শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা আগের দিন ছিলাম নানু মহারাজ (স্বামী নির্বেদানন্দ)-এর সাথে গুরু মহারাজের যে সব একান্ত কথা হয়েছিল – সেই আলোচলায় ৷ আমরা দেখেছিলাম যে, গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রমের (অনাথ বালক ভবনের) ছেলেদেরকে বারো(১২) বার করে ‘গায়ত্রী’ (সাবিত্রী মন্ত্র, গায়ত্রী ছন্দ) জপ করতে বলেছিলেন ৷

এখানে একটা আলোচনা করা যেতেই পারে, আর সেটা হোলো – আমাদের ( পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া অঞ্চলে আমাদের বাড়ি) যখন উপনয়ন বা উপবীত সংস্কার হয়েছিল – তখন যিনি আচার্য ছিলেন অর্থাৎ যিনি আমাদেরকে গায়ত্রী ত্রিসন্ধ্যা করাতেন, তিনি বলেছিলেন ‘দশ’বার জপ করতে এবং তিনি বিভিন্ন আঙুলের পাব(পর্ব)গুলির বিশেষ বিশেষ অংশে বুড়ো আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে দশবার কিভাবে গুনতে হয় তা শিখিয়ে দিয়েছিলেন ৷ সুতরাং নানু মহারাজ (স্বামী নির্বেদানন্দ)-এর কাছ থেকে গুরু মহারাজের ১২ বার গায়ত্রী উচ্চারণ করার বিধির নির্দেশ শুনে সত্যি সত্যিই যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হয়েছিলাম !! আমাদের সমাজে পুরোহিত বা পন্ডিতগুলোর শিক্ষায় কতো গলদ ঢুকে গেছে – তাই না !

এইসব ভাবনার মাঝেই মনে পড়ে গেল – গুরু মহারাজের কথা ! উনি বলেছিলেন – “ভারতবর্ষে এই যে প্রায় এক হাজার বছর ধরে বিদেশি শাসন কায়েম হয়েছিল – এটাতেই ভারতীয় সংস্কৃতির বারোটা বেজে গেছে !” ভারতীয় আহার-বিহার, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ ইত্যাদি সবকিছুরই বদল হয়ে গেছে ৷ আর এটা হয়েছে শুধুমাত্র উপযুক্ত আচার্যের অভাবে ৷ গুরুমহারাজ আরো বলেছিলেন – “মানব শরীরের ন্যায় সমাজ শরীরেরও চারটি ভাগ রয়েছে _ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ৷ মানব শরীরের ব্রাহ্মণ হোলো মস্তিষ্ক ভাগ এবং সমাজ শরীরের ব্রাহ্মণকুল হোলো – শিক্ষক, বিজ্ঞানী, আচার্য্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-ব্যারিস্টার, ঋষি-মুনি প্রমুখরা ৷ মানবশরীরের ক্ষত্রিয় হোলো বাহুদ্বয় এবং সমাজ শরীরের ক্ষত্রিয় হোলো — সেনাবাহিনী, দেশপ্রেমিক, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ইত্যাদি ব্যক্তিগণ ৷ মানব শরীরের ‘বৈশ্য’ হোলো– বক্ষ ও উদর অংশ, আর সমাজ শরীরের ‘বৈশ্য’ হোলো– ব্যবসায়ীগণ, কৃষিজীবীগণ, এছাড়াও বিভিন্ন field-এ কিছু না কিছু উৎপাদনকারী ব্যক্তিগণ ৷ আর সর্বশেষ ভাগ হোলো শূদ্র শ্রেণী, মানব শরীরে এটা হোলো পদদ্বয় – যা সমগ্র দেহকে ধারণ করে রাখে ৷ আর সমাজশরীরে শূদ্রশ্রেণী হোলো — শ্রমজীবী মানুষেরা, যারা বাকি শ্রেনীগুলিকে বা সমগ্র মানবসমাজকে ধরে রয়েছে ৷

