গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ তাঁর গুরুদেব উত্তর কাশীর রামানন্দ অবধূতের কথা বলছিলেন , যাঁর চোখে নারী-পুরুষের ভেদটাও দৃশ্যমান হচ্ছে না ! প্রকৃতিগতভাবে (ঈশ্বরের সৃষ্ট) সৃষ্ট যে দুটি ভেদ – “নারী ও পুরুষ” , সেই ভেদ-ও ব্রহ্মজ্ঞানীর দৃষ্টিতে ভেদ নয় । এ বড় বিচিত্র ব্যাপার ! এটা কি সম্ভব ? হ্যাঁ , সম্ভব –৷ এটা তখনই সম্ভব বা তাঁর পক্ষেই সম্ভব যিনি প্রকৃতিকে জয় করেছেন , পার্থিব যে কোন বিষয়সমূহ – লোভ , মোহ আদি যে কোন ইন্দ্রিয়লিপ্সার আবর্ত্তের অনেক ঊর্দ্ধে নিজের চেতনাকে স্থাপন করতে পেরেছেন!
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – যোগসাধনার (ভক্তিযোগ , রাজযোগ , জ্ঞানযোগ , কর্মযোগ – সবই যোগ) একটা নির্দিষ্ট স্তরে যখন সাধক উন্নীত হয় তখন তার মন আর নাভীর নীচে নামে না ।
তাহলে পাঠকবর্গ ! বুঝতেই পারছেন , আমরা সাধারণেরা যেভাবে জগৎ সংসারকে দেখি বা বিচার করি , ঐ অবস্থায় উন্নীত সাধকেরা(উন্নত যোগীরা) সেইভাবে জগৎ দেখেন না বা বিচার করেন না! আর এইটা না বুঝতে পেরে অনেকে(সাধারণ মানুষেরা), বা বলা যায় তর্কবাজ বুদ্ধিজীবীরা অকারণে সমাজে উন্নত মানুষদের দিকে কাদা ছোঁড়ে , কালি ছেটায় , লেখনীর মাধ্যমে নানা কটুক্তি লিখে বিকৃত মানসিকতার লোকেদের কাছ থেকে বাহবা কুড়ায় !
[কথাগুলো কি বোঝা গেল না ? তাহলে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় – “Rationalist” নামে যে শিক্ষিত গ্রুপটি ভারতবর্ষে কাজ করে চলেছে , এদের কাজই হ’ল ভারতীয় ঋষিদের উক্ত প্রাচীন- আদি – সনাতন পরম্পরার শিক্ষা গুলিকে এবং ঋষি-মুনি-মহাত্মাদের কে ছোট করে , বিকৃত করে মানুষের কাছে পরিবেশন করা ৷
সমাজের বেশীরভাগ মানুষ অবশ্য এদেরকে গ্রহণ করে না , কিন্তু 2% বা 3%(খুব বেশি হলে ১০%)মানুষও তো এদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে ! দক্ষিণ ভারতের এইরকম এক পন্ডিত J.J.Kripal – “Kali’s son” বা এই ধরণের কিছু একটা নাম দিয়ে একটা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছে , যেখানে সে কয়েকটা তথ্য তুলে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একজন সমকামী (Homosex) বা বিকৃতকামী মানুষ ছিলেন !!
ভাবুন একবার ! বামপন্থী এক লেখকের লেখা একটি বইয়ে দেখানো হয়েছে যে – চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষরা (যেহেতু বর্তমান বাংলাদেশে তাদের বাড়ী ছিল) মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিল ৷ এখনও বিভিন্ন বামপন্থী মার্কসবাদী সংগঠন থেকে প্রকাশিত সমস্ত গ্রন্থেই ভারতীয় সনাতন সংস্কার , সংস্কৃতি বা পরম্পরাগুলিকে যুক্তি দিয়ে দিয়ে বিরোধ করা হয় । আর অপরদিকে দেখুন __ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশ ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্র নিয়ে , ভারতীয় বিভিন্ন মহাত্মাদের শিক্ষাগুলি নিয়ে_ গবেষণা করছে এবং নিজেদের দেশে বা সমাজে সেগুলির প্রয়োগ ঘটাচ্ছে এবং উপকৃত হচ্ছে।]
কথা হচ্ছিলো ভারতীয় উন্নত জ্ঞানী , যোগী , মহাত্মা-মহাপুরুষদের নিয়ে – যাঁদের চোখে ভেদ দৃষ্টি নাই , সবকিছুর মধ্যে সেই ব্রহ্মই দর্শন হচ্ছে ! আমাদের গুরু মহারাজও “সর্বভূতে আত্মবৎ” দেখতেন বলেই সকলকে “প্রিয় আত্মন্” বলে সম্বোধন করতেন ৷ তবে এতক্ষণ যাদের কথা বলা হ’ল তারা সবাই সাধনার সর্ব্বোচ্চ স্তরের মানুষজন ৷ যাঁরা ভেদদৃষ্টির উর্দ্ধে উঠেছেন এ তাঁদের কথা ৷ কিন্তু তাহলে কি সাধারণেরা ঐরকম অসাধারণ হয়ে উঠতে পারবে না ? সিঙ্গুরের এক পুরোনো ভক্ত একবার গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিল – “গুরু মহারাজ ! আপনার আশ্রমে এসে দেখছি এখানে তরুণী ব্রহ্মচারিনী মেয়েদেরকেও ‘মা’ বলে ডাকার রীতি ! কিন্তু আমি তাকে ‘মা’ ভাবতেই পারছি না , হয়তো ‘মা’ শব্দের পর আর একটা অক্ষর (!) বসাতে চাইছি বা সেই দৃষ্টিতে দেখছি , অথচ আপনার অনুশাসনে আমাকে জোর করে তা বলতে বা ভাবতে বাধ্য করানো হচ্ছে ! এটা কি আপনার উচিৎ হচ্ছে – এটাও তো একপ্রকার অত্যাচার! এটাও তো প্রবৃত্তির অবদমন !?”
