গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের আলোচনা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে আমরা একটা প্রসঙ্গ থেকে নানা প্রসঙ্গে চলে এসেছিলাম । তাই এবার এই সমস্ত আলোচনার একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করা প্রয়োজন । একটা জিজ্ঞাসা এসেছিল যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এবং আমাদের পরমারাধ্য গুরুদেব স্বামী পরমানন্দ তাঁদের নিজ নিজ কোন ভক্ত বা হয়তো অন্তরঙ্গ ভক্তের বিবাহ নিয়ে আক্ষেপ করেছেন , দুঃখ করেছেন , এটা কেন ? এটাও দেখানো হয়েছে যে – জীবের যে বাঁচার বা বাড়ার ধর্মকে কিন্তু তাঁরা কখনোই অস্বীকার করেন নি ! কারো কারো ক্ষেত্রে – তাঁদের এই রূপ আচরণ – কিন্তু কেন ? গুরুমহারাজের কথা দিয়েই আলোচনা করা যাক –
” ‘ব্রহ্মচর্য’ এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনো পৃথিবী গ্রহে সেভাবে ঠিকমতো বলাই হয়নি ! মহাপুরুষগণ পৃথিবীতে অনেক কথাই বলতে আসেন , কিন্তু এখানকার মানুষের উপযুক্ততার অভাবে , সেসব কথা না বলেই তাদের চলে যেতে হয় !” – গুরু মহারাজ আরও অনেক কথা বলেছিলেন ৷ এ ব্যাপারে তিনি যা Hints দিয়েছিলেন তাতে এইটুকু আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে , পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বীর্যধারন করাটাই যে ব্রহ্মচর্যের একমাত্র সংজ্ঞা – তা নয় ! জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই ‘সংযম’ – থাকাটাই প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মচর্য ! ‘সংযম’ প্রসঙ্গে গুরু মহারাজ পরম গুরুদেবের (হিমালয়ের রামানন্দ অবধূত) শিক্ষার কথা বলেছিলেন – ” খাও পিও – চাখো মৎ , দেখো ভালো – তাকো মৎ , চল ফিরো – থকো মৎ , বোলো বালো – বকো মৎ ।” এই কথা গুলির ব্যাখ্যা করলে হবে – শরীর রক্ষার জন্য খাওয়া-দাওয়া নিশ্চয়ই করতে হবে কিন্তু তা tasty করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়া নয় , জগত সংসারে বাস করে ভালো মন্দ সব কিছু দেখতে হবেই (চোখ রয়েছে যখন) – কিন্তু কোন কিছুতে যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ(আটকে যাওয়া) হয়ে না যায় – তাহলেই সাধক ফেঁসে যেতে পারে , জগত সংসারে শরীর নিয়ে জীবন কাটানোর জন্য চলাফেরা করতেই হবে কিন্তু কোন স্থানে কোন মোহের বাঁধনে আবদ্ধ হলে চলবে না ! কোন স্থানে আটকে পড়া মানেই সাধনার বা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির রুদ্ধতা ! পরম গুরুদেবের আর একটি শিক্ষা ছিল – জীবনে কথাবার্তা বলতেই হবে – কিন্তু সেই কথা যেন ‘বকওয়াশ’ না হয় , অর্থাৎ ” ঈশ্বরীয় কথা-ই কথা আর সব-ই ফতা(বাজে কথা) !!”
এসব কথা বলার পর গুরু মহারাজ বহু প্রাচীন একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন – সম্রাট অশোকের মেয়ে সংঘামিত্রার জীবন কাহিনী । যেখানে পরম নিষ্ঠাবতী , বুদ্ধগতপ্রাণা , পরম সাধিকা , ভিক্ষুনী সংঘামিত্রার সুসংযমী জীবনে (এই কাহিনী গল্প কথা প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে) , মনোজগতে অর্থাৎ চিন্তাজগতে অতি সামান্য বিচ্যুতি ঘটার জন্য পরবর্তী জন্মে তাকে নগরবধূর জীবন কাটাতে হয়েছিল!
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ব্যবহারিক (জীবনের যেটা আমরা প্রত্যক্ষ করি) বাহ্যিক নিয়ম-নিষ্ঠা , ত্যাগ-বৈরাগ্য , আহার-বিহার , ভোগে অনীহা – এইসব তথাকথিত সংযমের থেকেও মনোজগতের সংযম অনেক বেশি শক্তিশালী ! “মনে-প্রাণে”– বলে বাংলায় একটি কথা আছে ! প্রকৃতপক্ষে প্রাণায়াম-এর দ্বারা প্রাণকে সংযত করতে পারলে মনঃসংযম হয় – আর মন সংযত হলে সাধকের আর ভয়ের কিছু থাকেনা ! প্রথমে সে ‘নির্ভয়’ হয় , শেষে ‘অভয়’ হয় !
এইসব ভারী ভারী কথা বলার পর গুরুমহারাজ অবশ্য এটাও বলেছিলেন যে – ” শুধু বীর্যধারন করে কোন সাধক যদি এই বীর্যশক্তিকে শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে দিতে পারে – তাহলে শুধুমাত্র যে তার শরীর রূপে টলমল করে উঠবে তাই নয় , ওই সাধক জীবনে কিছু একটা করে মহাকালের বুকে ‘দাগ’ রেখে যাবেই !
