শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ গুরুমহারাজের সাথে নানু মহারাজের কিছু ব্যক্তিগত কথার প্রেক্ষিতে এইসব প্রসঙ্গ এসে গেছে। যাই হোক, ওনার আলোচনা থেকে শ্রীমদ্ভাগবত গীতার বর্ণিত “চতুর্বণং ময়াসৃষ্ট” – এই কথার practical রূপ সম্বন্ধে আগের এপিসোডে কিছুটা বলা হয়েছিল ৷ তবে এখানে ‘কিছুটা’ বলা হোলো কেন ? এর কারণ আমাদের মূল আলোচনার প্রয়োজনে যেটুকু প্রয়োজন – সেইটুকুই আলোচনা করা হয়েছে ৷

আমাদের এই প্রসঙ্গে আলোচনা ছিল যে– সুপ্রাচীনকাল থেকে সুসভ্য, আধ্যাত্মিকতায় উন্নত, পরাজ্ঞানের জ্যোতিতে ভাস্বর যে দেশ ভারতবর্ষ, সেই দেশের বর্তমানে এতো দুরবস্থা কেন ? সুপ্রাচীন-সুউন্নত ভারতবর্ষের সেই শিক্ষা বর্তমানে নাই কেন ?

এইসব কথার উত্তরে গুরুমহারাজ যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হোলো যে, বিদেশী আক্রমণের সময় ভারতবর্ষের ক্ষাত্রশক্তি নানা কারণে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল – সেই সুযোগেই তারা এই দেশে ঢুকতে পেরেছিল এবং এইভাবেই ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি, ধর্মাচরণের পদ্ধতি, বৈদিক বা ঔপনিষদিক শিক্ষার উপর আঘাত নেমে এসেছিল ৷ আর এই আঘাত থেকে বাঁচতে তৎকালীন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা, সাধু-মহাত্মারা, মুনি-ঋষিরা ভারতবর্ষের বহুকালের পরম্পরাগত সাধনার ফসল-সমূহকে তাদের মস্তিষ্কে এবং পুঁথি বা গ্রন্থের আকারে সঞ্চয় করে বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে (গিরি-গুহা-অরণ্য) চলে গিয়েছিলেন ৷৷

স্বামী বিবেকানন্দের মতো মহাশক্তিশালী মহাপুরুষের আগমনের পর থেকে ভারতবর্ষের ক্ষাত্রশক্তি পুনরায় জেগে উঠতে শুরু করেছে ৷ আর সেইজন্যই ব্রাহ্মণ্য শক্তি (ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতি, সনাতন ধর্মের শিক্ষা, ঋষিদের বোধ-সঞ্জাত উপনিষদের জ্ঞান ইত্যাদির প্রকাশক ও প্রচারক) বা আচার্য্যকুল(যারা উপরিউক্ত মহাপুরুষগণের পরম্পরা) পুনরায় সমাজে কাজ করতে শুরু করেছেন ৷ ফলে বর্তমানে ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটা আধ্যাত্মিকতার নবজাগরণের সূচনা হয়েছে। আর আমরা যারা এখনকার লোক – তারা এটা প্রত্যক্ষও করছি ৷

সারাবিশ্ব জুড়ে ধর্মীয় ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় সুপ্রাচীন সংস্কৃতি-শিক্ষা-জ্ঞান-যোগ ইত্যাদির দ্রুত অনুপ্রবেশ ঘটছে ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “ভারতবর্ষ হোলো পৃথিবী গ্রহের মাথা !” সুতরাং সেটি যত সুউন্নত থাকবে_পৃথিবী গ্রহের পক্ষে তত‌ই মঙ্গল। মানব শরীরের মাথা যত উঁচু থাকে, সমগ্র শরীর যেমন ভালো থাকে–সুস্থ থাকে, তেমনি ভারতবর্ষ আচার্যের ভূমিকায় থাকলে তবেই পৃথিবীর সমস্ত দেশ ভালো থাকবে- সুস্থ থাকবে ৷ সুতরাং এইটা হবেই, আর যত তাড়াতাড়ি সেটা হয় সমগ্র পৃথিবীর পক্ষে ততই মঙ্গল ৷৷

