গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা হচ্ছিল । পুরোনো কথা – অনেক দিন আগের কথা ! বনগ্রাম আশ্রম তৈরীর কিছুটা আগের কথা অথবা আশ্রম তৈরীর গোড়ার দিকের কথা ! তখনকার দিনের গুরুমহারাজের বলা কিছু কথা অথবা সেই সময়কার ঘটা কোন ঘটনার কথা!! অবশ্য এখন যে কথা গুলি আলোচনা হচ্ছে – তার উৎস ছিল “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” – গ্রন্থের প্রণেতা শ্রীম-র সাথে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রাথমিক সাক্ষাৎকারের সময়কার কিছু কথোপকথন । যার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে এখানে গুরু মহারাজ ও টগর মল্লিকের সম্পর্কের কথাও এসে পড়েছে ! এখন প্রশ্ন একটাই – কেন এমন হয় ? সবার ক্ষেত্রেই যে মহাপুরুষগণ ‘বিবাহ’ হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেন তা নয় – কিন্তু কিছু মানুষের জন্য তাঁদের এই আক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে ! এইটার ব্যাপারটা কি ?
প্রথমেই আলোচনা করা যাক – সাধারণ মানুষ আর উন্নত মানুষের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে ! সত্যি সত্যিই পৃথিবীতে মনুষ্য জগতে Senior বা Junior রয়েছে ! উন্নত চেতনার মানুষই Senior , অর্থাৎ যাদের বিবেকের জাগরন ঘটেছে এবং চেতনার উত্তরণ ঘটেছে । জন্মচক্রের বিবর্তনে যারা বহু পূর্বে মনুষ্য-শরীর পেয়েছে এবং বারবার জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে কিছুটা সময় (তার আয়ুষ্কাল) কাটিয়ে যাচ্ছে তারা Senior ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “জীবন যেন এক একটা অভিজ্ঞতার সিঁড়ি ৷ যে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মানুষ এগিয়ে চলে পূর্ণত্বের দিকে !” সত্যিই তো – মানব শরীর লাভ করে মানুষের জীবনে কত সংগ্রাম , কত ঘাত-প্রতিঘাত , কত উত্থান-পতন – অভিজ্ঞতা লাভ তো হচ্ছেই ! সুতরাং , বহুবার যারা মনুষ্য শরীরে জন্মগ্রহণ করেছে – তারা তো Senior বটেই !
আমরা একবার গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” গুরুজী ! ভাবতে অবাক লাগে যে , এখন যারা লেখাপড়ায় পন্ডিত , উচ্চ উচ্চ ডিগ্রির অধিকারী তাদেরও মৃত্যুর পর যখন আবার নতুন শরীর হবে , তখন তারা আবার শিশু অবস্থায় এ বি সি ডি অথবা অ আ ক খ পড়বে মায়ের কাছে! তারাও মাস্টারের কাছে পড়ার জন্য কান মলা খাবে !! আবার দেখুন গুরুজী ! শরৎচন্দ্র , বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষেরও তো আবার জন্ম হবে বা শরীর হবে I তারা এই নতুন শরীরে তাদের নিজেদের লেখা বইগুলোই তো পড়বে ? অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – তিনিও কি নিজের লেখা কবিতাগুলো মুখস্ত করবেন ?”
গুরু মহারাজ এই কথা শুনে খুব হেসেছিলেন ! তারপর বললেন – ” এটাই তো জগৎ রে ! ‘পুনরপি জননং পুনরপি মরনং, পুনরপি জননী জঠরে শয়নং’!
ব্যাপারটা কিরকম হয় জানিস_এই জন্মে যারা খুব শিক্ষিত পন্ডিত, তারা যদি কোনভাবে অভিশাপগ্রস্ত না হয় – তাহলে তারা পরজন্মে খুব ছোট বয়স থেকেই পড়াশোনায় খুব ভাল স্টুডেন্ট হবে , গরীবের ঘরে জন্ম নিলেও অথবা প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যে থাকলেও তাদের পড়াশুনার অগ্রগতির কোন খামতি হবে না ।
এইরকমই_ লেখক বা শিল্পীদের ক্ষেত্রেও ঘটবে! তারাও নিজ নিজ ক্ষেত্রের অনুকুল পরিবেশ পাবে এবং বিকশিত হবে ৷ সে যদি চায় তাহলে সেই শরীরে তার আরও ঐ ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা লাভ হবে । পূর্ব জন্মের কবিরা ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখার , চিত্রশিল্পী ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার , পণ্ডিতেরা – ছোট থেকেই একনিষ্ঠ পড়ুয়া হবার অনুপ্রেরণা নিয়েই নতুন শরীরে জন্ম নেবে।
কিন্তু জানিস তো – মহামায়ার জগতে এমন ফাঁদ পাতা আছে যে , সবকিছু মসৃণ গতিতে সরল রেখায় চলে না ৷ অবশ্য গতির নিয়মই তরঙ্গাকার – একবার উঁচু একবার নিচু ৷ মানুষের জীবন প্রবাহে (জন্ম জন্মান্তর)-ও তাই দেখা যায় , মানুষও একভাবে চলে না, একপথে চলতে চলতে সে নিজেই Track change করে! বেশিরভাগই এইরকম হয়, তবে রবীন্দ্রনাথ পর পর সাত জন্ম নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তারই ফলস্বরূপ – বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ।”
তাহলে আমরা দেখলাম যে,এই জগতে senior – junior ব্যাপারটা রয়েছে ।সেটা পার্থিব বয়স দিয়ে সবসময় বিচার হয় না -জন্ম জন্মান্তরের বয়স দিয়ে বিচার হয়।গুরুমহারাজ বলেছিলেন, শুকদেবের কথা! ব্যাসদেব পুত্র শুকদেব। রাজা পরীক্ষিত যখন অভিশাপগ্রস্থ হয়ে জানতে পারলেন যে তাঁর আয়ুঃস্কাল আর মাত্র সাতদিন _তখন তিনি পাগলের মতো ঋষি-মুনিদের কাছে ছুটে ছিলেন এমন কোন বিধান নেবার জন্য, যা করলে তাঁর মাত্র সাতদিনেই মোক্ষলাভ হয়! তাঁরা বলেছিলেন _এটা হোতে পারে একমাত্র _ব্যাসপুত্র শুকদেবের মুখ থেকে ‘ভাগবত’ পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনলে! রাজা বহু কষ্টে সব ব্যবস্থা করেছিলেন। নৈমিষারন্যে এই আসর বসেছিল। পরম ভাগবত শুকদেবের তখন এই শরীরের বয়স ছিল মাত্র ষোড়শ বর্ষ, কিন্তু সেই পাঠ ও ব্যাখ্যা শোনার জন্য রাজা পরীক্ষিত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শত শত প্রাচীন বিজ্ঞ পন্ডিতেরা, এমনকি শ্বেত শুভ্র শ্মশ্রুকেশ বিশিষ্ট মুনি-ঋষিরাও! “আশ্চর্য বক্তা – কুশল শ্রোতা!”
গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন -“মহাপুরুষগণ(সদগুরু ) কারোকে দীক্ষা দেবার সময় তার পূর্ব পূর্ব সাতজন্ম দেখে নেন।”
আবার একসময়ে বলেছিলেন -“তোরা যখন কাউকে দেখিস -তখন তোরা শুধু তার বর্তমান দেখেই দোষ-গুন বিচার করিস–আর আমি যখন কাউকে দেখি তখন তার এই শরীরটাকে –অনেকজন্মের এবং বহুশরীরের একটা gist হিসাবে দেখি।এইখানেই তোদের সাথে আমার বিচারধারা পার্থক্য হয়ে যায়।”
আমরা এসব কথা ওনার মুখে শুনে মনে মনে বলতাম -“হে প্রভু! সে তো হবেই! আমরা সাধারণ মানুষেরা যে অজ্ঞানী! আমরা বুদ্ধি দিয়ে, আইন-আদালত দিয়ে, পঞ্চায়েত ডেকে মানুষের বিচার করি!কিন্তু সেই বিচার তো অসম্পূর্ণ হবেই! তুমিই ঠিক -তুমিই যথার্থ প্রভূ!! চিরনির্ভূল ,চিরশাশ্বত সত্য তোমার বিচারধারা!” !!
যাইহোক, ভাবালুতা কাটিয়ে আবার আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।মানুষের মধ্যেই junior-senior রয়েছে –এই প্রসঙ্গে গুরুমহারাজ বলেছিলেন -“সাধারণভাবে সমাজে ‘সাম্যবাদ’-বলে যে কথাটা রয়েছে –ঐ কথাটাই ভুল! প্রকৃতিতে ঐ ধরনের সাম্যের কোন স্থান নেই!প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈচিত্র্যময়তা -আর সেই বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্যের মূলসূরটি রয়েছে, সেইটি সাম্য! এই সাম্যের বোধ হলে –তখনই সবকিছুতে সাম্য দর্শন হয়, অন্যথায় সবই কথার কথা -সবই বুজরুকি! !
পৃথিবীতে সবকিছুই অনিত্য বা পরিবর্তনশীল! প্রাগোৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় ও লয় —এই ষট্-বিকারের মধ্যে দিয়েই জগতের সবকিছু পরিনতি লাভ করে।
এটা একটা গতি -একটা গতিশীলতা !এর মধ্যে দিয়েই জগতের যা কিছু অগ্রগতি, প্রগতি হয়ে থাকে!
সুতরাং এটা নিশ্চয়ই বোঝা গেল যে, ‘সাম্য’-রয়েছে ‘বোধে’_কোন ‘বাদে’ সাম্য নাই ।বোধে ‘সাম্য’-এলে দেখা যায় _এই জগতসংসারের সবকিছুই কেমন সাম্যে রয়েছে–সবকিছুই কেমন ঠিকঠাক, কোথাও কোন গন্ডগোল নাই -বিশৃঙ্খলা নাই -সবই ব্রহ্ম, ব্রহ্মময় জগৎ!”
কিন্তু এগুলো সব শেষের কথা! সাধক তার অন্তর্জগতের গভীরে অন্তর্লীন হলে, যোগমার্গের একটি একটি সোপান পেড়িয়ে -‘ধারনা’ পাকা হলে, তবেই ‘ধ্যানে’র গভীরে প্রবেশলাভ ঘটে! ধ্যানের গভীরতায় আসে ‘সমাধি’! তখনই আত্মবোধ,ব্রহ্মবোধ বা বোধে বোধ হয়! !
যে জীব একদিন একটামাত্র কোষ নিয়ে জীবনের বিবর্তনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল_সমাধিতে তার পরিপূর্ণতা, চরম পরিসমাপ্তি!! এইভাবেই প্রতিটি জীব জন্ম জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে জীবনপ্রবাহের সূদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় । junior থেকে senior হবার এটাই ক্রম! “নান্যং পন্থা বিদ্যতে হয়নায়।”(ক্রমশঃ )