গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ নারীর মহিমা বিষয়ে কথা বলছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন – “পুরাকালে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল কিন্তু যখন থেকে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু হলো – তখন থেকেই ইচ্ছা করে নিয়ম , অনুশাসন দিয়ে নারীকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে ৷ প্রকৃতিগত কারনেই নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষের থেকে দুর্বল – এইটার-ই সুযোগ নিয়েছে পুরুষ ! গায়ের জোরে নারীকে বশ মানতে বাধ্য করেছে!
এমনিতে একটি কথা চালু রয়েছে, তা হল “নারী অবলা” ! কিন্তু নারী অ – বলা অর্থাৎ সেই অর্থে বল – হীন নয় ! পুরুষের গায়ের শক্তি বা জোরের তুলনায় নারীর শক্তি একটু কম ৷ কিন্তু প্রকৃতিতে শক্তিশালী নারীর সংখ্যাও কম নয়! নারী “অবলা” হয় – একমাত্র গর্ভধারণ কালে ! সেই সময় নারীর প্রয়োজন হয় সাহচর্য ও সহযোগিতার – অন্যথায় নারী নিজে নিজেই জীবনধারণের যাবতীয় কার্যাদি করে নিতে পারে । আমি নিজে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে এবং আফ্রিকায় তথাকথিত সভ্য জনসমাজ থেকে দূরে বাস করে এমন আদিবাসীদের জীবনযাত্রা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি! সেখানে দেখেছি তাদের জীবন কাটছে একেবারে প্রকৃতির অনুকূলে ! বস্ত্রের প্রয়োজন নাই – বাসস্থান খুবই সাধারণভাবে নির্মিত , কিন্তু জীবন সংগ্রাম রয়েছে! আহার্যের জন্য সংগ্রাম রয়েছে , বাসস্থান কে সুরক্ষিত করে রাখার সংগ্রাম রয়েছে – আর এই দুটি বজায় রাখতে গিয়ে তাদের সদা সর্বদা শক্তিশালী পশুদের (হাতি , সিংহ , বাঘ , ভাল্লুক ইত্যাদি) সাথে লড়তে হয় ।আর এই লড়াই-এ নারী ও পুরুষ একসাথে অংশগ্রহণ করে। মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলার গভীর জঙ্গলে ‘মারিয়া’ উপজাতিদের গ্রাম বলতে বড় বড় গাছের গুঁড়ি পুঁতে পুঁতে বেড়া দেওয়া একটা ফাঁকা জায়গা! তার মধ্যে 30 থেকে 40 জনের এক একটি নারী পুরুষের দল! মাথায় ছাউনি নাই , গায়ে বস্ত্র নাই , ওই অবস্থাতেই সকলে বসবাস করছে! বর্ষার জল পরলে সবাই ভিজছে – কাদার মধ্যে ওদের শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে বা দৌড়ে খেলে বেড়াচ্ছে! ওদের গায়ের রং কালো নয় _বরং ফর্সা!তাই শিশুগুলো কে একসাথে দেখলে মনে হয় যেন দেবশিশু!!
ওখানে দেখেছি পুরুষেরা দূর জঙ্গলে অস্ত্র হাতে জন্তু-জানোয়ার শিকার করতে যায় , আর নারীরা ওদের বাসস্থানের কাছাকাছি স্থানে ফলমূল , শাক পাতা সংগ্রহ করে নদী বা ঝর্ণার জল সংগ্রহ করে , নদী থেকে মাছ বা অন্যান্য প্রাণী ধরে নিয়ে আসে ৷ শক্তিশালী পশুরা আক্রমণ চালালে পুরুষদের সাথে নারীরাও অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে! অর্থাৎ বলতে চাইছি জীবন সংগ্রামে পুরুষ নারী খুব আদিম কাল থেকেই পাশাপাশি মোকাবিলা করে আসছে ! আজও সুযোগ পেলেই তারা তা করতে পারে, অনেকাংশে করছেও!”
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন ছিলো। বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণে ,অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষায় – নারীদের কোন বাধা ছিল না । ফলে আমাদের মহাকাব্য গুলিতে বা পৌরাণিক কাহিনিতে অনেক বিদূষী এবং বীরাঙ্গনার চরিত্র দেখতে পাওয়া যায় ৷ বৈদিক যুগেও অনেক নারী__ জ্ঞানের জগতে , আধ্যাত্মিকতার জগতে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছিলেন ৷ আমরা এমন অনেকগুলি নাম পাই যাঁরা বেদজ্ঞা বা বেদবাদিনী ছিলেন!
