শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের অন্যতম সন্ন্যাসী শিষ্য, অন্তরঙ্গজন, বৈষ্ণব-স্বভাববিশিষ্ট মহাজন স্বামী মাধবানন্দের অকাল প্রয়াণে আমরা তাঁর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলাম I আমরা এখনো মাধবানন্দজীর সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্ববর্ত্তী জীবনের ঘটনাসমূহের আলোচনাতেই এখনো রয়েছি I এই দিকটা একটু বেশি টানার একটা অন্যতম কারণ হোলো এই যে, আমাদের বেশিরভাগ পরমানন্দভক্তই মাধবানন্দজীর সন্ন্যাসজীবন সম্বন্ধে কমবেশি ওয়াকিবহাল, কিন্তু একটা সাধারণ জীবন কিভাবে মহাজীবনে রূপান্তরিত হয় – সেই পথে কত বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করতে হয়, কত তীব্র ব্যাকুলতা ত্যাগ বৈরাগ্যের প্রয়োজন হয় – সেই ক্রমগুলিও তো অন্ততঃ কিছুটা জানতে হবে। কোনো মহাসাধকেরই সাধনজীবনের সমস্তটা জানা যায় না কিন্তু খানিকটা অন্ততঃ জানা যায় — আর আমাদের সেই অল্পটুকু জানাটারই প্রচেষ্টা !
ওনার প্রথম জীবনের প্রতিবন্ধকতা বলতে গেলে বলতে হয় পারিবারিক অভাব-অনটনের কথা ! ভারতবর্ষের মহাত্মা-মহাপুরুষগণের জীবনী পর্যালোচনা করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই ব্যাপারটা common। প্রায় সবারই প্রথম জীবনটা প্রায়শঃই দুঃখ-দারিদ্র-অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে সংগ্রাম করে কেটেছে । ভক্ত রুইদাস নামে একজন মহাত্মা বলেছিলেন - ' অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট - এইগুলি যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ। দুঃখ-কষ্ট রয়েছে বলেই প্রতিনিয়ত ঈশ্বরকে স্মরণ মনন হয় । ধন-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব মানুষকে ঈশ্বর থেকে দূরে নিয়ে যায় ।" সংসারের এই অভাব-অনটন মেটানোর জন্যেই মাধবানন্দ মহারাজের নিজগ্রাম ছেড়ে দুর্গাপুরে আসা এবং সেই দুর্গাপুরে গুরুমহারাজের সাথে মহারাজের প্রথম সাক্ষাৎ ! আর তার অল্প কিছুদিন পরেই মহাদেব ব্যানার্জি পরিণত হয়েছিলেন স্বামী মাধবানন্দ মহারাজ-এ এবং আরো পরে ধীরে ধীরে মহারাজ তাঁর নিজের অনুরাগীদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার বীজ বপন করতে শুরু করেছিলেন- এ এক সুদীর্ঘ যাত্রাপথ !
তবে আমরা একটা কথা জানি যে, গুরুজী তাঁর সন্তানদের বিশেষতঃ তাঁর পার্ষদদেরকে সবসময় লক্ষ্য রাখেন, একেবারে তাদের জন্মগ্রহণের সময় থেকে তাদের বড় হয়ে ওঠা - এমনকি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়া পর্যন্ত উনি নজরে নজরে রাখেন। মাধবানন্দ মহারাজের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয় নি - বড় হবার পর উনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মঠ-মিশনে গেছেন, সাধু হবার সংকল্প গ্রহণ করেছেন, সারারাত জেগে জেগে ধ্যান-জপ করেছেন, ওনার এক কাকা যিনি সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত এবং শ্মশানে বসে হোমযজ্ঞ-তন্ত্রক্রিয়া করতেন -- তাঁর সাথেও ক্রিয়াদি করেছেন, বক্রেশ্বরে আশ্রম নির্মাণ করে সেখানে থেকেছেন (ভোলাগিরি অভয়ানন্দ আশ্রম, যেখানে নীলকন্ঠানন্দ গিরি, কাজল মহারাজ বা লোকেশ্বরানন্দ এবং উনি থাকতেন গৌরী মা নামক একজন সাধিকার আশ্রয়ে) - এই সবই ছিল যেন স্বামী পরমানন্দের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্ব । এই যুগের যুগপুরুষ ভগবান স্বামী পরমানন্দের সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই উনি তাঁর কাজের সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন I
গুরুমহারাজের সাথে সাক্ষাতের আগে মাধবানন্দ মহারাজের (তৎকালীন মহাদেব ব্যানার্জি) জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল, আমরা এখন সেই ঘটনার কথা বলব । গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকেই মাধবানন্দের বৈরাগ্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছিল । সেইসময় উনি প্রায় সময়েই সদগ্রন্থ পাঠ, আধ্যাত্মিক আলোচনা, সৎ-সান্নিধ্যে বাস এবং প্রচন্ড সাধনভজনের মধ্যে সময় কাটাতেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব তো ছিলই ছোটো থেকেই ! তাছাড়া ওনাদের পরিবার বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পরম্পরার দীক্ষিত ছিল, ফলে সেই প্রভাবও ওনার মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল । সাধন ভজন করতে করতে__ একসময় ওনার মধ্যে একটা গভীর ক্ষোভ জন্মে গেছিলো। ক্ষোভের কারটা হোলো- কেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সমকালীন সময়ে ওনার শরীর হোলো না ? কেন উনি ঠাকুর, স্বামীজি, সারদা মা, বিজয় গোঁসাই - প্রমুখদের মতো কোনো মহাপুরুষের সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না ? 'ঐরকম উন্নত মহাত্মা বা সদগুরুর সাক্ষাৎ যদি না হয় - তাহলে তো জীবনধারণই বৃথা !'__ এইসব চিন্তা করে উনি সংকল্প করেছিলেন যে, তাঁর জীবন তিনি আর রাখবেন না !
ওনার আচার-আচরণ বা কথাবার্তায় তাঁর পারিপাশ্বর্স্থ সুহৃৎ বা স্বজনেরা খানিকটা আঁচ করতে পেরে, সেইসময় ওনাকে একটু চোখে চোখে রাখতেন I আর সেইসময়েই ওনার এক জ্যোতির্ময় পুরুষের দর্শন হয় ! যিনি ওনাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন - " চিন্তা কোরো না, তোমার ইষ্ট দর্শন হবে, সদগুরু লাভও হবে ।" তারপরেই সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ অন্তর্হিত হয়ে যান।
এরপর থেকেই মাধবানন্দ মহারাজের ঈশ্বরের জন্য "খোঁজ" আরো বেড়ে যায় এবং উনি বিভিন্ন মঠ-মিশনে (পূর্বে উল্লেখিত) ছুটে ছুটে যাওয়া-আসা বাড়িয়ে তোলেন। তারপরে ঐ যে দুর্গাপুরের সগরভাঙায় সেজকাকার বাড়িতে গুরুজীর সাথে সাক্ষাৎ __ঐ সময়টাই ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ ! মাধবানন্দ মহারাজ গুরুজীকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন যে, তাঁর স্বপ্নদর্শনে দেখা জ্যোতির্ময় পুরুষটি অন্য আর কেউ নয় _তিনি ছিলেন স্বামী পরমানন্দ।। মাধবানন্দ গুরুজীকে ভালো করে দেখার জন্য তাকাতেই _দেখেছিলেন গুরুজীও তাঁর দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন এবং গুরুজীর মুখে রহস্যময় হাসি।।
(ক্রমশঃ)