গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের আলোচনা থেকে বিশ্ব তথা ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস এবং বিদেশীদের আক্রমণের যে ইতিহাস পাওয়া যায় , সেই সম্বন্ধে কথা হচ্ছিল । যাতে করে আমরা বর্তমান কালের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কারণটা যে সত্যি সত্যিই তুচ্ছ – অতি তুচ্ছ , সেই ব্যাপারে একটা ধারণা পাই ! বর্তমান আরব দেশগুলি বা বর্তমান ইউরোপের সভ্য দেশগুলির প্রাচীন ইতিহাস পড়লে দেখা যায় যে সব দেশেই মূর্ত্তিপুজা চালু ছিল , অগ্নি উপাসনা বা যাগ-যজ্ঞ হোত – অর্থাৎ ভারতীয় সংস্কৃতি-র প্রভাবে সম্পূর্ণরূপে প্রভাবান্বিত ছিল দেশগুলি । ২৫০০ বছরেরও বেশী আগে মহাবীর জৈন ভারতবর্ষে শরীর ধারণ করে প্রথম বেদবিরোধী বা বেদের প্রতিবাদী ধর্মমত (জৈন ধর্ম) প্রবর্তন করেন । গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ধর্মমতের শিক্ষা , দলে দলে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছিল এই মত । গবেষকরা বলেন যে পরেশনাথ , তারকনাথ , বৈদ্যনাথ , বিল্বনাথ ইত্যাদি যত ‘নাথ’ নামের শৈব তীর্থ রয়েছে , এগুলি বহুপূর্বে ‘জৈন’ তীর্থ ছিল (গোরক্ষনাথের যোগ-পরম্পরাও ‘জৈন’ পরম্পরার-ই শাখা বলেই গবেষকরা মনে করেন) , কোন সময় শৈব প্লাবনে এইগুলি সব শৈবতীর্থে রূপ নিয়েছে ৷ প্রায় ২৫০০ বছর আগে ভগবান বুদ্ধ শরীর নিয়েছিলেন । রাজার ঘরে জন্মেও সমস্ত ভোগ-সুখের মোহ ত্যাগ করে চরম কৃচ্ছ্বসাধন ও যোগ-সাধনার ফলে তিনি ‘বুদ্ধত্ত্ব’ অর্জন করলেন । তারপর প্রচার করলেন ‘বৌদ্ধধর্ম’ ৷ দলে দলে মানুষ বৗেদ্ধ ধর্মমত গ্রহণ করতে শুরু করল । সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধনী শ্রেষ্ঠী , রাজকর্মচারী এমনকি রাজন্যবর্গবাও বৌদ্ধ ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন ৷ বৌদ্ধ ধর্মমত ভারতবর্ষের বাইরের বিভিন্ন দেশেও (চীন , জাপান , মায়ানমার ইত্যাদি দেশে ) ছড়িয়ে পড়েছিল । ভারতবর্ষেও বৌদ্ধপ্লাবন ভাসিয়ে দিয়েছিল সাধারণ জনজীবন! প্রকৃতপক্ষে আচার্য্য শঙ্করের শরীর গ্রহণের পরে (অর্থাৎ প্রায় ১০০০ বছর আগে) ভারতবর্ষে পুনরায় বৈদিক অনুশাসন নতুনরূপে ফিরে আসে এবং জৈন ও বৌদ্ধ মতের শিক্ষাগুলির অনেকটাই আত্তীকরণ (Assimilation) হয়ে যায় । আধুনিক পুরাণকাররা দশাবতারে বুদ্ধকে অন্তর্গতও করে নেয় ৷ এইভাবে গবেষকরা দেখেছেন যে বর্তমানকালের ভারতবর্ষের যে কোন প্রাচীন হিন্দুতীর্থ__ প্রথমে সেখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কোন দেবতার পূজা কোরতো, পরে সেটি জৈন প্রভাবে পূজিত হোত , আরও পরে সেটি বৌদ্ধ মতে পূজিত হোত , আরও পরে সেটি বৈদিক পঞ্চশাখার (সৌর , শৈব , শাক্ত , গাণপত্য ও বৈষ্ণব) কোন না কোন মতে পূজিত হতে শুরু করেছে ।
এইবার আসছি ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আসা উল্লেখযোগ্য ধর্মমতগুলির কথায় ! আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে শরীর নিয়েছিলেন যীশুখ্রীষ্ট ৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল এই ধর্মমতের শিক্ষা – রোমান সম্রাটদের হাত ধরে ৷ এরপর ইউরোপীয় বণিকেরা যেখানেই ব্যাবসা-বাণিজ্য করতে গেল – সেখানেই ধর্মাচরন , ধর্মমতকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল । মানুষের এ এক আদিম প্রকৃতি ! ” আমার লেজ কেটেছে — তোরটাও কাটাতে হবে ” (লেজকাটা শিয়ালের গল্প) !!
