গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা বলতে গিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা এসে গেছে ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ‘শ্রীম’ অর্থাৎ মহেন্দ্র গুপ্তকে প্রথম দিকের কথোপকথনে ‘বিয়ে করে ফেলেছে’ – বলে শিহরিত হয়েছিলেন , এই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল । আর এই প্রসঙ্গ করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল গুরু মহারাজ এবং চক্ষণজাদীর টগর মল্লিকের ঘটনা ! সেখানেও ঐ একই ধরনের একটা ব্যাপার ঘটেছিল – তাই এই উপস্থাপনা !
গুরু মহারাজ বিবাহের বিরোধী ছিলেন না ৷ তিনি নিজে বহু ছেলে বা মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ৷ ওনার রুরাল ইলেকট্রিফিকেশনের কাজ করার সময়কার বন্ধু বিমল সোমের বিবাহ উনি প্রায় নিজের হাতে সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে দিয়েছিলেন ! আমরাও দেখেছি _সিটিং চলাকালীনসময়ে অথবা কারও বাড়ীতে উনি গেলে, কোন বয়স্কা মা হয়তো ওনাকে তার মেয়ের বা ছেলের বিবাহের জন্য একটা ভালো পাত্র বা পাত্রী দেখে দিতে বলতেন ! উনি কখনই বলেন নি যে , “আমি সন্ন্যাসী ! আমাকে কোন স্পর্ধায় তোমরা এ সব বলছো ?” – না , এই ধরনের কথা কখনোই উনি বলেননি ! বরং উনি সস্নেহে সেই মা-টির কথা শুনেছেন এবং শেষে বলেছেন – ” তাহলে আশ্রমে (বনগ্রামে) গিয়ে মুরারি মহারাজের সাথে যোগাযোগ করে নিও – দেখবে ঠিকই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে !” গুরু মহারাজ শরীরে থাকাকালীন যে সমস্ত গুরু ভাই-বোনেদের বিবাহ হয়েছিল , তাদের সবার দাম্পত্য জীবন যে একেবারে ষোলআনা পারফেক্ট হয়েছে – এমনও নয় ! কিন্তু তবুও মানুষ ওনার কাছে এসে তাদের সন্তানদের বিবাহের কথা বলতে ছাড়তো না !
একবার ন’কাকার সেজদা (যিনি দুর্গাপুরে থাকেন) উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বনগ্রামে মুখার্জিবাড়ির সান্ধ্যসিটিং-এ আফশোষের সুরে গুরু মহারাজকে বলেছিলেন – ” জানো ঠাকুর ! তোমার সাথে যদি আমার বিবাহের পূর্বে সাক্ষাৎ হোত , তাহলে আমি আর এই সাংসারিক জীবনে আসতাম না ! সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে তোমার সঙ্গে থেকে তোমার কাজ করতাম !” একথা শুনে সাথে সাথেই গুরু মহারাজ বলে উঠলেন – ” সেকি বলছেন সেজো কাকা ! এতদিন ধরে আমার সঙ্গ করলেন – তাও এ কথা বলছেন ! বিবাহ করেছেন বলে কি আপনি নিজেকে ‘হীন’ ভাবেন নাকি ? তাতে কি হয়েছে , আমিও পূর্ব পূর্ব জীবনে অনেকবার বিবাহ করেছি ! কয়েকটি শরীরে আমার সন্তানাদিও ছিল ৷ এই শরীরে আমি স্বামী পরমানন্দ ! আমার সন্ন্যাস জীবন। কিন্তু যখন যে ‘রোল’-টা মা জগদম্বা আমায় দিয়েছেন , সেটা আমি যথাযথভাবে (perfectly) পালন করার চেষ্টা করেছি ! আপনিও সেটাই করুন ! আমার সাথে দেখা হবার পর কত ছেলেমেয়েই তো বিবাহ করল , আমি নিজে অনেকের বিবাহের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি ! কই –আমার সাথে বিবাহের আগে দেখা হয়েছিল বলে তারা তো সবাই সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী হয়নি ! ওটা ‘সংস্কার’ সেজোকাকা ! যার সংস্কারে যা আছে – তাকে তাই করতে হবে! কারোর গৃহী সংস্কার – তাকে গৃহী হতে হবে ৷ আবার কারো সন্ন্যাসী সংস্কার _যত চেষ্টাই করা হোক না কেন , সমস্ত বাধা কাটিয়ে সন্ন্যাসী তাকে হতেই হবে ৷ এই ভাবেই মহামায়ার জগতে লীলা হয়ে চলেছে ৷”
এই কথাগুলো বলা হোল এইজন্য যে, এর মধ্যে দিয়ে গুরু মহারাজের একরকম একটি রূপ আমরা দেখলাম । এইবার অন্য রূপ টার কথা বলি – অর্থাৎ পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে যাই! ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে বনগ্রাম ঠাকুরদাস আশ্রম পরমানন্দ মিশন প্রতিষ্ঠা হবার পর যে Batch-টি ( যে ব্যাচে মিহির মহারাজরা ছিল) গুরু মহারাজের কাছে ব্রহ্মচর্য সংস্কার নেবার জন্য Enlisted হয়েছিল – তাদের মধ্যে চক্ষণজাদীর টগর মল্লিকের নামও ছিল ৷ টগর মল্লিকের মাকে গুরু মহারাজ গর্ভধারিনী জননীর মর্যাদা দিতেন । সেই মা বলে বসলেন – ” বাবা ! আমার যে বড় ইচ্ছা ছিল আমার বড় ছেলের বিবাহ দেব ! আমার বউমা ও নাতির মুখ দেখবো !”
