গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের সূচনা করেছিলেন ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে । আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ইহলীলা সংবরণ করেন ১৮৮৬ সালের আগষ্ট মাসে ৷ তার মানে কিছু কম ১০০ বছর বা প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে-ই স্বামী পরমানন্দের লীলা শুরু হয়েছিল ৷ উনি প্রায়ই বলতেন – ” একই লীলা কখনই দুবার হয় না।” হবার কথাও নয় – ১০০ বছরের ব্যাবধানে শুধু যে গঙ্গা দিয়ে বিপুল বিশাল পরিমাণ জলরাশি প্রবাহিত হয়ে চলে যায় তাই নয় – প্রকৃতিতে , পরিবেশে , মনুষ্য সমাজে , মানুষের মনোজগতে অনেক কিছু পরিবর্ত্তনও হয়ে যায় ! তাই যুগপ্রয়োজনে যুগপুরুষ যখনই আসেন – তখন তিনি সেইযুগের উপযোগী করে (পুরাতন সত্যকেই) কথা বলেন । সেগুলি শুনে মনে হয় – ” আরে ! এগুলি তো নতুন কথা ! আগে তো কখনও শুনিনি ! এর আগে কোন মহাপুরুষ তো এমনি করে কথা বলেনি ?” প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তা নয়, সত্য তো সত্যই! সত্যই ব্রহ্ম! আর ওনারা(মহাপুরুষেরা) ব্রহ্ম-কেই ব্যাখ্যা করেন। শূধু স্থান – কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন আঙ্গিকে _এই যা বৈচিত্র্য!! বিভেদ নাই _শুধুই বৈচিত্র্য!!
স্বামী বিবেকানন্দ যে যুগে (যে কালে বা সময়ে) , যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন — তখনকার মানুষের কাছে সে সবই ছিল একদম নতুন কথা , নতুন আঙ্গিকে বলা কথা ! গোটা বিশ্ব হেলে গিয়েছিল তাঁর চমকপ্রদ বক্তব্য শুনে ! এখন স্বামীজীর প্রস্থানের প্রায় ৮০ বছর পরে স্বামী পরমানন্দ যখন কথা বললেন – তখন আবার নতুন অাঙ্গিক , মনে হ’ল যেন নতুন কথা !
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সরাসরি কাউকে ব্রহ্মচর্য্য সংস্কার করে যাননি , কিন্তু ত্যাগী ভক্তরা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল , কারণ ঐ ছেলেগুলি বাড়ীঘর ত্যাগ করে দক্ষিণেশ্বরেই পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে দিয়েছিল (বারোখন্ড গেরূয়া কাপড়ও দিয়ে গিয়েছিলেন)। সেই সব ত্যাগী ভক্তদের ঠাকুর আলাদা করে ত্যাগের শিক্ষা দিতেন ৷ ওদেরকে শিক্ষাদানের সময় বলতেন – “স্ত্রীলোকের মুখ তো দূরের কথা স্ত্রীলোকের ‘পট'(ছবি)-ও দেখবি না” ! ” রাস্তা দিয়ে যখন যাবি , পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে নজর দিয়ে চলবি”। ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত গোপাল-মা বা গোলাপ-মা তখন বৃদ্ধ হয়েছেন , বলা যায় অতিবৃদ্ধ হয়েছেন । তখন উনি সব দিন দক্ষিণেশ্বরে আসতে পারতেন না (উনি ঠাকুরেরই নির্দেশে দক্ষিণেশ্বর থেকে সামান্য একটু দূরে গঙ্গার ধারে একটি কুঠিয়ায় থাকতেন এবং গোপাল সাধনা করতেন) । কিন্তু উনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে অর্থাৎ ওনার জীবন্ত গোপালকে নিজের হাতে কিছু না কিছু মিষ্টি তৈরী করে বা রান্না করে খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন ।
যাইহোক, বৃদ্ধ বয়সে যখন উনি আর সবদিন দক্ষিণেশ্বরে আসতে পারতেন না (ঠাকুরের নিষেধও ছিল)– তখন উনি ঠাকুরের কাছে থাকা ত্যাগী ছেলেদের হাত দিয়ে অনেক সময় কিছু কিছু খাবার বা মিষ্টি পাঠিয়ে দিতেন ৷ তখন দক্ষিণেশ্বর থেকে যারা(ত্যাগী ভক্তরা) কোন কাজে কোলকাতা যেতো বা বাজারে যেতো – তারা অনেকেই গঙ্গার তীরে গোপাল-মার কুঠিয়ায় যেতো । গোপাল-মা সেই ছেলেদেরকেও ‘গোপাল’ জ্ঞানে কিছু খাওয়াতো ! এই কথাটি কানে যেতেই ঠাকুর একেবারে লাফিয়ে উঠলেন ; সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদেরকে ডেকে পাঠিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়ে দিলেন – “অমুক আর অমুক” ছাড়া (দুজন ওদের মধ্যে বয়স্ক) তোরা আর কেউ ওখানে যাবি না ! কেউ হয়তো মৃদু প্রতিবাদ করেছিল – ” কিন্তু , উনি তো বৃদ্ধা! মায়ের মতো !” ঠাকুরের কড়া হুকুম – ” তাও না !”