উনি কতকগুলি প্রাকৃতিক ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন, বলেছিলেন _”যে সমস্ত হাতি জীবনে কোনদিন ‘মেটিং’ করেনি _তাদেরই মাথায় ‘গজমোতি’ জন্মায! কস্তুরী মৃগের সুগন্ধি কস্তুরী উৎপন্ন হওয়ার জন্যও পুরুষ হরিণের বীর্যশক্তিই দায়ী!”
প্রাচীন কালে কোন বিশেষ প্রজাতির সাপের মাথায় ‘মনি’ _থাকার যে গল্প প্রচলিত রয়েছে, গুরুমহারাজ তারও উল্লেখ করেছিলেন। উনি বলেছিলেন _”বহুবছর বেঁচে থাকা বিষধর সাপেরা(ঐ বিশেষ প্রজাতির সাপ, যারা হয়তো বর্তমানে অবলুপ্ত), যারা জীবনে কখনো ‘মেটিং’ – এর সুযোগ পায় নি __তাদেরই মস্তিষ্কে ঐ ধরনের একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ সঞ্চয় হোত। যেটি মাথার একেবারে উপরের অংশে একটা ছোট টিউমার বা শিং-এর মতো মনে হোত এবং সেখান থেকেই তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হোত। এমনিতেই বিষধর সাপেরা দিনের বেলায় কমই বের হয়_তাই রাতে খাবারের সন্ধানে ঐ ধরনের কোন সাপ বাইরে এলে সেটি কোন মানুষের চোখে পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক!এখন আর ঐ প্রজাতির সাপ চোখে কেউ দেখতে পায় না _তাই সবাই ভাবে ওটা কাল্পনিক।
দ্যাখো, সব কিছু কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়াটাও আহাম্মকি! জেনে রাখবে _’কল্পনাকে আশ্রয় করে কল্পনা করা যায় না, কোন না কোন বাস্তবকে কেন্দ্র করেই মানুষের কল্পনা রূপ পরিগ্রহ করে’।”
যাইহোক, এইসব কথা বলে উনি আমাদেরকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে মনুষ্যেতর প্রানীর বীর্যধারনে যদি এত চমৎকারীত্ব থাকে, তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের ক্ষেত্রে এটি রক্ষায় কত বেশি ‘চমৎকার’ – দেখা যেতে পারে! উনি বলেছিলেন _” বাউল বলে_ মানুষ তখন হয় ‘মানুষরতন’! ”
এক্ষেত্রে কেমনটা হোতে পারে _তার একটু আধটু ইঙ্গিতও উনি দিয়েছিলেন! যেমন _প্রথমেই সেই ব্রহ্মচারীর বীর্যশক্তি সমস্ত শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়বে এবং বিদ্যুৎশক্তির ন্যায় ক্রিয়াশীল হবে। ফলে সেই শরীরে তখন নানান পরিবর্তন ঘটে যাবে। ঐ সাধকের গায়ের রঙ কালো থাকলে _তা ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে যাবে। মুখমন্ডলের গঠনের কোন অসাম্য থাকলে _তা নিটোল হয়ে যাবে_ফলে মুখমন্ডলটি মানুষের কাছে ‘সুন্দর’ – বলে প্রতীয়মান হবে! চোখের উজ্জ্বলতা দারুণ ভাবে বেড়ে যাবে! শরীরে রোগ-প্রতিষেধক ক্ষমতা প্রচন্ড বেড়ে যাবে! শরীরে খাদ্যগ্রহন এবং ঘুমের প্রয়োজনীয়তা খুবই কমে যাবে! অত্যধিক পরিশ্রমেও শরীর সহসা ক্লান্ত হবে না! অল্প খাদ্য গ্রহণেও শরীরে পুষ্টির অভাব ঘটবে না _সৌরশক্তির সাহায্যে সরাসরি পুষ্টি বা ক্ষয়পুরন হয়ে যাবে। শরীরে সবসময় বৈদ্যুতিক শক্তি ক্রিয়াশীল থাকায় উনিও সকলের ছোঁয়াচ মুক্ত থাকতে চাইবেন, আবার কেউ আচমকা তাঁকে ছুঁয়ে ফেললে _সে ইলেকট্রিক শক্ খাবার অনুভূতি পেতে পারে! _ইত্যাদি আরো অনেক কিছু কথা গুরুমহারাজ বলেছিলেন, তাঁর সব কথা তো মনে নাই _তাই তাঁর বলা সব কথা
কখনো বলতেও পারবো না। মহামতি পাঠকেরা তাদের নিজ নিজ ক্ষমতায় বাকিটা বুঝে নেবেন!!
তাহলে আমরা এটুকু বুঝতে পারছি যে _ভগবান যখন লীলা করতে বা জগৎ কল্যাণ করতে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে আসা সেনানীরা(ভগবানের পার্ষদ) যদি শরীরে এবং মনে সুদৃঢ় না হন_তাহলে অজ্ঞানতার অন্ধকারে পড়ে থাকা, মহামায়ার মায়ায় আঁঠার মতো আটকে থাকা _অসহায় মানুষজনেদের কারা টেনে টেনে তুলবে!!! তাই পার্ষদদের ব্যাপারে তিনি এত বেশি স্নেহশীল এবং যত্নশীল!! তাঁদের ‘এতটুকু’ অসুবিধা যেন তাঁর বুকে ‘এতো বড়’ হয়ে বাজে!!! (ক্রমশঃ)