শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের অন্যতম সন্ন্যাসী শিষ্য, অন্তরঙ্গ ভক্ত, প্রেমিক স্বভাবের সাধু স্বামী মাধবানন্দের অকাল প্রয়াণে আমরা “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা” পেজে তাঁর স্মৃতিচারণ করছিলাম । ওনার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম । এর আগের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম যে, স্বামী মাধবানন্দের সহোদর ভ্রাতা জ্যোতির্ময়ানন্দ বা জয়দেব ব্যানার্জি বনগ্রাম আশ্রমে প্রথমবারের মতো যাবার পরেই বুদ্ধ পূর্ণিমায় গুরুজী ওনাকে ব্রহ্মচর্য দীক্ষা বা নৈষ্টিক ব্রহ্মচার্য নেবার দিন ধার্য করে দিয়েছিলেন । কিন্তু ওনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা, যে ব্যক্তি ওনার পথপ্রদর্শক, সন্ন্যাসী হওয়া যার সংস্কারে রয়েছে কারণ ছোটো থেকেই সন্ন্যাসী হবার বাসনা নিয়েই তিনি বড় হয়েছেন – তাঁকে অর্থাৎ মাধবানন্দ মহারাজকে তখনও গুরুজী ডাকেন নি !
জ্যোতির্ময় মহারাজকে যখন গুরু মহারাজ নৈষ্টিক দেবার কথা বলেন, তখন জ্যোতির্ময়জী ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন - "ঐ সময় সাথে করে কি কি আনতে হবে ?" এর উত্তরে গুরুজী বলেছিলেন - " সাথে করে শুধুমাত্র তোর হৃদয়টাকে নিয়ে আসবি - তাহলেই হবে । অন্য কিছু নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন নাই !" এই কথাটা যখন উনি দুর্গাপুরে ফিরে গিয়ে ওনার মাকে এবং ওনার কাকা( যিনি বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পরম্পরার দীক্ষীত ও শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ছিলেন এবং খুবই সাধনভজন করতেন)-কে বলেন, তখন তাঁরা খুবই চিন্তায় পড়ে গেছিলেন । আসলে সর্বত্র তো এটাই বলে - 'এটা আনবে, ওটা আনবে, সেইটা না আনলে চলবে না ইত্যাদি' !! কিন্তু গুরুজীর কথা প্রচলিত চিন্তাধারার সাথে মিলতো না, ফলে যখনই জ্যোতির্ময় মহারাজ "সঙ্গে করে হৃদয় আনা"-র কথা বলেছিলেন, তখন বাড়ির সকলের বিশেষতঃ ওনার গর্ভধারিনীর কাছে ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত ঠেকেছিল I
ভারতবর্ষের প্রাচীন আর্যপরম্পরার আদর্শ জননী ছিলেন শ্রীমতি গীতা ব্যানার্জি । এক ছেলের নৈষ্টিক ব্রহ্মচর্য হবে জেনে - তিনি তাঁর সবচাইতে আদরের সন্তান, শিবস্বভাবের সন্তান (স্বামী মাধবানন্দ)-কে স্বয়ং পাঠিয়েছিলেন গুরুজীর কাছে বনগ্রামে ! বলেছিলেন - " যাও, তুমি নিজে একবার ওখানে গিয়ে দেখে এসো ! 'হৃদয়' ছাড়া আর কিছুই আনার প্রয়োজন নাই - একথা বলেছেন কেন ?"
পাঠকবৃন্দ, চিত্রটা কি দাঁড়ালো একবার দেখুন ! মাতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে আর্যপরম্পরার শিষ্য আসছেন সনাতন-শাশ্বত লোকোত্তর পরম্পরার গুরুর কাছে !! চিরন্তন গুরু শিষ্যের সেই মিলনের দৃশ্যটি মানসপটে ভেসে উঠে - মনে সত্যিই এক আনন্দের হিল্লোল বইছে না কি! সে যাই হোক, এইবার গুরুজী কি করলেন -- মাধবানন্দের মনজগতে ভ্রাতা জ্যোতির্ময় মহারাজ সম্বন্ধে যেসব জিজ্ঞাসা ছিল তার উত্তর দান করে বলে বসলেন - " আগামী বৈশাখ মাসে (১৯৯২ সাল) বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন তুমিও চলে আসবে। ঐ দিন তোমাকেও নৈষ্টিক দেওয়া হবে !"