যাইহোক, আমরা আবার ফিরে যাবো বারেন্দা পরমানন্দ মিশন (কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান)-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট নানু মহারাজ বা স্বামী নির্বেদানন্দ মহারাজের সাথে গুরুমহারাজের যেসব একান্ত আলোচনা হয়েছিল – সেই সব কথায় ৷ একবার গুরুমহারাজের কাছে (বনগ্রাম আশ্রমে গুরুমহারাজের ঘরে) অনাথ বালকদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রহ্মচারী-ব্রহ্মচারিণীরা ছেলেদের লেখাপড়া বা তাদের দৈনন্দিন চলাফেরা বা জীবনযাত্রা, তাদের সমস্যা বা তাদেরকে নিয়ে আশ্রমিকদের সমস্যা – ইত্যাদি নানান বিষয়ে আলোচনার জন্য গুরুমহারাজের কাছে গিয়েছিলেন ৷

তখন আশ্রমে অনাথ বালকদের দায়িত্বে যথাক্রমে বড় মহারাজ বা মদন মহারাজ (স্বামী চিৎবিলাসনন্দ, উনিই অনাথ আশ্রমের head ছিলেন – তাই বড় মহারাজ), ছোট মহারাজ বা নানু মহারাজ (স্বামী নির্বেদানন্দ), রেবা মা (ব্রহ্মচারিণী সেবাপ্রাণা), ব্রহ্মচারী কমল [স্বামী … , উনি বর্তমানে বর্ধমান শহরের সন্নিকট দেওয়ানদিঘী মির্জাপুর আশ্রমের বঙ্কিম মহারাজের (স্বামী অমলানন্দ) সাথে থাকেন], ব্রহ্মচারী নচিকেতা (সিঙ্গুরের সব্যসাচী মান্নার ভাই), ব্রহ্মচারী জ্যোতির্ময়ানন্দ মহারাজ প্রমুখরা ৷ পরে পরে আরো অনেকেই (গুরুমহারাজ শরীরে থাকাকালীন সময়ে) অনাথ আশ্রমে ছেলেদের দায়িত্বে কাজ করেছেন ৷ তাদের অনেকে বেশ কিছুদিন টিকে গেছেন – অনেকে দু-চার মাস বা দু-চার বছর অনাথ আশ্রমে ছেলেদের দেখভালের কাজ করার পর অন্যত্র চলে গেছেন ৷ তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি (১৯৮৭/৮৮) সেই সময় ওই প্রথম তিনজনই মুখ্যতঃ ছেলেদের দায়িত্বে থাকতেন ৷

যাইহোক, ওনারা গুরুমহারাজের সাথে ছেলেদেরকে বড় করে বা শিক্ষিত করে গড়ে তোলার ব্যাপারে কি কি সমস্যা রয়েছে – সেইসব নিয়ে আলোচনা করছিলেন ৷ হঠাৎ করে গুরুমহারাজ ওনাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – “তোরা ছেলেদেরকে কিভাবে পড়াস ?” ওনারা উত্তরে কে কোন্ subject পড়ান – সেটা বলেছিলেন এবং বলেছিলেন প্রচলিত পদ্ধতিতে অর্থাৎ পিরিয়ড অনুযায়ী এক এক জন শিক্ষক (তখন ঐ সমস্ত ব্রহ্মচারী-ব্রহ্মচারিণীরাই শিক্ষক ছিলেন)ক্লাস নেন ৷

আপনারা আশ্চর্য হয়ে যাবেন, ওনাদের কথা শুনে গুরুজী কি উত্তর বা পরামর্শ দিয়েছিলেন – সেটা জানতে পারলে ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” ঐরকম প্রচলিত পদ্ধতিতে ছেলেদেরকে না পড়িয়ে আমি যেভাবে বলছি – ওই রকমভাবে ওদের পড়াতে পারবি কি ?” ওনারা বলেছিলেন – ” আপনি বলুন – আমরা চেষ্টা করবো ৷” তখন গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “তোরা এক এক জনে এক একটা ক্লাসের ছেলেদেরকে সারাদিন ধরে শুধুমাত্র একটাই subject পড়াবি ৷ ওই বিষয়টির একটি চ্যাপ্টার পড়িয়ে – ওখানেই ওদেরকে কোশ্চেন করবি ! দেখবি কে কেমন উত্তর দিচ্ছে ৷ প্রয়োজন হোলে আবার বোঝাবি – আবার কোশ্চেন ধরবি ৷ এইভাবে সেই বিষয়ের চ্যাপ্টারটা ছেলেদেরকে একেবারে আত্মস্থ করিয়ে দিবি ৷ যাতে করে ওদের আর পরে ওই বিষয়ের চ্যাপ্টারটা পড়তে না হয় ৷ এটাই হোলো বৈদিক শিক্ষাদানের পদ্ধতি ৷”