এখানে সেই অর্থে ছোট-বড় কেউই নয়, সবাই একই শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ বিশেষ এবং সবাই স্ব – স্ব ক্ষেত্রে খুবই important ! মানবশরীরের যে কোনো স্থানে আঘাত লাগলেই তার ব্যাথা সমস্ত শরীরে সমানভাবে অনুভূত হয় ৷ সমাজ শরীরেও এমনটাই হওয়া উচিত অর্থাৎ যে কোনো এক শ্রেণীর ব্যাথায় সকলের ব্যথিত হ‌ওয়া উচিত- কিন্তু ছোটো-বড়, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য, উচ্চ-নিচ ইত্যাদি নানান ভাগে সমাজের সদস্যরা বিভক্ত হওয়ায় যতকিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে ৷ মানবশরীরে কিন্তু দেখা যায়_ মস্তিষ্ক যখন আঘাতপ্রাপ্ত হবার উপক্রম হয় – তখন বাহুদ্বয় automatically উপরে উঠে গিয়ে মস্তিষ্ককে বাঁচানোর জন্য উদ্যত হয়, বাহুদ্বয় আঘাতপ্রাপ্ত হবে জেনেও কিন্তু তারা উঠে যায় ৷ ঠিক তেমনি সমাজ শরীরের মাথা অর্থাৎ সেই সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্ম ইত্যাদির ধারক-বাহক-রক্ষক ব্রাহ্মণকুলের (শিক্ষক, আচার্য্য, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, মুনি-ঋষি ইত্যাদির উপর) উপর আঘাত নেমে আসে – তখন সমাজের বা দেশের ক্ষত্রিয়শ্রেণী দেশের ধর্ম-সংস্কৃতি-আচার্য্যকুলকে রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে – প্রয়োজনে মৃত্যুও বরণ করতে পারে ৷ যেমন দুটি হাত মাথা বাঁচাতে আপনা-আপনিই উঠে গিয়ে কাটাও যেতে পারে ৷

ভারতবর্ষে বিদেশী আক্রমণের সময় এটাই হয়েছিল ৷ ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ-সংস্কৃতি-ধর্মাচরণ-ঋষি-মুনিদের জীবন যখন সংকটে ছিল, তখন ভারতীয় ক্ষত্রিয়কুল এগুলি রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে ৷ জৈন প্রভাবে বা কিছুটা বৌদ্ধদের‌ও অহিংস নীতির প্রভাবে – তৎকালীন ক্ষত্রিয়কুলের মধ্যে শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনের চেয়ে ক্ষমাপ্রদর্শন, দয়া দেখানো, অহিংসনীতির প্রয়োগ ঘটানো — এইগুলির প্রভাব খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল । অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় _ক্ষাত্রশক্তির দুর্বলতাই বিদেশীদের এই দেশে স্থায়ী শাসন কায়েম করতে সাহায্য করেছিল ৷ যাইহোক, গুরুমহারাজ এইবার বললেন – ” যখন কোনো মানবের হাত দুটো কাটা পড়ে যায়, সেই শরীরের মাথাকে রক্ষা করার জন্য মাথা নিজেই তখন বুক ও পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকে এবং পিঠ দিয়ে আঘাত সহ্য করে থাকে ৷

বিদেশীদের এদেশে স্থায়ীভাবে শাসনাধীন সময়ে এটাই হয়েছিল। ভারতবর্ষের জ্ঞানী মানুষেরা–ঋষি-মুনিরা তাদের ধর্মগ্রন্থাদি, তাদের যাবতীয় শিক্ষার ফসল নিয়ে হিমালয় বা যে কোনো গিরি-গুহায় অথবা দুর্গম অরণ্যে চলে গিয়েছিল ৷ এ যেন মস্তিষ্কের বুকে বা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া ৷ ভারতীয় সনাতন শিক্ষাদানের উপযুক্ত আচার্য্যকুল কিভাবে সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল – এই হোলো তার আসল কাহিনী, এই হোলো তার ইতিহাস !

কিন্তু দুঃখ করার কিছু নাই। বিদেশীরা ভারতবর্ষের বহু ধর্মগ্রন্থ-পাঁজি-পুঁথি পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল অথবা জাহাজ ভর্তি করে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল – একথা সত্য ৷ তবুও এখনো বিভিন্ন গিরি-গুহার অভ্যন্তরে, মহাত্মা-মহাপুরুষদের পরম্পরায় সমস্ত শিক্ষাই এখনো বিদ্যমান।

ভারতীয় সমাজে
ক্ষাত্রশক্তি যখনই পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠবে – তখনই মাথা স্বমহিমায় উঁচুতে অবস্থান করবে, তখনই “ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ৷”