গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – প্রকৃত ব্রহ্মচর্য-সম্পন্ন পুরুষদের মধ্যে প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ আপনা আপনিই সঞ্চারিত হয়ে যায়! যোগ সাধনার ‘প্রযত্ন শৈথিল্য’ ও ‘অনন্ত সমাপত্তি মনঃ’ – যে দুটি ক্রমের কথা বলা হয়েছে – যার দ্বারা প্রাকৃতিক যে কোন শক্তি ( ঝড় , ভূমিকম্প , বন্যা অগ্নিকাণ্ড , বজ্রপাত)-কে শরীরে আকর্ষণ করে – সেই শক্তির অধিকারী হওয়া যায় ৷ সেই শক্তির সমান শক্তি লাভ করা যায় , ফলে ওই সাধনায় সিদ্ধ যোগী ইচ্ছা মাত্রই যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারেন অথবা যে কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় কে আটকে দিতে পারেন । গুরু মহারাজ বলে ছিলেন একনিষ্ঠ সংযমী ব্রহ্মচারীর মধ্যে এই ধরনের শক্তি এমনিতেই ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হতে থাকে – তাকে আলাদা করে ‘প্রযত্ন শৈথিল্য’ সাধনা করতে হয় না ৷
গুরু মহারাজ তাঁর নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন – ” আমি যখন ছোট বয়সে হিমালয়ের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলগুলিতে ঘুরে বেড়াতাম, তখন অনেক মহাত্মার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল – যাঁরা হয়তো হাজার বছর বা আরও বেশি সময় ধরে শরীর ধারণ করে রয়েছেন – যাদের অনেক সিদ্ধি করায়ত্ত! অণিমা-লঘিমা-মহিমাদি সিদ্ধি তাঁদের কাছে যেন তুচ্ছ [ হিমালয়ে ঘোরার সময় অনিমা সিদ্ধির এক সাধকের সাথে স্বামী বিবেকানন্দেরও দেখা হয়েছিল – উনি পাহাড়ি জঙ্গলাকীর্ণ পথে চলার সময় এক স্থানে মূত্রত্যাগাদি ক্রিয়া করার জন্য যেই উদ্যত হয়েছিলেন – অমনি একটা তীব্র আওয়াজ শুনে উনি চমকে উঠেছিলেন ৷ পরে বুঝতে পারেন ঐখানে ঐ গাছের নিচে কোন উন্নত অনিমা সিদ্ধি যোগী ( এই সিদ্ধিতে অনুবৎ হয়ে থেকে যাওয়া যায় , প্রয়োজনে পুরো শরীরে প্রকটও হতে পারেন)।]!
সেই সময় (হিমালয় ঘোরাকালীন) অনেক মহাত্মা আমাকে নানারকম শিক্ষা দিত – ‘এইটা করতে হয় , ওইটা করতে হয় ! এমনভাবে করতে হয় , তেমনভাবে করতে হয় !’ – আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম – ” ওই রকম করলে কি হয় ?” ওনারা নানারকম সিদ্ধি – নানান অনুভূতি বা উপলব্ধির কথা বলতেন ! আমি সেই সব শুনে চুপ করে যেতাম – দেখতাম ওনারা যেগুলি বলছেন – সেগুলি automatically আমার করায়ত্ত হয়েই আছে ! কখন যে চুপিসারে সেই সব শক্তি আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে – আমি বুঝতেই পারিনি !
দ্যাখো, সেই অর্থে ছোটবেলা থেকে আমার মধ্যে এটা-ওটা লাভ করার কোনো চাহিদাই ছিল না ! আমি শুধু সত্যকে ধরে এগিয়ে চলতাম – জানতে চাইতাম __ সত্য কি ? প্রকৃত সত্য কি ? what is reality ?
ব্যস ! ঐটা করতে গিয়েই দেখলাম আনুষাঙ্গিক যা কিছু, সে সবই আমার জীবনে আপনা-আপনিই ঘটে গেছে !