আরবের মরুভূমিতে জন্মগ্রহণ করলেন “হজরত মুহাম্মদ”– আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে ! উনি ছিলেন তৎকালীন আরবজাতির ত্রাণকর্তা , ‘মহান’ অর্থে হজরত । সেইসময় যে বংশে উনি শরীর গ্রহণ করেছিলেন – তার নাম ছিল ‘কোরেশ’ (কুরু+ঈশ=কুরেশ/কোরেশ/কোরাইশ) বংশ ।৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন_ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কুরুবংশীয়রা পরাজিত হলে ওদেরই একটি শাখা ঐ সব অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে বসবাস করতে থাকে ৷ মহাভারতের যুগে – ঐ অঞ্চলের রাজারা কুরুবংশীয়দের মিত্ররাজ্য ছিল ৷ ভগদত্ত নগরী (বর্তমান বোগদাদ)-র রাজা কৌরবদের পক্ষে ছিল ৷ গান্ধারী , বর্তমান আফগানিস্থানের কান্দাহার বা গান্ধার প্রদেশের রাজকন্যা ছিল ! পারসিকরা(বর্তমান ইরান)-ও ভারতীয় সংস্কৃতির ই ধারক বা বাহক ছিল, কারণ তারা বৈদিক যাগজজ্ঞ বা অগ্নি উপাসনা কোরতো। আরবের মক্কায় হজরত মুহাম্মদের পূর্বপুরুষরাও কাবার মহাকাল মন্দিরের পূজারী ছিলেন। ইতিহাস থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে হজরতের নেতৃত্বে যখন ঐ মন্দির আক্রমণ করা হয় তখন ওখানে ১০০-র ও বেশি মূর্তি ছিল।
যাইহোক, বেদবিরোধী বা প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমত ভারতবর্ষেই সৃষ্টি হয়েছিল, তাই এই মত গুলি আদতে ভারতীয় ই। অন্যদুটি প্রধান ধর্মমত খ্রীষ্টীয় এবং ইসলাম _ভারতের বাইরে থেকে এদেশে ঢুকেছিল। কিন্তু তাতেও সমস্যা হয়তো হোত না _কারণ ইসলাম ধর্মের উন্নত সাধকেরা ভারতবর্ষে এসে সুফিসাধক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা পীর-পয়গম্বর হিসাবে হিন্দু-মুসলিম উভয় মতের মানুষের কাছে আজও শ্রদ্ধার্হ। যাইহোক, সমস্যাটা হোল অন্যখানে_সেইটা আলোচনা করা যাক।
রাজতন্ত্রের যুগে (ইতিহাসের মধ্যযুগ) রাজন্যবর্গের একটা স্বাভাবিক প্রবনতা ছিল _কিছুটা শক্তিশালী হয়ে উঠলেই পাশাপাশি রাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেওয়া! এই ভাবে রাজ্যবিস্তারের আকাঙ্খায় হোত যুদ্ধ (‘রাজা’ মারা পড়ত কম, মারা পড়ত হাজারে হাজারে সৈনিক ও সাধারণ মানুষ, আজও তাই মরে)!
