গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ একদিন সিটিং-এ আলোচনা করছিলেন কেন যুদ্ধ , কেন হানাহানি-মারামারি হয় ? এক দেশের সাথে অন্য দেশের মধ্যে , দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে , রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় উন্মাদনার জন্য _সমাজে প্রতিবেশীদের মধ্যে , পরিবারে ভাইয়ে-ভাইয়ে – যেকোন রূপে লড়াই , মারামারি , ঝগড়াঝাঁটি , রেষারেষি চলছেই ! সবসময়েই চলছে – কোথাও ছোট আকারে , কোথাও বড় আকারে ! বড় আকারে হলে তখন তার নাম যুদ্ধ ! কিন্তু কেন যুদ্ধ – আর কি তার প্রতিকার ?
গুরু মহারাজ বলছিলেন – আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে ভগবান বুদ্ধ ভারতবর্ষে জন্মেছিলেন এবং সুতীব্র সাধনার দ্বারা বুদ্ধত্ব বা অর্হত্ব (জ্ঞানের চরমভূমিতে পৌঁছানো) লাভ করেছিলেন । তখনও পৃথিবীতে খ্রীষ্ট ধর্মমত বা হজরত মুহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত ইসলাম মজহব-এর জন্ম বা সূত্রপাত হয়নি । কিন্তু তখনও যুদ্ধ ছিল , রেষারেষি-হানাহানি-মারামারি ছিল , যার অবশ্যম্ভাবী ফল অহেতুক রক্তপাত!
ভগবান বুদ্ধ অহিংসার বাণী প্রচার করতেন – বহু রাজন্যবর্গ বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল এবং এমন কথিত আছে যে অনেক রাজার সেনাপতি বা সৈন্যদের কোমরে তখন চামড়ার খাপে কাঠের তরবারি ঝোলানো থাকতো , কোন ধারালো ইস্পাতের তরবারি থাকতো না কারণ পাছে কারো রক্তপাত করে বসে !
কিন্তু সবাই তো অহিংস নীতি গ্রহণ করে নি – তাই তখনও যুদ্ধ হোত , হোত রক্তপাত ! একদিন এক জিজ্ঞাসু ভক্ত, ভগবান বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেছিল__ যুদ্ধের কি কোনদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে না ? বুদ্ধ উত্তর দিয়েছিলেন – ” পৃথিবী থেকে যত দিন কসাইখানা নিশ্চিহ্ন না হয়ে যাবে – তত দিন পৃথিবী যুদ্ধ মুক্ত হবে না ।”
কিন্তু কসাইখানার সাথে যুদ্ধের সম্পর্কটা কি ? এটাই আলোচনা করা যাক্ । এখানে ‘কসাইখানা’ বলতে হিংসার কথা বলা হয়েছে। মানুষ যখনই কোন প্রাণীকে হত্যা করে , তখন অবশ্যই সেই মানুষের মনোজগতে রয়েছে ‘হিংসা’ , আর মানুষের মনে হিংসা রয়েছে মানেই সে কোন না কোনভাবে সেই হিংসার প্রয়োগ ঘটাবেই । প্রয়োজন শুধু ‘ক্ষেত্রের’ ! ‘ক্ষেত্র’ পেলেই সে হিংসার প্রয়োগ ঘটাবে ।
এইভাবে সমাজে এক একটি unit অর্থাৎ একটা মানুষ, দুটি মানুষ করতে করতে হাজার-হাজার , লক্ষ-লক্ষ মানুষের মনের হিংসাই গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে , দেশে-দেশে , জাতিতে-জাতিতে যুদ্ধে রূপ নেয় ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন সৃষ্টির আদিতে প্রাণের বিকাশ হবার সাথে সাথেই প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বীতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রাণের অভিবিকাশের ধারায় প্রথমেই দুটি প্রজাতি রূপ পেয়েছিল – Vegetation and Animal অর্থাৎ উদ্ভিদ ও প্রাণী । উদ্ভিদজগতেও রয়েছে প্রচন্ড রেষারেষি-মারামারি ! একটা বড় উদ্ভিদ কখনও চায় না ছোট ছোট গাছগুলিকে বাড়তে দিতে – এমনভাবে বড় গাছটি বড় গাছটি ডালপালা , শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে যাতে ছোট গাছটির ডালপালা বা শাখা-প্রশাখা সূর্যালোক না পায় , খাবার তৈরী করতে না পারে এবং অবশেষে মারা পড়ে । প্রাণীজগতের শুরুতেও জীবাণু-বীজাণু-কীটাণুতেও চরম রেষারেষি-মারামারি পরিলক্ষিত হয় । অভিবিকাশে উন্নত প্রাণী অনুন্নত প্রাণীকে হত্যা করে তাকে খেয়েই নিজের জীবন ধারণ করে । এইভাবেই প্রথম শ্রেণীর খাদক-দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদক- সর্বোচ্চ শ্রেণীর খাদকের এক খাদ্যশৃঙ্খল তৈরী করেছেন জীববিজ্ঞানীরা ।