ওইসব স্থানে সত্য সত্যই যাঁরা উন্নত মহাত্মা তাঁরা আমাকে বিশেষ মর্যাদাও দিতেন ! হয়তো ভাবতেন ছোট বয়সের শরীরে কোন যোগী ঘুরে বেড়াচ্ছে ! অনেক মন্ডলেশ্বর তাদের আশ্রমের ভার – তার শিষ্যদের ভার আমাকে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তো জানতাম আমি কি জন্য এসেছি ! তাই কখনই কোথাও আটকা পড়িনি ! এই বনগ্রামে এসেই আমি ফেঁসে গেছি !” – এই বলে উনি খুব মিষ্টি করে হেসে দিয়েছিলেন !
গুরু মহারাজের কথা যতই বলা হবে – তার আর শেষ হবে না ! কাজেই আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই ৷ ভগবান বা অবতারপুরুষেরা অথবা কোন মহাপুরুষরা যখনই আসেন – তখন তারা একটা নির্দিষ্ট project নিয়েই আসেন ! ওনারা শরীরে ততদিনই থাকেন যতদিন না project টা fullfil হয় ! তারপরই ওনারা পার্থিব শরীরটাকে জীর্ণ শুকনো পাতার মতো ত্যাগ করে চিন্ময় লোকে চলে যান । চলে যান অর্থে – আবার মানবকল্যাণের নিমিত্ত নতুন project fullfil করার জন্য নতুন শরীর গ্রহণের প্রস্তুতি নেন !
আর যে কাজটা তিনি রেখে গেলেন তার দায়িত্ব নেয় _তাঁর সঙ্গে আসা উন্নত মানবেরা! এই পৃথিবী গ্রহে শরীর ধারণ করাটাই তো একটা বিরাট সমস্যার ব্যাপার! তারপরে আবার সেই জীবনে সাধন পথে অবিচল থেকে এগিয়ে চলা আরও কত কষ্টের!! এগিয়ে চলার পথে শুধু সংগ্রাম এবং বাধা! শরীরের রোগ-ব্যাধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়,পারিবারিক – সামাজিক – অর্থনৈতিক – রাজনৈতিক সমস্যা__আরও কত সমস্যা!!
সাধারণ সংসারী মানুষ নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, বিষয়-আশয়, ব্যবসাপত্র, চাকরি বাকরি নিয়েই ব্যস্ত থাকে! সমাজের বাকিদের দিকে বিশেষত অবহেলিত, বঞ্চিত সমাজের নিচুতলার মানুষের দিকে কে চাইবে? সর্বত্যাগী নিঃস্বার্থ সন্ন্যাসী ছাড়া কে সবসময় তাদের পাশে পাশে থাকবে?
‘বহুজনহিতায় – বহুজনসুখায়’ –অর্থাৎ অপরের হিতে এবং অপরের সুখস্বাচ্ছন্দ বিধানের জন্যই এরা আত্নসুখ বিসর্জন দিয়েছে_সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছে!
তাছাড়া ছোট বয়স থেকেই ব্রহ্মচর্য্য পালন করায় এঁদের শরীর নিরোগ, মজবুত এবং প্রচন্ড জীবনীশক্তিসম্পন্ন হয়! প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও অল্প খাদ্যগ্রহন, অত্যল্প নিদ্রাতেও এই আত্নসুখত্যাগীদের নিজের কাজে কোন বিচ্যুতি ঘটে না!
সুতরাং ভগবানের আরব্ধ কাজ এঁরা ছাড়া আর কারা সম্পন্ন করবে! ভগবানের সাথী হয়ে বারবার আসার, এঁদের মধ্যে সবার হয়তো অভিজ্ঞতা থাকে না _কিন্তু বারবার মানবশরীর ধারণ করে সাধন-ভজন করার অভিজ্ঞতা এদের সবার আছে!!
তাই ভগবান লীলাশরীর সংবরন করে নেবার পরেও _ওঁদের মধ্যে যাঁরা থেকে যান, তাঁরাই সমাজের বাকি মানুষদেরকে সাধন-পথের সন্ধান দেন, তাদেরকে জীবন পথের পাথেয় দেন!