কিন্তু যখন থেকে বিদেশী শাসকেরা, ভারতবর্ষের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অংশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে এখানে বসবাস করতে শুরু করল, তখন থেকেই অধিকৃত অঞ্চলের দখল চিরস্থায়ী করার জন্য এবং অন্তরের অতৃপ্ত আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য, নিজের নিজের আচরিত ধর্মমত জোরজবরদস্তি পরাজিত রাজ্যবাসীর উপর চাপাতে শুরু করে দিল।
গোলমালটা শুরু হোল এখানেই! যার যা কাজ _তার তো তাই করা উচিত! প্রকৃত স্বত্বগুনী ধর্মগুরুরা যদি ধর্মপ্রচার করতেন _তাহলে মোটেই গোলমাল হোত না! রজোগুনী রাজন্যবর্গের দ্বারা (অথবা তাদের মনোমত বেতনভোগী বা অন্যান্য বিশেষ সুবিধাভোগী কোন পাদ্রী,যাজক, মোল্লা,মৌলভীদের দ্বারা) ধর্মমত প্রচার হোলে গোলমাল তো হবেই! খ্রীষ্টানরা আবার ছিল আর এককাঠি উপরে!! তারা ছিল বৈশ্য_অর্থাৎ রজোস্তমঃ গুনসম্পন্ন! তাদের ধর্মান্তরনের পদ্ধতি ছিল__ প্রথমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও, তারপর ধর্মান্তর করো।
ইসলামীয়দের ক্ষত্রিয় পদ্ধতি_এমনিতে আমাদের মত মানো, নাহলে জোর করে মানাবো!
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বাইরে থেকে আসা ঐ ধর্মমতগুলির সার অংশ ভারতবর্ষের মতো ‘অধিকৃত’ দেশসমূহের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছালোই না! থেকে গেল প্রকৃত ধর্মগুরু বা সুফি সাধকদের কাছে!! (ক্রমশঃ)
এইবার আসছি ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আসা উল্লেখযোগ্য ধর্মমতগুলির কথায় ! আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে শরীর নিয়েছিলেন যীশুখ্রীষ্ট ৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল এই ধর্মমতের শিক্ষা – রোমান সম্রাটদের হাত ধরে ৷ এরপর ইউরোপীয় বণিকেরা যেখানেই ব্যাবসা-বাণিজ্য করতে গেল – সেখানেই ধর্মাচরন , ধর্মমতকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল । মানুষের এ এক আদিম প্রকৃতি ! ” আমার লেজ কেটেছে — তোরটাও কাটাতে হবে ” (লেজকাটা শিয়ালের গল্প) !!
