গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলছিলেন যুদ্ধের কথা ! উনি বলেছিলেন – “দেখবে, অহেতুক বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণ নিয়ে ঝগড়া-মারামারি করে অবোধ শিশুরা বা ছোট বয়সের অপরিণত বুদ্ধির ছেলে-মেয়েরা ! যে কারণগুলি নিয়ে শিশুরা ঝগড়া-ঝাঁটি করে – একটু বড় হয়ে গেলে কিন্তু তারা আর ঐ নিয়ে ঝগড়া করে না – তখন তাদের ঝগড়ার বিষয়বস্তু পাল্টে যায় ! ঠিক তেমনিভাবে দেখা যায় মনুষ্যসমাজে যত অপরিনত ও অসুস্থ চেতনার মানুষ-ই ঝগড়া-ঝাঁটি , মারামারি , রক্তপাত ঘটাতে ভালোবাসে ৷ মানবের চেতনা যত উন্নত হবে , ঝগড়া-লড়াই পৃথিবী থেকে তত কমে আসবে !”
এইজন্যেই গুরু মহারাজ প্রায়ই বলতেন – ” পৃথিবী গ্রহের চেতনা এখনও খুবই অনুন্নত ! পৃথিবী গ্রহ এখনও শিশু অবস্থায় রয়েছে , যেন ৪৫০/৫০০ কোটি বছরের শিশু ! সবে হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থা অতিক্রম করে দাঁড়াতে শিখেছে !”
তাহলে মানুষের চেতনার উত্তরণ হবে কিভাবে ? – উত্তরটা হচ্ছে _’একমাত্র মহাপুরুষগণের আগমনে’ । পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যত বেশী সংখ্যক মানুষ কোন না কোন মহাপুরুষের সরাসরি সংস্পর্শে আসে – সেই অঞ্চলের মানুষের চেতনা তত উন্নত হয়! কোন উন্নত আদর্শ অবলম্বন না করলে কখনই মানবের চেতনার অগ্রগতি সম্ভব নয় ।
তবে এখানে আর একটা কথা রয়েছে , যেটা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন – ‘ বাদশাহী আমলের মুদ্রা নবাবী আমলে চলে না’ । অর্থাৎ যুগ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগপুরুষের (মহাপুরুষ) শিক্ষার ধারা বদলে বদলে যায় । এইটাকে বুঝতে হবে — বিবর্তনের ধারায় ‘এগিয়ে চলা’-ই জগতের ধর্ম । তাই হাজার-হাজার বছরের পুরোনো কোন শিক্ষা বা সংস্কার-কে আঁকড়ে পড়ে থাকা মানেই প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করা ! আর এমনটা চলতে থাকলে মহাপ্রকৃতি কিছুতেই তা মেনে নেবে না ৷ তাকে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে নিয়ে আসার কাজ করবেই করবে !
যাইহোক , আবার আমরা পূর্বের আলোচনায় ফিরে যাই । গুরু মহারাজের কথা দিয়ে শুরু করা হয়েছিল যে হিংসা-রেষারেষি-মারামারি , উদ্ভিদজগতে-প্রাণীজগতে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান ৷ অর্থাৎ এটা প্রকৃতিগত ব্যাপার ! তাই বিবর্তনে ঐগুলির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসা মানুষ সর্বাপেক্ষা উন্নত প্রাণী হলেও, স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে ঐ প্রবৃত্তিগুলিও রয়ে গিয়েছে ।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”মানুষ যতই অন্যায় আচরন করুক না কেন _মানুষ কে ‘পশু’ – বলা উচিত নয়। এতে পশুকে অপমান করা হয়।” একথা কেন বলেছিলেন, তার একটা কারণ হতে পারে __অনুন্নত প্রাণীরা শুধুমাত্র বাঁচা এবং বাড়ার জন্য হিংসা করে, আর মানুষ তুচ্ছ কারণে, অকারণে , তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র Sentiment-কে প্রাধান্য দেবার জন্যে হিংসা করে _ মারামারি-হানাহানি করে – রক্তপাত ঘটায়! এটাই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ – মহাপ্রকৃতি এধরনের কাজকে বেশিদিন সহ্যও করেন না! তাই মানুষকে ‘উন্নত’ হোতেই হবে!!! আর এই উন্নতি _চেতনার উন্নতি!
সমাজের একেবারে নিচুস্তরে অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের বস্তিতে গেলে দেখা যাবে চারিদিকে নোংরা আবর্জনা ব্যাজব্যাজ্ করছে এবং প্রতিদিনই সেখানে ঝগড়াঝাঁটি চলছে, মারামারি _খুনখারাপি লেগেই আছে!
