমরা সাধারণ মানুষেরা বোধহয় এইরকমই ! আর গুরুমহারাজও এইটা ভালোমতন জানতেন বলেই আমাদের সকলকে নিয়ে কি সুন্দর ভাবে ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে গেলেন ! সকলকে ভালোবাসলেন – সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করলেন ৷ ভগবান জগতের সমস্ত (ভালো-মন্দ সব) কিছুকে আকর্ষণ করেন বলেই তো উনি ‘কৃষ্ণ’, সবার সমস্ত কল্মষ হরণ করেন – তাই তো তিনি ‘হরি’ ৷ তিনি কালাকালের কর্তা – তাই তিনি মহাকাল ! আবার তিনি কালের কলন করেন – তাই তিনি ‘কালী’ ৷ তিনি-ই পরম মঙ্গলময় – তাই তিনি ‘শিব’ ৷ গুরুজীর কাছেই শুনেছিলাম – অবতার পুরুষদেরকে ‘কোনো একটি ব্যক্তি’ ভাবলে ভুল ভাবা হবে। অবতার পুরুষেরা এক একটি ব্যক্তি নন – এক একটি তত্ত্ব ! যেমন কৃষ্ণতত্ত্ব, রামতত্ত্ব, শ্রীচৈতন্যতত্ত্ব, শ্রীরামকৃষ্ণতত্ত্ব ইত্যাদি ৷ কিন্তু ওই যে গুরুমহারাজ তাঁর কবিতায় লিখলেন – “পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছি ” – তাই পূর্ব-পূর্ব অবতারতত্ত্বের সমস্ত কিছুই স্বামী পরমানন্দতত্ত্বে প্রচ্ছন্ন বা প্রকটরূপে প্রকাশিত ছিল ৷ আর শুধু অবতারতত্ত্ব-সকলই নয়, সমস্ত মহাত্মা-মহাপুরুষদের তত্ত্বও তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল।
এই সেদিন কথা হচ্ছিলো ‘শ্রুতি’-র লেখক বা সংকলক রমেন বাবুর (চক্রবর্তী) সাথে ! নানান কথার মাঝে (প্রায় সবকথাই গুরুমহারাজ ও বনগ্রাম আশ্রম সম্পর্কিত) উনি ওনার চাকরি করাকালীন রাঁচি রোডের (বর্তমান ঝাড়খন্ড) কোয়ার্টারে গুরুমহারাজ যখন যেতেন – সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন ৷ বিভিন্ন কথার মাঝে এসে গেল গুরুমহারাজের যে দুটি ইসলামীয় রীতির পোশাকে থাকা অবস্থার চিত্র পাওয়া যায় – সেই চিত্র দুটি কখন ও কিভাবে তোলা হয়েছিল, সেই কথায় ! রমেনবাবু বলেছিলেন যে, ওনার রাঁচি রোডের কোয়ার্টারে তখন যে কজন পরমানন্দ অনুরাগী (ওই অঞ্চলে বসবাসকারী) ছিল, তার মধ্যে ওনার কোম্পানির গাড়ির ড্রাইভার-কাম-মেকানিক একটি মুসলমান ছেলেও ছিল ৷ ছেলেটির নাম ছিল কামালউদ্দিন৷
গুরুমহারাজ রাঁচি রোডের বাড়িতে এসেছেন খবর পেলেই ওই ছেলেটি হাজির হতো। সেইদিন বাইরের লোক বিশেষ কেউ ছিল না, রমেনবাবুর স্ত্রীও সকালের দিকে গুরুমহারাজের দেখভাল, ছেলে-মেয়েদের খাবার তৈরি করা, তাদেরকে স্কুলে পাঠানো – এইসব নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতেন। রমেনবাবুরও দশটা-পাঁচটা অফিস ছিল – তাই তিনিও সবসময় গুরুজীর কাছে থাকতে পারতেন না, সময়-সুযোগ বুঝে গুরুমহারাজের সান্নিধ্যে আসতে পারতেন। তবে সকালে কিছুটা সময় এবং সন্ধ্যের পর পুরোটাই উনি গুরু-সঙ্গে কাটাতে পারতেন ৷