আরবের মরুভূমিতে জন্মগ্রহণ করলেন “হজরত মুহাম্মদ”– আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে ! উনি ছিলেন তৎকালীন আরবজাতির ত্রাণকর্তা , ‘মহান’ অর্থে হজরত । সেইসময় যে বংশে উনি শরীর গ্রহণ করেছিলেন – তার নাম ছিল ‘কোরেশ’ (কুরু+ঈশ=কুরেশ/কোরেশ/কোরাইশ) বংশ ।৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন_ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কুরুবংশীয়রা পরাজিত হলে ওদেরই একটি শাখা ঐ সব অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে বসবাস করতে থাকে ৷ মহাভারতের যুগে – ঐ অঞ্চলের রাজারা কুরুবংশীয়দের মিত্ররাজ্য ছিল ৷ ভগদত্ত নগরী (বর্তমান বোগদাদ)-র রাজা কৌরবদের পক্ষে ছিল ৷ গান্ধারী , বর্তমান আফগানিস্থানের কান্দাহার বা গান্ধার প্রদেশের রাজকন্যা ছিল ! পারসিকরা(বর্তমান ইরান)-ও ভারতীয় সংস্কৃতির ই ধারক বা বাহক ছিল, কারণ তারা বৈদিক যাগজজ্ঞ বা অগ্নি উপাসনা কোরতো। আরবের মক্কায় হজরত মুহাম্মদের পূর্বপুরুষরাও কাবার মহাকাল মন্দিরের পূজারী ছিলেন। ইতিহাস থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে হজরতের নেতৃত্বে যখন ঐ মন্দির আক্রমণ করা হয় তখন ওখানে ১০০-র ও বেশি মূর্তি ছিল।
যাইহোক, বেদবিরোধী বা প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমত ভারতবর্ষেই সৃষ্টি হয়েছিল, তাই এই মত গুলি আদতে ভারতীয় ই। অন্যদুটি প্রধান ধর্মমত খ্রীষ্টীয় এবং ইসলাম _ভারতের বাইরে থেকে এদেশে ঢুকেছিল। কিন্তু তাতেও সমস্যা হয়তো হোত না _কারণ ইসলাম ধর্মের উন্নত সাধকেরা ভারতবর্ষে এসে সুফিসাধক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা পীর-পয়গম্বর হিসাবে হিন্দু-মুসলিম উভয় মতের মানুষের কাছে আজও শ্রদ্ধার্হ। যাইহোক, সমস্যাটা হোল অন্যখানে_সেইটা আলোচনা করা যাক।
রাজতন্ত্রের যুগে (ইতিহাসের মধ্যযুগ) রাজন্যবর্গের একটা স্বাভাবিক প্রবনতা ছিল _কিছুটা শক্তিশালী হয়ে উঠলেই পাশাপাশি রাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেওয়া! এই ভাবে রাজ্যবিস্তারের আকাঙ্খায় হোত যুদ্ধ (‘রাজা’ মারা পড়ত কম, মারা পড়ত হাজারে হাজারে সৈনিক ও সাধারণ মানুষ, আজও তাই মরে)!
কিন্তু যখন থেকে বিদেশী শাসকেরা, ভারতবর্ষের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অংশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে এখানে বসবাস করতে শুরু করল, তখন থেকেই অধিকৃত অঞ্চলের দখল চিরস্থায়ী করার জন্য এবং অন্তরের অতৃপ্ত আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য, নিজের নিজের আচরিত ধর্মমত জোরজবরদস্তি পরাজিত রাজ্যবাসীর উপর চাপাতে শুরু করে দিল।
গোলমালটা শুরু হোল এখানেই! যার যা কাজ _তার তো তাই করা উচিত! প্রকৃত স্বত্বগুনী ধর্মগুরুরা যদি ধর্মপ্রচার করতেন _তাহলে মোটেই গোলমাল হোত না! রজোগুনী রাজন্যবর্গের দ্বারা (অথবা তাদের মনোমত বেতনভোগী বা অন্যান্য বিশেষ সুবিধাভোগী কোন পাদ্রী,যাজক, মোল্লা,মৌলভীদের দ্বারা) ধর্মমত প্রচার হোলে গোলমাল তো হবেই! খ্রীষ্টানরা আবার ছিল আর এককাঠি উপরে!! তারা ছিল বৈশ্য_অর্থাৎ রজোস্তমঃ গুনসম্পন্ন! তাদের ধর্মান্তরনের পদ্ধতি ছিল__ প্রথমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও, তারপর ধর্মান্তর করো।
ইসলামীয়দের ক্ষত্রিয় পদ্ধতি_এমনিতে আমাদের মত মানো, নাহলে জোর করে মানাবো!
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বাইরে থেকে আসা ঐ ধর্মমতগুলির সার অংশ ভারতবর্ষের মতো ‘অধিকৃত’ দেশসমূহের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছালোই না! থেকে গেল প্রকৃত ধর্মগুরু বা সুফি সাধকদের কাছে!! (ক্রমশঃ)