[[গুরু মহারাজের সাথে আমাদের জয়দেবের (কেন্দুবিল্ব) মেলায় দেখা হবার ঘটনা বলা হচ্ছিল ।]
গুরু মহারাজ সব্যদাকে নিয়ে তারাপীঠ থেকে বক্রেশ্বর হয়ে- গিয়েছিলেন জয়দেব কেন্দুবিল্ব! ওনারা যখন গিয়েছিলেন _তখন কিন্তু মেলার সময় ছিল না! জয়দেবে অনেক সাধু-সন্ত, বাউল-বৈষ্ণবদের আখড়া রয়েছে ৷ ওইসব সাধুবাবারা বছরের বেশীরভাগ সময়ে ওখানেই থাকেন ৷ এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য আশ্রমগুলি হ’ল জয় শংকর বাবা, মনোহর দাস বাবাজী, সুধীর দাস বাবাজী, ভবা পাগলা, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ইত্যাদি মহাসাধকদের আশ্রম ৷ পৌষ-সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে অস্থায়ী অনেক আখড়া ওখানে বসে – কিন্তু স্থায়ী আশ্রমও অনেক রয়েছে । গুরু মহারাজ সব্যদাকে নিয়ে মেলার আগে বা পরে কোনসময় গিয়েছিলেন । ওনারা উঠেছিলেন একটা আশ্রমে – সম্ভবত ঐসময় ওখানে দু-রাত্রি ওনারা ছিলেন ৷ প্রথম রাত্রিতে তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি – কারণ ওনারা সেইদিনই সন্ধ্যার সময় ওখানে পৌঁছেছিলেন ৷ কিন্তু পরের দিন বিভিন্ন আখড়ায় ঘোরার সময় ওনারা খবর পান যে সেদিন সন্ধ্যার সময় তমালতলায় সুধীর বাবার আশ্রমে সঙ্গীতের আসর বসবে ৷ ওখানকার সাধক বাউলেরা এবং বাইরে থেকে আসা অতিথি সাধক বাউলেরাও ওই আসরে গান গাইবে ৷ এনারা পয়সা নিয়ে গান করা শিল্পী-বাউল নন — এঁরা সাধক শিল্পী অর্থাৎ এঁরা সঙ্গীতের মাধ্যমে সাধনা করেন – সঙ্গীতই সাধনা ৷
সব্যদা প্রকৃত বাউল সাধক দেখতে চেয়েছিল, কারণ গুরু মহারাজের লেখা ‘বাউলের মর্মকথা’ বইটিতে বাউলদের জীবনকথা , তাঁদের সাধনপদ্ধতি , কিছু গোপন রহস্য — এসব পড়ে ওর কৌতুহল বেড়ে গেছিল ৷ সেইসময় আমরা দেখেছিলাম গুরু মহারাজের কাছে যাওয়া বেশীরভাগ ভক্তের মধ্যেই বাউল বা বাউল গান সম্বন্ধে interest এবং জীবনে একটু বাউল-বাউল ভাব আনার প্রবণতা তৈরী হয়েছিল ৷ বনগ্রাম আশ্রমে ফাল্গুন-সংক্রান্তিতে উৎসবের রাতে বাউল শিল্পীদের উদাত্ত কন্ঠের গান , তাদের চিত্রিত-বিচিত্র সাজ-পোষাক এবং উদাত্ত প্রাণকাড়া সুরে , গাব – গুবা – গুব্ বাজনা বাজিয়ে নেচে নেচে গাওয়া “ভোলামন — মন রে আমার …….” – এগুলিও হয়তো তৎকালীন “আমাদের”-কে বাউল বা বাউলগানের প্রতি আকৃষ্ট হতে সাহায্য করেছিল । সর্বাপেক্ষা বড় কারণ অবশ্যই বাউলবেশী ভগবান পরমানন্দের উপস্থিতি !