যাইহোক, সেদিন ঐ মুসলিম ছেলেটি(কামালউদ্দিন) গুরুজীর কাছে একাই বসেছিল এবং এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করছিল ৷ নিশ্চয়ই ইসলাম ধর্মের অবশ্যপালনীয় বিষয়সমূহ নিয়েই কথা হচ্ছিলো। হঠাৎ করে গুরুমহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) নিজের রুমালটা মাথায় সুন্দরভাবে টুপির মতো পড়ে নিয়ে খাট থেকে নেমে কিভাবে সেজদা দিতে হয়, কিভাবে নামাজ পড়তে হয় – তার সমস্ত রকম মুদ্রা যথাযথভাবে ওই ছেলেটিকে শেখাতে শুরু করে দিলেন। খুব সম্ভবতঃ উনি ওই মেকানিক ভদ্রলোককে আল-কোরআনের বিভিন্ন আয়াত সহ প্রথম কলমা অর্থাৎ “লা ইলাহা ……..মোহাম্মদ রসুল উল্ লা !” -এটিরও হিন্দি তর্জমা (যেহেতু ওই ভদ্রলোক হিন্দিভাষী ছিল) করে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ৷ সেই ভদ্রলোকও এরপর থেকে গুরুজীর খুবই ভক্ত হয়ে গেছিলো। আর ঠিক সেইসময়েই রমেনবাবুর বাড়ির কেউ হয়তো গুরুজীর দুটি ছবি তুলে রেখেছিলেন – যেগুলি রমেনবাবুর ‘শ্রুতি’ পুস্তকে আমরা প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম ৷ এখন অবশ্য ওই ছবি দুটি নেট ঘাঁটলেই খুঁজে পাওয়া যায় ৷
যাইহোক, যে কথা বলতে এতো কথা বলা হোলো – গুরুমহারাজের (স্বামী পরমানন্দের) মধ্যেই পূর্ব-পূর্ব সমস্ত মহাত্মা-মহাপুরুষ-অবতার পুরুষদের তত্ত্ব নিহিত ছিল ৷ আর এইটাই মহাজাগতিক নিয়ম ! যেমন স্বামী বিবেকানন্দ ‘শ্রীরামকৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে’ – ঠাকুরকে “অবতার বরিষ্ঠায়” বলে উল্লেখ করেছেন এবং এর ব্যাখ্যায় উনি বলেছেন – “পূর্ব-পূর্ব অবতারগণের সমস্ত প্রকার গুণ ও শক্তি শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারে পূর্ণরূপে বিরাজিত ছিল” -এইটাই সঠিক ৷ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণই চৈতন্য মহাপ্রভুর উত্তর শরীর কি না – এই নিয়ে বর্তমানে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে, কিন্তু তা চরম অজ্ঞানতা-প্রসূত ৷ তৎকালীন যুগেও বড় বড় বৈষ্ণব ধর্মাচার্যগণ ঠাকুরের বিরোধ করেছিলেন – কিন্তু ব্রাহ্মণী যোগেশ্বরী ভৈরবী পন্ডিতের সভা ডেকে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, ‘ঠাকুর স্বয়ং ঈশ্বরের অবতার’ এবং উনি ঘোষণা করেছিলেন – “এবার নিত্যানন্দের খোলে চৈতন্য অবতার !” তৎকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কালনার ভগবানদাস বাবাজী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে “চৈতন্যের অবতার” বলে মেনে নিয়েছিলেন। আর এবারকার ভগবৎ-লীলায় স্বামী পরমানন্দ হোলেন _”স্বামী বিবেকানন্দের খোলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অবতার” ৷৷