গুরু মহারাজ এককথায় যে উত্তর দিয়েছিলেন তার সারমর্ম হল এই যে , এটাকেই “সংযম অভ্যাস” বলে! এইটি শিক্ষা করার জন্যেই তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আশ্রমে আসবে গৃহী মানুষ ! এখানে এসেই তো সংযম শিখবে – না হলে সাধারণ মানুষ কখনই রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ্যের জগৎ , মায়া-মোহের ফাঁস থেকে বেরোতে পারবে না । ‘মাল’ বা ‘মাগ্’ -কে “মা” ভাবতে শেখাটাই আধ্যাত্মিকতা – এটাই সত্য ! সমস্ত নারীর মধ্যে ‘মা’-কে প্রত্যক্ষ করতে শেখালেন এ যুগের যুগপুরুষ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ৷ তিনি ‘মাগ্’-কে “মা” হিসাবে পূজা করে , প্রতিষ্ঠা করে – জগৎবাসীকে দেখিয়ে দিলেন প্রকৃত সত্যটি কি!
এবার আসি যোগসাধনায় সিদ্ধ হবার ফলে নারী ও পুরুষের শরীরে কি আশ্চর্য পরিবর্তন হোতে পারে _সেই ব্যপারে গুরুমহারাজ কি বলেছিলেন _সেই কথায়!
এই অবস্থায় নারী আর নারী থাকেনা _অথবা পুরুষ আর পুরুষ থাকে না! শুধু বাহ্যিক শরীরটা ই অপরিবর্তিত থাকে কিন্তু অভ্যন্তরস্থ অন্তক্ষরা গ্রন্থিগুলির ক্রিয়া পরিবর্তিত হয়ে যায়!
গুরুমহারাজ বলেছিলেন _যোগ-সাধনার ফলে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হবার পর যখন ঐ শক্তি ঊর্ধ্বগতি লাভ করতে থাকে _তখন মেরুদণ্ড বরাবর(সুষম্নামার্গ) অবস্থিত ছটি চক্র(গ্রন্থি)[মূলাধার – স্বাধিষ্ঠান – মনিপুর – অনাহত-বিশুদ্ধ-আজ্ঞা) – কে একে একে অতিক্রম করতে থাকে। কুলকুন্ডলিনী শক্তি যখনই আজ্ঞাচক্রে(দ্বিদল পদ্মবিশিষ্ঠ Pituitary gland) স্থিত হয়, তখন ঐ সাধকের যেন নতুন জন্ম হয়! সেই শরীর তখন হয় যেন এক নতুন শরীর!
ঐ শরীরে আর নাভির নিচে মন যেতে পারে না। এর ফলে কি হয়? তখন সাধকের অর্থাৎ পুরুষ শরীরে আর ষড়রিপুর( কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য) কোন ক্রিয়াশীলতা থাকে না! `কামরিপু’-র ক্রিয়া না থাকায় ঐ শরীরে তখন আর বীর্য তৈরি হয় না! বীর্য তৈরির জন্য যে potential energy শরীরের প্রয়োজন হোত _সেই শক্তি তখন প্রবলভাবে ঊর্ধ্বগতি লাভ করে সুপ্ত brain-cell গুলিকে দ্রুত জাগ্রত করতে থাকে! ফলে ঐ সাধক একস্থানে বসে বসেই জগতের সমস্ত রহস্য অবগত হোতে থাকেন!যেটা হাজার লাইব্রেরীর বই পড়েও জানা সম্ভব হয় না!
ঠিক একইভাবে যদি কোন সাধিকা অর্থাৎ নারীশরীর সাধনার ঐ সর্বোচ্চ স্তরে (মানুষ সাধনার দ্বারা আজ্ঞাচক্র অবধিই পৌঁছাতে পারে) পৌঁছাতে সমর্থ হ’ন _তাহলে ঐ শরীরে ডিম্বানু সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে এবং ঐ শরীরে আর ঋতুচক্র হবে না! অর্থাৎ নারীশরীর হোলেও তিনি এখন আর সেই অর্থে ‘নারী’ বা ‘রমনী’ থাকেন না! তাঁরও potential energy ঊর্ধ্বমুখে transfer হয়ে যায়!
তাহলে বোঝা গেল তো যে, ঐ অবস্থায় সত্যি সত্যিই নারীশরীর এবং পুরুষশরীরের আপাত ভেদ প্রতীয়মান হোলেও _প্রকৃত অর্থে ভেদ থাকে না।
এইবার ঐসব জ্ঞানী – যোগী-মহাত্মা – মহাপুরুষদের কথা ভাবুন _যাঁরা আজ্ঞাচক্র অতিক্রম করেছেন তাঁরা কি করে নারী-পুরুষের ভেদ দেখবেন? অথবা নারী কে ‘রমনী’_ভাববেন?
এইজন্যই তো তাঁরা সকলকে সম্বোধন করেন __”#প্রিয়আত্নন”।(ক্রমশঃ)