ব্যস ! গুরু মহারাজ_ মায়ের মুখ থেকে এই কথা শোনার পরই ব্রহ্মচর্য‍্যের List থেকে টগর মল্লিকের নাম বাদ দিয়েছিলেন !
এরপর গুরুমহারাজের guardianship – এ টগর মল্লিকের বিবাহ হয়েছিল (details-এ যাবো না, কারণ টগরদা মোটেই চায় না যে, তার কথা কোনভাবে লেখা হোক!! কিন্তু ইতিহাস তো ছেড়ে কথা কইবে না, মানুষ একদিন না একদিন ‘সত্য’ – খুঁজে বের করবেই। তাই, নাহয় আজকেই খানিকটা হয়ে যাক্!)!
গুরুমহারাজ নিজে সন্ন্যাসী, তাই বিবাহের দিন চক্ষনযাদীর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না _তবুও ঐ বাড়ির বড়ছেলে(গুরুমহারাজ ঐ নামেই ঐ বাড়ীতে পরিচিত ছিলেন) হিসাবে উনি সমস্ত কর্তব্যই সম্পন্ন করেছিলেন। এইভাবেই মা-য়ের ইচ্ছার প্রাধান্য দিয়ে টগরের বিবাহ হল এবং কিছুদিন পর মা নাতির মুখও দেখলেন। এরপর বহুবছর কেটে গেছে _গুরুমহারাজ শরীর ছেড়ে চিন্ময়লোকে চলে গেছেন! একদিন টগর মল্লিক গেছে রায়নায় গুরুমহারাজের আর এক মা(জগাদার মা)-র কাছে ।খাওয়া দাওয়ার পর ওরা মা-ব্যাটায় গুরুমহারাজের নানা কথা নিয়ে আলোচনা করছিল। হটাৎ করে রায়নার মা(জগাদার মা) টগরকে বলেন – “তুমি বাবা, একদিন আমার ছেলেকে(গুরুজী) খুব কাঁদিয়েছিলে!”
এই কথা শুনে টগর মল্লিক তো অবাক! এমনিতে ওদের দুজনের (গুরুজী এবং টগর) মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে _আবার পরক্ষণেই ভাব হয়ে গেছে!
কিন্তু টগরের কোন কাজে বা কথায় গুরুমহারাজ কাঁদছেন__এটা কি করে হয়? _এ তো ভাবাই যায় না! তাই ব্যগ্র হয়ে টগর রায়নার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল_”হ্যাঁগো মা! আমি তো কিছুই জানি না! আমি দাদা-কে(গুরুমহারাজ) কষ্ট দিয়েছি? কি এমন অন্যায় আমি করেছি যে _উনি আমার কারনে চোখের জল ফেলেছেন?”
জগাদার মা সহজ সরল মানুষ! উনি বলেছিলেন _ “কারণ-টারন জানি না বাবা! তবে তোমার বিবাহের দিনে ছেলে আমার কেঁদে বালিস ভিজিয়ে দিয়েছিল!অনেকক্ষণ উপরে উঠেছে _নামছেই না দেখে আমি উপরে উঠে দেখি বাছা আমার কাঁদছে! আমি ছুটে গিয়ে মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে চোখ মুছিয়ে বললাম _’তোমার কি হয়েছে গোপাল _যে তুমি এমনধারা চোখের জল ফেলছ?’
আমার গোপাল উত্তর দিয়েছিল _’ জানো মা! আজ আমার টগরের বিয়ে হয়ে গেল!!”(ক্রমশঃ)