এইভাবে প্রাণের অভিবিকাশের জন্মলগ্ন থেকেই ‘হিংসা’-র শুরু ! জীবের বিবর্তনে ধাপে ধাপে প্রাণীর শরীরের পরিবর্তন ঘটতে থাকে ৷ Vegetation-এ যেখানে প্রাণের অভিবিকাশ ঘটেছিল Downward Movement দিয়ে , প্রাণীতে তা হ’ল Forward – অর্থাৎ উদ্ভিদজগতে প্রাণের প্রবাহশক্তি ছিল ঊর্দ্ধ থেকে নিম্নে(যার ফলে বৃক্ষাদি-র ডালপালা ছেঁটে দিলেও গাছটি মারা যায় না) , কিন্তু প্রাণীর অভিবিকাশে বীজাণু-জীবাণু-কীটাণু (Bacteria-Virus-Worms)-তে প্রাণের Movement-এ Forward বা সম্মুখগতির শুরু । মেরুদন্ডী প্রাণীর বিবর্তনের পুরো Period -টাকে গুরু মহারাজ বলেছিলেন “Horizontal Movement” ! এই Horizontal Movement -টা Vertical(upward) হয় নর-এ এসে । বানরে শুরু হলেও এটি সম্পূর্ণ রূপ পায় নর বা মানুষ-এ ।
সুতরাং “অধঃ মূলঃ ঊর্দ্ধশাখা” দিয়ে যে প্রাণের অভিবিকাশের সূচনা হয়েছিল তা সম্পূর্ণতা পায় মানবশরীরে – যেখানে “ঊর্দ্ধমূলঃ অধঃশাখাঃ” ৷ এবার আর প্রকৃতি অধীন– “Evolution” নয় – এবার মনুষ্য অধীন– “Involution” ! যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে জীব, প্রকৃতি বা Nature-এর অধীন ছিল , তখন তার সবটাই Natural ! তাই সেই অবস্থায় মারামারি, হানাহানি, রেষারেষিও স্বাভাবিক – কারণ এরা অহেতুক হিংসা করে না , জঙ্গলে একটা সিংহ বা বাঘ যদি একটি হরিণ শিকার করে তাহলে তার গোটা পারিবার সেইটা দিয়েই সাময়িক ক্ষুন্নিবৃত্তি করে এবং সেই দিন সেই মুহূর্ত্তে বাকি হরিণের পালটি কিন্তু জানে যে তাদের আজ আর কোন বিপদ নাই – তাই তারা একটু দূরেই নিশ্চিন্তে চড়ে বেড়ায় ।
অপরপক্ষে মানুষ মানুষকে মারে সম্পূর্ণ অন্য কারণে ! মানুষ মানুষকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না – তবু একে অপরের প্রতি ছুরি শানাচ্ছে ! এটাই প্রকৃতিবিরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”ধর্মের নামে পৃথিবীতে যত যুদ্ধ বা রক্তপাত হয়েছে, অন্য কোন কারণে এত বেশি হয় নি!” বিশ্বযুদ্ধ গুলিতে একসাথে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গেছে ঠিকই এবং ইতিহাসে বর্ণিত রাজায় রাজায় যুদ্ধেও কম লোক মরে নি, কিন্তু মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে বিচার করলে দেখা যাবে _গুরুমহারাজের কথা একেবারে সঠিক!!
এখন অর্থাৎ বর্তমানে তো প্রতিনিয়ত যেসব মানুষ মরছে _সেগুলি সবই ধর্মের নামে!
যে কোন ধর্মমতের মানুষেরা চায় যে, বাকিরা সবাই তার স্বমতে আসুক(যেটা সম্পুর্ন প্রকৃতিবিরুদ্ধ, কারন বৈচিত্রতাই প্রকৃতির ধর্ম।)। এর ফল ভালো হবে কি হবে না _এই নিয়ে কোন দুরদৃষ্টি নাই! আর তার প্রয়োজনও মনে করে না! শুধুমাত্র ঐ একটা sentiment – সবাইকে আমার ধর্মমতে নিয়ে আসতে হবে।
একসময় খ্রীষ্টানরা এটা খুবই করেছে (এখনও বিভিন্ন দরিদ্র – আদিবাসী ইত্যাদি অঞ্চলে খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজকেরা ধর্মান্তরনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।), নিজেদের ধর্মমতের প্রাধান্য বজায় রাখতে বেপরোয়া হয়েছে, যুদ্ধ করেছে। পরে ইসলামীয়রাও তাদের ধর্মমত প্রচার ও প্রসারের নামে দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে জোরজবরদস্তি – রক্তপাত – যুদ্ধ করেছে। ইসলামের একেবারে প্রথম সূত্রপাতের সময় থেকেই অর্থাৎ এই ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মুহাম্মদের সময় থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল (তিনি তাঁর জীবদ্দশায় স্বয়ং অস্ত্রহাতে তিনটি যুদ্ধ করেছিলেন _অহদের যুদ্ধ, বদরের যুদ্ধ এবং খন্দকের যুদ্ধ। )!
এইসবের ফলস্বরূপ পৃথিবী প্রথমেই উপহার হিসাবে পেয়েছিল খ্রীষ্টান ও ইসলামীয়দের লড়াই(যা ইতিহাসে ‘ধর্মযুদ্ধ’ নামে পরিচিত _প্রথম ক্রুসেড, দ্বিতীয় ক্রুসেড, তৃতীয় ক্রুসেড…………!)! পরবর্তীতে,গোটা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের _যে কোন মতাবলম্বীদেরকে স্বমতে আনার লড়াই! লড়াই চলছেই_তা এখনো থামে নি! তার একটাই অর্থ__পৃথিবী গ্রহণ এখন‌ও মোটেই উন্নত হয় নি!!! (ক্রমশঃ)