যাইহোক, কথা হচ্ছিল গুরুমহারাজ নারীদের নিয়ে কি বলতেন, সেই প্রসঙ্গে! কোন নারী কষ্টে আছে , দুঃখে আছে জানতে পারলে গুরু মহারাজ খুবই দুঃখিত হতেন । যে কথাটা এই প্রসঙ্গ শুরুর সময় বলা হয়েছিল যে – এক এক সময় মনে হতো গুরু মহারাজ বোধহয় একটু নারীবাদী! এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে উনি বলতেন – ” হ্যাঁ , এইসব ব্যাপারে আমি নারীদের পক্ষেই কথা বলব । নারীদের জন্য আমার অনেক ব্যাথা জমে আছে জানিস ! কত হাজার বছর ধরে নারীরা কিভাবে সমাজে লাঞ্ছিত , অবহেলিত , অত্যাচারিত হয়ে আসছে বল দেখি ? এইটা আমাকে খুব বেদনা দেয় ! সেইজন্য যখনই কোন মেয়ে আমার কাছে এসে চোখের জল ফেলে – তখন আমি আর ঠিক থাকতে পারিনা – বিচলিত হয়ে পড়ি ! আমার চোখের সামনে তখন কয়েক হাজার বছরের নারী কান্নার একটা জমাট রূপ প্রকটিত হয় – তাই এমনটা হয় !
“নারী যেন কাঁদার জন্য – ব্যাথা অত্যাচার সহ্য করার জন্যই জন্মেছে” _এই মনোভাবটা আর মানুষের মাথা থেকে যেতেই চাইছে না! ইউরোপ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে যথেষ্ট উন্নত, নারীদের সে সব দেশে সন্মানের সাথে দেখা হয়! আর আমাদের দেশে ব্যাপারটা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে যাত্রা-নাটক-সিনেমাতেও একটা দুটো ‘সিন’ এমন থাকতেই হবে ___যেখানে কতকগুলো পুরুষ একটা নারীকে অত্যাচার করছে, আর সেই অসহায় নারীটি সাহায্যের জন্য “মুঝে বাঁচাও-মুঝে বাঁচাও” বলে আর্ত চিৎকার করছে!
যাত্রাপালায় দেখেছি _ঐ ধরনের ‘দৃশ্যে’ মেয়েটির আঁচল খুলে মাটিতে লুটোচ্ছে__সে দু হাত উপরে তুলে “কে কোথায় আছো–রক্ষা কর, রক্ষা কর মোরে-এ-এ! ” _বলে চ্যাঁচাচ্ছে এবং উদ্ধত- দূর্বিনীত-খলনায়ক ‘হা-হা-হা-হা’ করে অট্টহাস্য করছে! আর এই দৃশ্য দেখে দর্শকেরা হাততালি দিচ্ছে। উত্তেজনা-মূলক আওয়াজ(সিটি) বের করছে মুখ থেকে ! পরিস্কার জামাকাপড় পরিহিত, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার অন্তরালে নিজের বিকৃত রূপ কে লুকিয়ে রাখা মানবের এ কি মনোবিকার!!! এগুলি perversion of sex ছাড়া আর কিছুই নয়!!”
এরপর মেয়েদের দিকে ছোখ রেখে উনি তাদের উদ্দেশ্যে বলতেন_”তোদেরকেও বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষাগ্রহন করতে হবে! ‘বাঁচাও-বাঁচাও’, অথবা ‘কোই হ্যায়! মুঝে বাঁচা লো!!!’ __এইসব ডায়লগ কি এখনো চালাবি? এখনো কি এগুলো পুরোনো হয় নি!! কে তোকে মদত করবে? আর কেনই বা তুই মদত চাইবি??? তুই নিজেই নিজেকে বাঁচাতে শেখ্!! এখন তো সমাজব্যাবস্থা অনেকটাই উন্নত, আইন নারীদেরকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছে!! তোরা তার সুযোগ নে!! Self_sufficient হয়ে ওঠ্!! জুডো-ক্যারাটে-কুম্ফু-তাই চি শেখ্!!
কোথাও সুযোগ না পেলে আমার কাছে আসবি__একটা কেন, একসাথে ৪/৫টা পুরুষকে কি করে ‘টাইট’ – দিতে হয়, তা আমি তোদের শিখিয়ে দেবো! (সেই দিন উনি একেবারে বেকায়দায় অবস্থায় পড়ে যাওয়া একটা মেয়েও শুধুমাত্র মাথা ঠাণ্ডা রেখে কিভাবে সেই অবস্থার মোকাবিলা করতে পারে __মেয়েদেরকে তার কিছু কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন।)
সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন অর্গানাইজেশন এখন নানাস্থানে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাচ্ছে! তোরা সুবিধামতো কোন একটা জায়গা থেকে শেখ্! যাদের বাড়িতে কন্যাসন্তান রয়েছে _তারা মেয়েদেরকে সেই সব জায়গায় ভর্তি করে দে! সমাজের সমস্যা কি একবারে যায়? ধীরে ধীরে সব কিছু বদল করতে হয়! তোরা শুরু কর্ _কালে আরও অনেকে আসবে, আর এইভাবেই সমস্ত নারীরা একটু একটু করে আত্ননির্ভর হয়ে উঠবে! “(ক্রমশঃ)