গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ গিরি মহারাজের নানা বিষয়ের উপর আলোচনা করা কথাগুলির চর্চা হচ্ছিল এই Page-এ ৷ আজকে যে বিষয়টি আলোচনা করার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা আসছে তা হোল –শ্রীম কথিত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কথামৃত’ নামক গ্রন্থে এমন কিছু কিছু কথা রয়েছে , যেগুলি আমরা পড়ি কিন্তু তার মধ্যে ছোট ছোট কথাগুলির মধ্যেও যে গভীর মর্মার্থ রয়েছে – তার ভিতরে ঢুকি না ! গুরু মহারাজ সেইরকম অনেক কথার কিছু কিছু ব্যাখ্যা করেছিলেন ! সেগুলির যতটা পারা যায় – আলোচনা করা যাক্ ৷
“শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” গ্রন্থের ১ম খন্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সংকলক মহেন্দ্র গুপ্ত বা ‘শ্রীম’-র সাথে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎকারের দিনে , সন্ধ্যার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন , ভাবছেন ভিতরে যাওয়া ঠিক হবে কি হবে না ! ঘরে ধুনা দেওয়া হয়েছে – তার গন্ধে চারিদিক ম ম করছে ! দ্বাদশ শিবমন্দির , রাধাকান্তের মন্দির এবং ভবতারিণীর মন্দিরে সবে আরতি সম্পন্ন হয়েছে । মাষ্টারমশাই কলকাতার ভদ্র , শিক্ষিত মানুষ , যেহেতু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরটির দরজা বন্ধ ছিল – তাই তিনি পরমহংস সাধুটির (তখন মাষ্টারমশাই ঐ হিসাবেই জানতেন) সাথে দেখা করে একটু ধর্মকথা শ্রবণের ইচ্ছা থাকলেও – ভিতরে ঢুকতে ইতস্ততঃ করছিলেন !
এই অবস্থায় দেখলেন যে , একজন বয়স্ক মহিলা , যার নাম ‘বৃন্দে’ , তিনি ঠাকুরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন । মাষ্টারমশাই নামটি জেনেছিলেন এবং তিনি যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর-বারান্দা ধোওয়া মোছা করতেন বা ঠাকুরের অন্যান্য কাজও করে দিতেন – তাও জানতেন । তাই মাষ্টারমশাই ওই মহিলাকে ‘বৃন্দে’ (ঝি) নামে উল্লেখ করেছেন!
যাইহোক , এইবার “শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত”-এর প্রথম জিজ্ঞাসা উত্তরের উপস্থাপন রয়েছে ‘বৃন্দে’-র সাথে মাষ্টারের কথোপকথন !
মাষ্টার : – হ্যাঁগা ! সাধুটি কি ভিতরে আছেন ?
বৃন্দে :- হ্যাঁ , এই ঘরের ভিতর আছেন ।
মাষ্টার :- ইনি এখানে কতদিন আছেন ?
বৃন্দে :- তা – অনেকদিন আছেন ।
মাষ্টার :- আচ্ছা ! ইনি কি খুব বই-টই পড়েন ?
বৃন্দে :- অার বাবা বই-টই ! সব ওর মুখে ৷
–– আর আমাদের বাকি কথোপকথনের প্রয়োজন নাই ! এইবার আমরা চলে যাই গুরু মহারাজের আলোচনায় !
গুরু মহারাজ একদিন বনগ্রামে এই কথাগুলির অবতারণা করে বললেন – যে কোন অবতার পুরুষ বা মহাপুরুষ শরীর ধারণ করে যখন যেখানে থাকেন , তখন তাঁর চারিপাশের বাতাবরণেও তার প্রভাব পড়ে ৷ ঐ মহাপুরুষের জীবনে কত সাধন-ভজন-তপস্যা , কত ত্যাগ-বৈরাগ্য , সংযম! তারপর সাধনার একটা একটা স্তর অতিক্রম করতে করতে সর্ব্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যাওয়া ! প্রতিটি স্তরে সিদ্ধি এবং ঐশ্বর্য্যলাভ ! অবতার পুরুষের সাধন-ভজন না করলেও হয় – তবু তাঁরা করেন, যেন একবার ঝালিয়ে নেন ! তিনি নিজের জীবনে সাধন-ভজন , জপ-তপ করে যেন সেইগুলিরই মাধুর্য্য বাড়িয়ে দেন , ঐ সাধন পদ্ধতিগুলিকে আরও একটু বেশী শক্তিশালী করে দেন !