অপরপক্ষে professor’s colony কিংবা doctor’s colony-তে গেলে দেখতে পাওয়া যায় _কেমন সুন্দর, শান্ত, চুপচাপ পরিবেশ! একজনের সাথে আর একজনের দেখা হলে শুধু কুশল বিনিময় করেই যে যার কাজে চলে যাচ্ছে! সবার বাড়ির সামনেটায় ফুলের বাগান, চারিপাশটা পরিস্কার ঝকঝকে!!
এখানে হয়তো অনেকের মাথায় আসবে যে _এই পার্থক্যের কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি! কিন্তু তা নয়! কারণ বনে-জঙ্গলে আদিবাসী কোল-ভীল-সাঁওতালদের বস্তিতে যদি যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে _বস্তিটি কি পরিস্কার! কত রুচিপূর্ন তাদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি! যদিও অভাব_অবহেলা এগুলো সেখানেও খুবই রয়েছে!
সুতরাং ঝগড়া – মারামারি – হানাহানি-রক্তপাত অর্থনৈতিক কারণে , ধর্মনৈতিক কারণে , সামাজিক কারণে হয় না _শুধুমাত্র হয় মানুষের অনুন্নত চেতনার কারণে!!যে সমাজে যত বেশি সংখ্যক অনুন্নত চেতনার মানুষ রয়েছে _সেই সমাজে তত বেশি অসহিষ্ণুতা এবং এর ফলস্বরূপ তত বেশি সংঘাত – সংঘর্ষ – রক্তপাত!!
এই ব্যাপারটা মানুষকে বুঝতেই হবে এবং যুদ্ধচেতনা থেকে নিজেদের অন্তশ্চেতনাকে উপরে তুলে আনতেই হবে! নাহলে মানব জাতির অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে! কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম দুটো মুসলিম country _আফগানিস্তান এবং ইরাক, আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগের ফলে কিভাবে চোখের সামনে প্রায় ধ্বংস হওয়ার মুখে চলে গিয়েছিল ! এই ধংসলীলার কারণের দিকে নজর করলে দেখা যাবে _একদিকে কিছু মানুষের ধর্মনৈতিক অনুন্নত চিন্তাধারার উন্মাদনা এবং অপরদিকে কিছু শক্তিশালী (রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে) রাষ্ট্রের dominating tendency ( যা অনুন্নত চেতনারই ফল) এবং বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভদায়ক material _ভূগর্ভস্থ তেলের বাজারের দখলদারী নেওয়ার প্রচেষ্টা !!
এবার একবার reality – টা ভাবুন! ঐ দুটো দেশে কত বছর ধরে স্কুল – কলেজ-ইউনিভার্সিটি বন্ধ! প্রতি মুহুর্তে মানুষের মরনের ভয়! যে শিশুটি এখনি জন্মালো _তারও বাঁচার অনিশ্চয়তা! কখন কোথায় বোমা পড়বে, কে_কাকে_কখন মারবে, সব সময় ভয়! যেন সব সময় আতঙ্কে অতিষ্ঠ __সুন্দর এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুন্দর মানবজীবন!!
চোখের সামনে ঐরকম সমাজজীবনের বিভৎসতা দেখেও কি আমাদের শিক্ষা হবে না? আমরা কি এখনো চাইবো – – হ্যাঁ _হ্যাঁ যুদ্ধ হোক?? আমাদেরও ঐরকমই পরিনতি হোক???
কিন্তু আমরা চাইছি!আর চাইছি বলেই তো দ্রুত এগিয়ে চলেছি _দাঙ্গা – রায়ট-যুদ্ধের দিকে! এটা আমাদেরই আহাম্মকি বা মূর্খতা!!
আমরা না গর্ব করে বলি ___যে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য, সবচেয়ে উন্নত প্রানী–আমরা মানুষ!! এই আমাদের উন্নত মানসিকতা, উন্নত চেতনা ? এই চেতনা নিয়ে আমরা বলি _”আমি শ্রেষ্ঠ”_” আমার ধর্মমত শ্রেষ্ঠ “,” আমার মজহব শ্রেষ্ঠ “!!!
হায় রে একবিংশ শতকের ২০-লক্ষ বছরের বিবর্তনের শিশু মানব!!
গুরুমহারাজ এইজন্যেই একবার গভীর দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন _” জানো, মানুষকে খুব নীচু হয়ে দেখতে হয়! প্রতিদিন সাধারণ মানুষের সাথে communication করতে গিয়ে আমার চেতনাকে কয়েক light year যাওয়া-আসা করতে হয়!!!”(ক্রমশঃ)