এবার আসি স্বামী পরমানন্দের কথায়! – ১০০ বছর অতিক্রান্ত ! গুরু মহারাজ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই ত্যাগী ছেলেরা (ব্রহ্মচারী) যেমন এসে গেল – তেমনি ত্যাগী মেয়েরাও (ব্রহ্মচারীনী) অাসতে শুরু করল ! আশ্রমের কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন Department আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করল । রান্নাঘর , চরৈবেতি কার্য্যালয় , অনাথ-আশ্রমের দুটো শাখা (প্রথম শ্রেণী থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত একটা এবং সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আর একটা) প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী বিদ্যালয় , ডাক্তারখানা (পরবর্ত্তীতে হসপিটাল) , ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ইত্যাদি অনেক শাখা হ’ল আশ্রমের । প্রতিটি শাখাতেই গুরু মহারাজ কোন না কোন সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীদের মাথায় রাখলেন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিটি Department-এ appiontment দিলেন ঐ ত্যাগী ব্রহ্মচারিণী বা সন্ন্যাসীনীদের কেও !
তৎকালীন বয়স্ক আশ্রমের হিতৈষী যারা ছিলেন তারা সকলে একবাক্যে গুরুমহারাজকে নিষেধ করেছিলেন – “গুরুজী ! এটা কি করছেন ? সর্বনাশ হয়ে যাবে যে !” গুরু মহারাজ স্থির এবং অটল থেকে বলেছিলেন – “এবার এটা আমার একটা experiment ! দেখা যাক্ না কি হয় ! দু-একটার যদি এদিক-ওদিক হয় তো হোক ! সে আমি ঠিক সামলে নেব ।”
একবিংশ শতকের ভগবান, আধুনিকতম মহাপুরুষ স্বামী পরমানন্দ, এখনকার ব্রহ্মচারী – সন্ন্যাসীদের কতটা _কত বেশিটা- এগিয়ে নিয়ে এলেন!!! কত বড় করে দিয়ে গেলেন তাদের! বর্তমানের সাধু-সন্তদের কত দায়িত্ব বাড়িয়ে দিলেন!! প্রকৃতির মধ্যে থেকেই প্রকৃতিকে অতিক্রম করতে হয় _এটাই ক্রম! কোন কিছুকে ভয় পাওয়া, এড়িয়ে যাওয়া, ঘৃনা করা মানেই হচ্ছে _সেই বিষয়কে আরও বেশি বেশি করে পাত্তা দেওয়া, তার প্রতি দূর্বলতা প্রদর্শন!!
তাই নারী – পুরুষ দুজনে একসাথে পাশাপাশি থেকে, ভগবানের কাজ করবে , এগিয়ে চলবে উত্তরনের পথে _এ বড় নবীন ব্যবস্থা, বড় উত্তম ব্যবস্থা! !!
বাউল-বৈষ্ণব দের মধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে কিছু এই ধরনের সাধন-পদ্ধতি চালু রয়েছে, কিন্তু স্বামী পরমানন্দ এবারে যেন সব কিছুকেই নিয়ে এসেছেন একবারে সামনের সারিতে, প্রকাশ্যে!!
ধন্য ধন্য হে যুগপুরুষ পরমানন্দ! তোমাকে বারবার নমস্কার, ভুলুন্ঠিত প্রনাম!!
সবসময়ই তাঁকে প্রনাম করছি _কিন্তু এখন আবার আলাদা করে কেন??
কারন ভগবান পরমানন্দ যে করুনাময়! কৃপাময়! আবার ভগবানত্বের মহিমায় মহিমময়!!!!
গুরুমহারাজ সেই ব্রহ্মচারী দের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন _” পড়ুক না! কোথায় পড়বে? মানুষ পড়লে তো মাটিতেই পড়ে!! দেখবে যারা মাটিতে পড়ে _তারা আবার মাটিকে ধরেই উপরে উঠে আসে!এই পড়া-কে আমি পতন বলি না!”
সুতরাং _যে যে যেখানে পড়েছে, তার সেখান থেকেই উঠে আসার অন্তত একটা সূযোগ সে পাবেই-_চিন্তার কোন কারণ নেই!
সর্বোপরি স্বামী পরমানন্দের অভয় হস্ত সবসময় আমাদের সকলের মাথার উপর, মাথার সামনে, পিছনে _সব জায়গায় রয়েছে। ওনার দিকে পিছন হয়ে আছি _তাই ভাবছি – উনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না!! একবার সামনাসামনি হলেই প্রকৃত ব্যাপার টা দেখতে পাওয়া যেতো!
উনি সিটিং-এ কতবার বলেছেন _ “জানিস! এই সিটিং-এ বসে দেখি অনেকে ধ্যান করছে! আমি তাদেরকে বলি__ বাড়িতে এমনি করে ধ্যান করবি-এখানে নয়! এখানে চোখ খুলেই বস _ধ্যানের গভীরতায় যাকে প্রত্যক্ষ করবি, সে তো তোর চোখের সামনে বসেই রয়েছে!!”
আর কতকাল যে আমরা নিজেরাই নিজেদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবো!! ততদিনই রাখবো_যতদিন না আমাদের মধ্যে পূর্ণত্বের বোধ আসছে! এ এক জ্বালা! আধ্যাত্মিক জ্বালা!ঐ যে গুরুমহারাজ বলেছিলেন _” পূর্ণই অপূর্ণত্বের জ্বালা বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে পূর্ণত্বের দিকে!”(ক্রমশঃ)