যাইহোক , পূর্ণত্বপ্রাপ্ত ঐ মহাপুরুষগন যখন যেখানেই থাকুন না কেন – তাঁকে ঘিরে অর্থাৎ তাঁর চারিপাশে একটা আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল গড়ে ওঠে ৷ সেই পরিমন্ডলে যারাই থাকে , সে মানুষ-ই হোক বা জীব-জন্তু , ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী – সকলেরই চরম আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়! গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”অবতারপুরুষের মাথায় যদি উকুন থাকে অথবা শরীরের অভ্যন্তরে কোন কৃমি-কীটাদি জন্ম নেয় _তারাও পরবর্তী শরীরে সরাসরি মনুষ্যশরীর প্রাপ্ত হয়।”
ভাবুন একবার! লক্ষ লক্ষ জন্মের বিবর্তন এক শরীরেই হয়ে যায়! তাহলে কৃমি-কীটাদিরা যদি লক্ষ লক্ষ জন্মের বিবর্তনে এগিয়ে যায় _তাহলে তাঁর পরিমন্ডলে থাকা মানুষজনের কি অবস্থা হোতে পারে!
সাধে গুরুমহারাজ উপস্থিতজনেদের আশ্বাস দিয়ে বলতেন _” রাজধানী এক্সপ্রেসে যখন উঠেই পড়েছিস _তখন আর চিন্তা কি? ছোটাছুটি, লাফালাফি করেই বা কি হবে? সবাই একসাথেই তো রাজধানীতে পৌঁছাবে!”
আবার বলতেন _” জাতসাপে ধরলে তিন ডাক! যে যাই করিস _তিনজন্মের মধ্যে পূর্ণ হোতেই হবে!”
কোন সময় বলতেন_” কি আর করবি_আমাকে একটু স্মরণ-মনন করবি, তাতেই হবে!”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি এই চেতনায় পৌঁছেই লিখেছিলেন _” এই জনমে ঘটালে কত জন্ম জন্মান্তর! সুন্দর হে সুন্দর!”
কথা শুরু হয়েছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃন্দে(ঝি) – র প্রসঙ্গ নিয়ে! মহেন্দ্রনাথ তাকে বৃন্দে(ঝি) হিসাবেই পাঠকদের পরিচয় করিয়েছেন, কিন্তু ঐ অশিক্ষিত, বয়স্কা মহিলার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে জ্ঞানের চরমসীমার কথা _”আর বাবা বইটই! সব ওনার মুখে!”
গুরুমহারাজ এই জায়গাটিই point out করেছিলেন! উনি বলেছিলেন _”তখনকার দিনের(আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে) কোন খেটে খাওয়া ঘরের বয়স্কা মহিলার, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে ধারণা(conception)-কত clear!কত নিঃশংসয় ঐ মহিলা!
আমরা রসিক মেথরের কথা, আড়িয়াদহ গ্রামের মসজিদের মোয়াজিমের কথা, কলকাতার বারবনিতাদের কথা _ইত্যাদি অনেক সাধারণ মানুষের কথা (যারা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাপ্রাপ্ত) _কোন না কোন গ্রন্থে একটু আধটু পড়েছি! কিন্তু বৃন্দে(ঝি) – কে নিয়ে গুরুমহারাজ যেদিন আলোচনা করলেন_সেদিন যেন নতুন করে আমাদের একটা দিগন্ত খুলে গেল! সত্যিই তো! এমন করে তো কখনো ভাবিনি!!! (ক্রমশঃ)