এঁদের দেখানো পথ ধরে চ’লে সমকালীন মানুষেরা উপকৃতও হন_এইভাবে চলতে থাকে পরম্পরা!! বর্ষে বর্ষে দলে দলে মানুষ আসে, আবার তারা চলেও যায়। মানুষ পাল্টায়, পরম্পরা রক্ষাকারীরা পাল্টায় কিন্তু পরম্পরাগত ভাবে ‘পরম্পরা’ – টা থেকেই যায়!! (ক্রমশঃ)
গুরু মহারাজ তাঁর নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন – ” আমি যখন ছোট বয়সে হিমালয়ের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলগুলিতে ঘুরে বেড়াতাম, তখন অনেক মহাত্মার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল – যাঁরা হয়তো হাজার বছর বা আরও বেশি সময় ধরে শরীর ধারণ করে রয়েছেন – যাদের অনেক সিদ্ধি করায়ত্ত! অণিমা-লঘিমা-মহিমাদি সিদ্ধি তাঁদের কাছে যেন তুচ্ছ [ হিমালয়ে ঘোরার সময় অনিমা সিদ্ধির এক সাধকের সাথে স্বামী বিবেকানন্দেরও দেখা হয়েছিল – উনি পাহাড়ি জঙ্গলাকীর্ণ পথে চলার সময় এক স্থানে মূত্রত্যাগাদি ক্রিয়া করার জন্য যেই উদ্যত হয়েছিলেন – অমনি একটা তীব্র আওয়াজ শুনে উনি চমকে উঠেছিলেন ৷ পরে বুঝতে পারেন ঐখানে ঐ গাছের নিচে কোন উন্নত অনিমা সিদ্ধি যোগী ( এই সিদ্ধিতে অনুবৎ হয়ে থেকে যাওয়া যায় , প্রয়োজনে পুরো শরীরে প্রকটও হতে পারেন)।]!
সেই সময় (হিমালয় ঘোরাকালীন) অনেক মহাত্মা আমাকে নানারকম শিক্ষা দিত – ‘এইটা করতে হয় , ওইটা করতে হয় ! এমনভাবে করতে হয় , তেমনভাবে করতে হয় !’ – আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম – ” ওই রকম করলে কি হয় ?” ওনারা নানারকম সিদ্ধি – নানান অনুভূতি বা উপলব্ধির কথা বলতেন ! আমি সেই সব শুনে চুপ করে যেতাম – দেখতাম ওনারা যেগুলি বলছেন – সেগুলি automatically আমার করায়ত্ত হয়েই আছে ! কখন যে চুপিসারে সেই সব শক্তি আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে – আমি বুঝতেই পারিনি !
দ্যাখো, সেই অর্থে ছোটবেলা থেকে আমার মধ্যে এটা-ওটা লাভ করার কোনো চাহিদাই ছিল না ! আমি শুধু সত্যকে ধরে এগিয়ে চলতাম – জানতে চাইতাম __ সত্য কি ? প্রকৃত সত্য কি ? what is reality ?
ব্যস ! ঐটা করতে গিয়েই দেখলাম আনুষাঙ্গিক যা কিছু, সে সবই আমার জীবনে আপনা-আপনিই ঘটে গেছে !
ওইসব স্থানে সত্য সত্যই যাঁরা উন্নত মহাত্মা তাঁরা আমাকে বিশেষ মর্যাদাও দিতেন ! হয়তো ভাবতেন ছোট বয়সের শরীরে কোন যোগী ঘুরে বেড়াচ্ছে ! অনেক মন্ডলেশ্বর তাদের আশ্রমের ভার – তার শিষ্যদের ভার আমাকে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তো জানতাম আমি কি জন্য এসেছি ! তাই কখনই কোথাও আটকা পড়িনি ! এই বনগ্রামে এসেই আমি ফেঁসে গেছি !” – এই বলে উনি খুব মিষ্টি করে হেসে দিয়েছিলেন !