সুতরাং সব্যদার মধ্যেও এই ভাব খুবই বিদ্যমান ছিল। ‘বাউলের মর্মকথা’ বইটিতে গুরু মহারাজ আলোচনা করেছেন _বাউলদের “নারী নিয়ে সাধন” এবং “নারী বর্জিত সাধন” সম্পর্কে । ‘বিশুদ্ধ বাউল’ বা ‘উদাস বাউল’ কি বা কারা_ তাও আলোচনা করেছেন সবিস্তারে! তাছাড়া আমরা যারা সংসারী মানুষ অর্থাৎ বিয়ে-থা করা লোক , তাদের “নারী নিয়ে সাধন”-এর ব্যাপারে একটু বেশী কৌতুহল তো থাকবেই । সুপ্রীম কোর্ট আজ (২০১৮) যাই রায় দিক না কেন _ভারতীয় প্রাচীন বাউল-বৈষ্ণব সাধনায় কিন্তু “পরকীয়া” সাধন পদ্ধতি বহু পূর্ব থেকেই স্বীকৃত ! পার্থক্য একটাই , এই “পরকীয়া” শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়-লালসা চরিতার্থের জন্য নয় – সাধন করে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বা কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্বকে জাগ্রত করে তাকে উর্দ্ধগতি প্রদান জন্য। যাতে একে একে এই শক্তি মূলাধার , স্বাধিষ্ঠান , মণিপুর , অনাহত , বিশুদ্ধ – ইত্যাদি চক্র বা গ্রন্থিগুলিকে ভেদ করে আজ্ঞাচক্রে গিয়ে স্থিত হতে পারে । ব্যস্ ! তাহলেই জীবের পুরুষকার শেষ ! জীবের নিজস্ব অগ্রগতি , তার সাধনার লক্ষ্য সব অন্তিম পর্যায়ে এসে পৌঁছে গেল ! এবার আর “চাওয়া” নয় – শুধু “চেয়ে থাকা” !
আজ্ঞা চক্র থেকে সহস্রার — স্থূলে এই ‘দেড় আঙুল’ পরিমাণ রাস্তার জন্য আবার নতুন শরীর , নতুন সাধন , নতুন নতুন আস্বাদন! এখান থেকে সহস্রারের পথে যারা যাত্রা শুরু করেছে সেইসব সহজ বাউলরাই বলতে পারে —
” সহস্রারে হয় রসের স্থিতি –
বেদ-বিধি তায় নাইকো গতি !” ।
এইসব কথা গুরু মহারাজের কাছে শোনার পর বিশুদ্ধ বাউল , উদাস বাউল , ‘নারী নিয়ে সাধন’
‘নারী বর্জিত সাধন’ _ইত্যাদি নিয়ে কৌতুহল তো আমাদের হবেই! সব্যদা সৌভাগ্যবান যে ওর আর্জি গুরুমহারাজ মন্জুর করেছিলেন এবং ওকে সঙ্গে করে নিয়ে জয়দেব কেঁদুলিতে বাউল আখড়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
সেদিন সন্ধ্যায় তমালতলায়(জয়দেব) সুধীর দাস বাবাজীর আশ্রমে বাউলদের আসর বসেছিল। ঘরোয়া আসর, সঙ্গীত সাধনার আসর! সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে শরীরের কুলকুন্ডলিনীর উর্দ্ধমুখী হবার আসর! বাউলগানের সূরে সূরে ‘ভান্ডে ব্রম্ভান্ড তত্ত্বে’-র ব্যাখ্যার আসর!
সেই আসরে আরো একটা ব্যাপার ছিল _সেটা হচ্ছে এই আসরে উপস্থিত স্বয়ং মহাবাউল! বাউলবেশী ঈশ্বরতত্ত্বের মূর্ত প্রকাশ!!
সুতরাং ওখানে যা ঘটবার তাই ঘঠল! সেদিনকার বাউলগানের আসর কি এক অজ্ঞাত কারণে খুবই জমে গেল! উপস্থিত বাউল শিল্পী বা সাধকদের মধ্যে একটা উন্মাদনা চলে এল! সকলেই দেহতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, বাউলতত্ত্বের গানে এমন মশগুল হয়ে গেল যে কারো আর স্থান-কাল-পাত্রের খেয়ালই থাকল না। ঐ আখড়া থেকে শুধুই সৃষ্টি হচ্ছিল সঙ্গীত আর সঙ্গীত _যেন মহাসঙ্গীতের মহাসূরের সাথে সেদিনকার জয়দেব-কেঁদুলির তমালতলার সূর একাকার হয়ে গিয়েছিল।
সব্যদার দাবী ছিল _শিল্পী বাউল নয় __প্রকৃত বাউল, আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত কোন বাউল কে দেখার! এবার ওর সেই সখটাও মিটল!
ওই স্থানে সঙ্গীতের কলরোল চলতে চলতেই দেখা গেল এক বৃদ্ধ বাউল(ব্যক্তিটি কে ছিল সেটা গুরুমহারাজকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি, সম্ভবত উনি সুধীর দাস বাবাজীই ছিলেন) _আত্মহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আসরে উপস্থিত লোকজনের গায়ের উপর দিয়ে (যেন কোন বাধাই বাধা নয়) গুরুমহারাজের দিকে (উনি সবার পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন) চলে আসছেন! উনি অঝোরে কাঁদছিলেন আর মুখে শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছিলেন _”বড় আনন্দ দিলে গো দয়াল_বড় আনন্দ দিলে!”