এক খাতে চলছিল স্বামী মাধবানন্দের জীবন ---মা-ভাইবোনের দায়দায়িত্ব, একরাশ ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাদানের ভার, সামাজিক অন্যান্য দায়িত্ব, আনন্দমার্গী সংগঠনের প্রতি কর্তব্য __সেইদিন থেকে এইসব ভাবনার জগতটাই সম্পূর্ণ পাল্টে গেল ! নৈষ্ঠিক দীক্ষার পর থেকেই দুর্গাপুর বিধাননগরের মহাদেব ব্যানার্জি বর্ধমান শহরসহ দূরবর্তী অনেক স্থানের ভক্তবৃন্দের কাছে তাদের হৃদয়াসনে বিরাজমান "স্বামী মাধবানন্দ"-এ পরিণত হোলেন । ঐ তিথিতে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্যের ক্রিয়াটি হয়েছিল বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনেই । এর আগে আগে গুরুজী ব্রহ্মচারীদের নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য বা অনেকের সন্ন্যাস দিয়েছিলেন ধাত্রীগ্রাম অথবা আজিমগঞ্জে নিয়ে গিয়ে গঙ্গানদীর ধারে । এইবারের ক্রিয়াটি কিন্তু হয়েছিল আশ্রমের পুকুর (রোঙাপুকুর)-রূপ গঙ্গাতীরে ! আশ্রমের পুকুরটিও তো গঙ্গাস্বরূপই পবিত্র ! ঐ পুকুরে স্বয়ং ভগবান স্নান করতেন, সাঁতার কেটে এপার-ওপার করতেন । আশ্রমের সাধু-মহাত্মারাও ঐ পুকুরে দীর্ঘদিন স্নান করেছেন (প্রথমদিকে স্নানের জন্য কোনো বাথরুম ছিল না, টিউবওয়েলের প্রাচুর্য ছিল না) - ফলে ভগবানের বা তাঁর পার্ষদদের পাদ-স্পর্শ, গাত্র-স্পর্শ পাওয়া জল - গঙ্গাজলের ন্যায় পবিত্র তো বটেই !
সেবার মাধবানন্দ মহারাজ এবং তাঁর সহোদর ভ্রাতা জ্যোতির্ময়ানন্দ ছাড়াও নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য দীক্ষা হয়েছিল ছাত্রদের আশ্রমে অনাথ বালকদের দায়িত্ব থাকা নানু মহারাজ বা স্বামী নির্বেদানন্দ, চরৈবেতি কার্যালয়ের অক্লান্ত কর্মী ইন্দ্রজিৎ মহারাজ বা স্বামী অসংগানন্দ (যিনি স্থূলশরীর ছেড়ে কয়েক বছর হল পরমানন্দ লোকে চলে গেছেন) এবং মনোজিৎ বা স্বামী বাসুদেবানন্দ (যিনি তখন তপেশ্বরানন্দের সাথে আশ্রমের বাগান পরিচর্যা করতেন এবং কিছু কিছু সব্জি চাষে সহায়তা করতেন। তাছাড়া উনি প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় আশ্রমের প্রার্থনায় প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতেন।)। আসল কাজটি গুরুমহারাজ স্বয়ং করলেও পুরোহিত হিসাবে ছিলেন বনগ্রামের মুখার্জি বাড়ির দেবীপ্রসাদ মুখার্জী, রমাপ্রসাদ মুখার্জী, উমাপ্রসাদ মুখার্জী (এরা সকলেই ন'কাকার দাদা) প্রমুখেরা । গুরুজীর সাথে সহযোগিতা করেছিলেন হরি মহারাজ অর্থাৎ স্বামী সহজানন্দ ।
শেষের দিকে যে সমস্ত মহারাজদের নৈষ্ঠিক হোতো - সমস্ত ক্রিয়ার পরে গুরুজীর ঘরে বা ঠাকুর ঘরে ব্রহ্মচারীদের গায়ত্রী মুখস্ত করানোর জন্য গুরুমহারাজ জয়দীপকে(যেহেতু জয়দীপ__ ভট্টাচার্য ব্রাহ্মন পরিবারের সন্তান, তাছাড়া সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্রহ্মচারী ছিল) পাঠাতেন । মাধবানন্দ এবং জ্যোতির্ময়ানন্দজীরাও ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান, তাছাড়া ওনাদের দুজনেরই নিত্যকর্ম ও পূজাপাঠ করার অভ্যাস ছিল । ফলে ওনাদেরকে অবশ্য গায়ত্রী ছন্দের সাবিত্রী মন্ত্র কারুকে শেখাতে হয়নি, ঐ ব্যাচের বাকিদেরকে ওনারাই বরং ঐ মন্ত্র মুখস্ত করার কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। (ক্রমশঃ)