ঐ আলোচনায় বারবার একটা কথা এসেছে – সেটা হোলো ‘পরমশিব’ । সাধনার দ্বারা আজ্ঞাচক্রে ভেদ করতে পারলেই অর্থাৎ রুদ্রগ্রন্থি পার হোতে পারলেই সাধক ‘শিবস্থিতি’ লাভ করে কিন্তু এরপরের যাত্রায় যখন কুন্ডলিনী শক্তি সহস্রার চক্রে প্রবেশ করে – তখনই কুলকুণ্ডলিনী পরমশিবের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়, ফলে অমৃতধারা বিগলিত হয় এবং সুধাবর্ষণ হোতে থাকে । এই সুধার ধারায় ওই মহাসাধক যেমন সিঞ্চিত হয়ে পরমানন্দ সাগরে নিমজ্জিত হয় – তেমনি ওই ধারায় জীবকুলও স্নাত হয়। ওই ধারাই রূপকাকারে শিবের মস্তকোপরি গঙ্গা, যার উৎস স্বর্গস্থিত মন্দাকিনী (চিত্রে দেখানো হয়ে থাকে যে, ওই ধারা ঊর্ধ্বলোক থেকে মহাদেবের জটায় এসে পড়ছে এবং সেখান থেকে নিম্নদিকে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে।) ৷ এই ধারা-ই ওই ‘পরমশিবে’ স্থিতিপ্রাপ্ত মহাযোগী মহাপুরুষদের (বিশেষতঃ অবতার পুরুষদের) করুণাধারা-প্রেমের ধারা-মহাশক্তির ধারা !
ওই ধারার কোন ক্ষয় নাই – এটি অক্ষয় ধারা! এইজন্যেই চিত্রাকারে বোঝানো হয়েছে যে, ওই ধারার সুধারাশি উর্ধ্বলোক থেকে শিবের মস্তকোপরি সদাসর্বদা যুগিয়ে যাচ্ছে এবং তা স্বতঃই নিম্নদিকে প্রবাহিত হোচ্ছে ৷ এইটাই গুরুমহারাজ অন্যত্র একটু অন্যভাবে বলেছিলেন – ” অবতার পুরুষের কৃপাশক্তি-করুনাশক্তির শেষ হয় না ৷ তাঁরা যখন অবতরণ করেন, তখন সমগ্র জগতের কল্যাণসাধন করার জন্যই আসেন। একজন অবতার পুরুষকে দেখতে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো হোলেও সেই স্থূলশরীরটাকে কেন্দ্র করে চলে মহাশক্তির খেলা ৷ এটা যেন মহাসমুদ্রের সাথে খাল কেটে সংযুক্ত করা ডোবা ; দেখতে ক্ষুদ্র হোলেও তাতেই খেলে জোয়ার-ভাটা ! তার জল যতই সেচে ফেলো – কখনোই কমবে না, যে কে সেই ! গুরুমহারাজ নিজের সম্বন্ধেও সেই কথাই বলতেন – ” সারাদিন বহু লোকের সঙ্গ করে, বিভিন্ন সংস্কারবিশিষ্ট মানুষকে দীক্ষা দিয়ে – এক এক সময় আমার শরীর যেন নেতিয়ে পড়তো, মনে হোতো আমার সব শক্তি শেষ – আমার শরীর বোধহয় পাত হয়ে যাবে ৷ কিন্তু রাত্রি বারোটার পর মহাপ্রকৃতির শক্তি আবার হু-হু করে এই শরীরটায় ঢুকে পড়তো ৷ তখন বুঝতে পারতাম_ মা জগদম্বার এই শরীরটাকে নিয়ে আরো কিছু লীলা বাকি রয়েছে
৷”
আগের দিনে কথা হোচ্ছিলো – প্রলয়ের নটরাজ অর্থাৎ লয়কারী শিবকে নিয়ে ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” ‘ওঁ’ নাদে এই জগৎসংসার সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং ‘ব্যোম্’ ‘ব্যোম্’ নাদে আবার জগৎসংসারের লয় হয় ৷ এইজন্যেই শিবের নাদ ‘ব্যোম্’-‘ব্যোম্’ ৷ দেখবেন শিবভক্তরা বলে থাকে – ‘ব্যোম্ ভোলে’! বর্তমানের জড়বিজ্ঞানীরা (কণাবিজ্ঞানী থেকে মহাকাশবিজ্ঞানী)-ও দেখেছেন যে বস্তু থেকে শক্তি বা শক্তি থেকে বস্তুর রূপান্তরের তত্ত্ব (সৃষ্টিতত্ত্ব) একরকম, আবার বস্তু বা শক্তি যখন শূন্যে পরিণত হোচ্ছে বা black-hole -এ প্রবেশ করছে – তখন অন্য তত্ত্ব ! মহাকালী যেন বিরাট হাঁ-এর মধ্যে তার সামনে যা আসছে – তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ৷ এখনো black-hole বিজ্ঞানীদের কাছে বিস্ময় ! এখনো এর সঠিক ব্যাখ্যা বা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা জড়বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন নি ৷
কিন্তু বহু পূর্বে ভারতীয় ঋষিগণ-মনীষীগণ মহাকালী ও মহাকাল তত্ত্বের কথা উল্লেখ করে গেছেন ৷ বলেছেন প্রলয়ের নটরাজের তাণ্ডব নৃত্যের কথা ৷ এখনো U.S.A-এর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষণাগার NASA-য় নটরাজ মূর্তি সযত্নে রক্ষিত রয়েছে ৷ সামান্য একটু পরমাণুর মধ্যে যে ভয়ংকর ধ্বংসের বীজ লুক্কায়িত রয়েছে এবং সেই ধ্বংসের সময়কালীন যে গ্রাফিক্যাল চিত্র পাওয়া যায়, তাই দিয়ে প্রলয়ের নটরাজের dancing mood (তান্ডব)-এর মূর্তির ব্যাখ্যার সুন্দর সাদৃশ্য পাওয়া যায় ৷
নটরাজের ছয়টি বাহু ভিন্ন ভিন্ন দিকে ও বিভিন্নভাবে প্রসারিত ৷ এই ছয়টি বাহু – জড় বিজ্ঞানের ছয়টি বলের রূপক। যেগুলি হলো – centripetal force, centrifugal force, electromagnetic force, gravitational force, strong force এবং weak force ! নটরাজের দুই পায়ের নৃত্যের ভঙ্গিমা পদার্থ বা শক্তির অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা ও ছন্দবদ্ধতার প্রকাশ ৷ নটরাজের পায়ের তলায় মহাকাল শায়িত ৷ এখানে মহাকাল static এবং নটরাজ dynamic ! স্থূলতঃ সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সবকিছুই মহাকালের বুকেই সংঘটিত হয়ে চলেছে – মহাকাল শুধু দ্রষ্টা মাত্র ৷
গুরুমহারাজের শ্রীমুখ থেকে শুনে আমাদের বনগ্রাম আশ্রমের একজন সন্ন্যাসী মিহির মহারাজ (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) ‘মহাকালের তাণ্ডব’ নিয়ে আশ্রমের মাসিক পত্রিকা চরৈবেতিতে একটা article লিখেছিলেন ৷ এখানে উনি নটরাজ মূর্তির আরও বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন ৷ উৎসাহী পাঠকবৃন্দ একটু খোঁজ করে ওই প্রবন্ধটি পাঠ করলে গুরুমহারাজের করা এই সংক্রান্ত ব্যাখ্যার কথা আরো ভালোভাবে জানতে পারবেন ৷৷