[ হিমালয়ের গভীরতম প্রদেশে ভ্রমণকালীন গুরু মহারাজকে একবার হনুমানের দল আক্রমণ করেছিল। আর একবার উনি হাতির পালের একেবারে সামনে পড়ে গিয়েছিলেন। উনি সেই সমস্ত ঘটনাটা বলছিলেন….]
…………………………………………………………………
জিজ্ঞাসু :— গুরুমহারাজ, হনুমানের দলের ঘটনাটা যদি অনুগ্রহ করে একটু বলেন ?
গুরুমহারাজ :— ঘটনাটা ঘটেছিল কি, আমি তখন নেপালের দিক থেকে হিমালয়ের অনেকটা গভীরের একটা নির্দিষ্ট স্থানে যাচ্ছিলাম। ঐ যাত্রাপথে দেখেছিলাম অনেকটা জায়গায় জুড়ে শুধুই কলাগাছের বন রয়েছে। সাধুরা যেটাকে কদলীবন বলেন। অন্য গাছও রয়েছে অনেক, কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে বিভিন্ন ঝরনার ধারায় পুষ্ট নদী প্রবাহিত হয়েছে স্থানটি দিয়ে, আর দুই পাশে ঐ কদলীবনের সৃষ্টি হয়েছে । ফলে স্বভাবতঃই ঐ বনকে ঘিরে হাতির পালের বাস এবং সহস্র সহস্র হনু বা বাঁদরের বাস। আমার ঐ বনে যাবার একটা উদ্দেশ্যও ছিল আর সেটা হোলো—সাধু পরম্পরায় কথিত আছে হনুমান, অশ্বত্থামা, বিভীষণ ইত্যাদি কয়েকজন নাকি বহুকাল শরীর ধারণ করে রয়েছেন, এঁদের এখনও স্থুল শারীরিক মৃত্যু হয়নি ! তাই অনেকেই(হিমালয়ের সাধুসমাজের মানুষেরা)আমায় বলেছিলেন, ‘স্বয়ং হনুমান যদি এখনও শরীর ধারণ করে বিরাজ করেন_ তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ঐ কদলীবনেই থাকবেন ! ফলে স্থুল শরীরধারী হনুমানের সন্ধানেই আমার ওখানে যাওয়া ! যাবার পরে অবশ্য একটা হনুমানই আমার প্রাণরক্ষা করেছিল, সে কথায় পরে আসছি ! আগে হাতির সামনে থেকে কি করে বাঁচলাম সেটাই তোমাদেরকে বলি।
আমি যে সঙ্কীর্ণ পথ ধরে হাঁটছিলামহিমালয়ান হাতিদের একটা মস্ত দল সেই পথেই আসছিল। হিমালয়ের রাস্তা মানেই একদিকে গভীর খাদ অপরদিকে খাড়া পাহাড়। তার উপরে আমি যে পথ ধরে যাচ্ছিলাম সেগুলি পশুদের চলার পথ, পাহাড়ী জনজাতিরাও প্রয়োজনে ঐসব রাস্তা মাঝেমাঝে ব্যবহার করে থাকে। আমার চলা পথের একটা বাঁক ঘুরতেই আমি একটা বিশাল হাতির পালের একেবারে সামনে পড়ে গেলাম, হয়তো দশ-পনেরো হাত দুরত্ব ! ঐ অবস্থায় আমার তখন পিছিয়ে পালাবারও ক্ষমতা ছিল না কারণ একে অনশনক্লিষ্ট দেহ_তাতে আবার দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত, তাই আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঐ দলটির দলপতি একটা বিশালদেহী দাঁতাল হাতি সামনে ছিল – সেও দাঁড়িয়ে গেল শুঁড় তুলে। দেখলাম পুরো দলটার এমন সুন্দর discipline যে, দলপতি দাঁড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রায় একশোর ও বেশি হাতি পরপর দাঁড়িয়ে গেল। পিছনের হাতিরা তো আমায় দেখতে পাচ্ছে না শুধু দলপতিকে অনুসরণ করেই দাঁড়িয়ে গেল !
খুব দ্রুত আমি চিন্তা করে নিলাম যে, এক্ষুনি আমার কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কি করা যায়- কি করা যায়! চট্ করে, গায়ের জীর্ণ জামাটা খুলে ডান হাতে নিয়ে একবার বাঁদিকে আর একবার ডানদিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে দোলাতে শুরু করে দিলাম। দলপতি হাতিটি জামার গতিবিধি লক্ষ্য করে তার মাথাটা একবার বাঁদিকে এবং একবার ডানদিকে হেলাতে লাগলো। এবার একটা খুব মজার কাণ্ড হোলো ! দলপতির ঐরকম বাঁদিক-ডানদিক মাথা দোলানো দেখে_ ঐ দলের সমস্ত হাতি ব্যাপারটা কি হোচ্ছে, তা না বুঝেই তাদের নিজেদের মাথাও একবার বাঁদিকে আর একবার ডানদিকে দোলাতে লাগলো!
এইভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকার পরেই, আমি সুযোগ বুঝে পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠে পড়লাম, যাতে হাতিরা আমার নাগাল না পায়। আর ওখান থেকেই লক্ষ্য করতে থাকলাম হাতিরা কি করে! দেখলাম কিছুক্ষণ মাথা নড়ানোর পরই দলপতিটা হঠাৎ যেন খেয়াল করলো, ‘আরে সামনে তো কেউই নাই’__তাই সে তার মাথা নাড়ানো বন্ধ করে দিল এবং বাকিরাও! এরপর দলপতিটি ধীরে ধীরে গজেন্দ্র গমনে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো আর বাকী হাতিরাও তাকে follow করে করলো। ওরা চলে যাবার পরে ঐ উঁচু জায়গা থেকে আমি মোটামুটি গণনা করে দেখলাম যে, দলটিতে হাতির সংখ্যা প্রায় ১০০-র বেশী ছিল।
হাতিরা চলে যেতেই আমিও উঁচু থেকে নেমে এসে আবার চলতে শুরু করলাম। একেবারে কদলীবনের মাঝামাঝি জায়গায় এসে একটা ঝরনার ধারে এক গাছতলায় বসে বিশ্রাম নেবার জন্য মনস্থির করলাম। রাস্তায় একটা লালমতো বড় ফল পেয়েছিলাম, ওটা বনের আগুনেই ঝলসে নিয়ে সঙ্গে রেখেছিলাম। ওখানে বসে বসে মনে করলাম ফলটা খেয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করবো। কারণ ওখানে অন্য খাবার আর কি পাওয়া যাবে ! কদলীবন মানে ভেবোনা যে প্রচুর পাকা কলা রয়েছে __তা খেলেই তো হয় ! ঐ কদলীবনের কলা পাকবার জো নাই, হনু-বাঁদরের দল পাকার আগে থেকেই সেগুলোকে কামড়াতে শুরু করে।আর হাতির পাল একবার ঢুকলেই বনের বেশ খানিকটা জায়গা একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয়।
যাইহোক, ঐখানে কিছুক্ষণ বসে ক্লান্ত দেহটাকে একটু বিশ্রাম দিলাম। সেই পোড়া ফলটা আমার পাশেই রাখা ছিল, হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ হোতেই দেখি_ আমার পাশ থেকে ঝলসানো ফলটা নিয়ে একটা হনুমান আবার একলাফে গাছে উঠে গেল ! আমি আর কি করি–ভাবলাম বহুক্ষণ পরে আহার্যের এই ফলটুকু যোগাড় ছিল, সেইটা গ্রহণ করাটাও ঈশ্বরের ইচ্ছা নয় ! সুতরাং সিদ্ধান্ত করলাম তাঁর ইচ্ছাটাই মেনে নেওয়া যাক্। এটুকু ভাবতে ভাবতেই আবার ধপ্ করে একটা শব্দ আর গোঙানি আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি সেই হনুমানটা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে এবং তার মুখ দিয়ে ফেনা ফেনা গ্যাজলা বেরোচ্ছে ! বুঝতে পারলাম সেই ফলটা কোনো অখাদ্য বিষজাতীয় ফল ছিল ! এমনিতে হনুমানেরা জঙ্গলের বিষফল চেনে কিন্তু ঝলসানো থাকায় বিবর্ণ হয়েছিল বলেই বুঝতে পারেনি!
ওর প্রতি সমবেদনায় আমার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার প্রাণের বিনিময়ে ঐ নিরীহ প্রাণীটির প্রাণ যেতে বসেছে দেখে__আমি দৌড়ে গিয়ে পাহাড়ি নদীটির জলে আমার গায়ের জীর্ণ জামাটা ভিজিয়ে নিয়ে এসে নিংড়ে নিংড়ে ওর মাথায়-মুখে দিতে লাগলাম। এইভাবে ছুটে ছুটে কয়েকবার যাওয়া-আসা করে জামা ভিজিয়ে ভিজিয়ে জল দেবার পর ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে সারা শরীরটাকে ম্যাসেজ করতে লাগলাম ! এছাড়াও হনুমানটির মুখ থেকে বেরোনো ফেনার মতো গ্যাজলা আঙ্গুল দিয়ে বের করে করে ওর মুখটা পরিষ্কার করতে লাগলাম ।
আমি আমার স্বভাব অনুযায়ী ঐ আর্ত হনুমানটির সেবায় মনপ্রাণ এক কাজ করছিলাম, খেয়াল করিনি যে হনুমানের দল কখন গাছ থেকে নেমে এসে আমার চারপাশে ঘিরে বসেছে এবং একদৃষ্টে লক্ষ্য রাখছে যে, আমি কি করছি। আমার মনে হোলো যদি অসুস্থ হনুমানটার কিছু হয় তো ওরা আমাকে সমবেতভাবে হয়তো এ্যাটাক্ করে মেরেই ফেলবে! কিন্তু আমি ভাল-মন্দ চিন্তা না করে সেবাকাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। বহুক্ষণ অচেতন থাকার পর ধীরে ধীরে হনুমানটির চেতনা এলো, ও উঠে বসলো। তারও বহুক্ষণ পর হনুমানটি টলতে টলতে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের নীচে চলে গেল। হনুর পালও আমাকে ছেড়ে ওকে follow করে সেখানে জড়ো হোলো। আর এই ফাঁকে আমিও ঝরনা-পুষ্ট নদীটি পেরিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলাম।
এইভাবে রামায়ণে বর্ণিত হনুমানের সাথে দেখা করতে গিয়ে বনের একটি সাধারণ হনুমান আমার প্রাণ রক্ষা করেছিল। তবে দেখেছিলাম যে, ওখানে বহু মহাপুরুষ বা যোগীরা সূক্ষ্ম শরীরে বা অণিমা, লঘিমা ইত্যাদি সিদ্ধি অবলম্বন করে রয়েছেন ! এঁদের অনেকের সাথে আমার যোগাযোগও হয়েছিল।