গুরু মহারাজের কথা যতই বলা হবে – তার আর শেষ হবে না ! কাজেই আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই ৷ ভগবান বা অবতারপুরুষেরা অথবা কোন মহাপুরুষরা যখনই আসেন – তখন তারা একটা নির্দিষ্ট project নিয়েই আসেন ! ওনারা শরীরে ততদিনই থাকেন যতদিন না project টা fullfil হয় ! তারপরই ওনারা পার্থিব শরীরটাকে জীর্ণ শুকনো পাতার মতো ত্যাগ করে চিন্ময় লোকে চলে যান । চলে যান অর্থে – আবার মানবকল্যাণের নিমিত্ত নতুন project fullfil করার জন্য নতুন শরীর গ্রহণের প্রস্তুতি নেন !
আর যে কাজটা তিনি রেখে গেলেন তার দায়িত্ব নেয় _তাঁর সঙ্গে আসা উন্নত মানবেরা! এই পৃথিবী গ্রহে শরীর ধারণ করাটাই তো একটা বিরাট সমস্যার ব্যাপার! তারপরে আবার সেই জীবনে সাধন পথে অবিচল থেকে এগিয়ে চলা আরও কত কষ্টের!! এগিয়ে চলার পথে শুধু সংগ্রাম এবং বাধা! শরীরের রোগ-ব্যাধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়,পারিবারিক – সামাজিক – অর্থনৈতিক – রাজনৈতিক সমস্যা__আরও কত সমস্যা!!
সাধারণ সংসারী মানুষ নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, বিষয়-আশয়, ব্যবসাপত্র, চাকরি বাকরি নিয়েই ব্যস্ত থাকে! সমাজের বাকিদের দিকে বিশেষত অবহেলিত, বঞ্চিত সমাজের নিচুতলার মানুষের দিকে কে চাইবে? সর্বত্যাগী নিঃস্বার্থ সন্ন্যাসী ছাড়া কে সবসময় তাদের পাশে পাশে থাকবে?
‘বহুজনহিতায় – বহুজনসুখায়’ –অর্থাৎ অপরের হিতে এবং অপরের সুখস্বাচ্ছন্দ বিধানের জন্যই এরা আত্নসুখ বিসর্জন দিয়েছে_সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছে!
তাছাড়া ছোট বয়স থেকেই ব্রহ্মচর্য্য পালন করায় এঁদের শরীর নিরোগ, মজবুত এবং প্রচন্ড জীবনীশক্তিসম্পন্ন হয়! প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও অল্প খাদ্যগ্রহন, অত্যল্প নিদ্রাতেও এই আত্নসুখত্যাগীদের নিজের কাজে কোন বিচ্যুতি ঘটে না!
সুতরাং ভগবানের আরব্ধ কাজ এঁরা ছাড়া আর কারা সম্পন্ন করবে! ভগবানের সাথী হয়ে বারবার আসার, এঁদের মধ্যে সবার হয়তো অভিজ্ঞতা থাকে না _কিন্তু বারবার মানবশরীর ধারণ করে সাধন-ভজন করার অভিজ্ঞতা এদের সবার আছে!!
তাই ভগবান লীলাশরীর সংবরন করে নেবার পরেও _ওঁদের মধ্যে যাঁরা থেকে যান, তাঁরাই সমাজের বাকি মানুষদেরকে সাধন-পথের সন্ধান দেন, তাদেরকে জীবন পথের পাথেয় দেন!
এঁদের দেখানো পথ ধরে চ’লে সমকালীন মানুষেরা উপকৃতও হন_এইভাবে চলতে থাকে পরম্পরা!! বর্ষে বর্ষে দলে দলে মানুষ আসে, আবার তারা চলেও যায়। মানুষ পাল্টায়, পরম্পরা রক্ষাকারীরা পাল্টায় কিন্তু পরম্পরাগত ভাবে ‘পরম্পরা’ – টা থেকেই যায়!! (ক্রমশঃ)