গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম আশ্রমে সিটিং-এ নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতেন – এখন কথা হচ্ছিল নারীর মহিমা এবং নারী পুরুষের সম্পর্ক এইসব বিষয়ে । উনি নারীর আত্মত্যাগের কথা বলছিলেন – ” সমাজ সৃষ্টির প্রথম পর্ব থেকেই নারীরা আত্মত্যাগ করে এসেছে ! যখন পৃথক পৃথক পরিবার (আদিম মানব সমাজে) সৃষ্টি হয়নি – যখন একজন গোষ্ঠীপতির Under-এ এক একটা দল থাকতো , তখন থেকেই দলের যে কোন প্রয়োজনে ত্যাগের মহিমা দেখাতো নারীরা ! যেমন কোনো নতুন ফল বা মূল খুঁজে পাওয়া গেলে – তা খাদ্য না অখাদ্য অথবা তা বিষফল – এগুলি Taste করার জন্য সেই দলের বয়স্কা নারীদের-কে বাছা হতো ৷ নতুন নতুন খাদ্যের উৎপত্তি , প্রস্তুতির গবেষণা করেছে নারীরাই ! আদিম মানব সমাজে ঘাতক অস্ত্র হিসেবে তৈরি হতো “বিষতীর” ! বিভিন্ন লতাপাতা-মূলের বিষ( হেমলক বিষ ইত্যাদি) , বিভিন্ন প্রাণীর বিষ (সাপ , কাঁকড়া বিছে ইত্যাদি) Collection করে সেগুলিকে একজায়গা করে আগুনে ফুটিয়ে ঘন করে একটা জেলির মত রস করা হতো । হিংস্র পশু বা শক্তিশালী শত্রুদের সাথে লড়াই করার সময় তীরের ফলায় এই বিষ দিয়ে ব্যবহার করা হতো ৷ “বিষতীর” তৈরীর Total process টা করতো ওই সমাজের বয়স্কা নারীরাই ! বিষের প্রভাবে অনেক সময় তাদের মৃত্যুও হতো – তবু এই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি তারাই করতো!
সেই শুরু !.সেই সময় থেকে আজও ভারতীয় সমাজে দেখা যায় যে কোন পরিবারে সবচাইতে সহনশীল , ধৈর্যশীল ব্যক্তিটি হলেন “সংসারের মা”, অর্থাৎ কোন না কোন নারী! কত “মা” প্রতিদিন আধপেটা খেয়ে , না খেয়ে সন্তান মানুষ করেছেন, সংসার প্রতিপালন করেছেন _তার ইয়ত্তা নেই! সবচাইতে Minimum requirement __সংসারের মায়ের ! বিনিময়ে সবচাইতে বেশি দায়িত্ব নিয়ে ঐ মা সংসার পালন করেন! সংসারে শ্বশুর-শাশুড়ি , স্বামী , পুত্র , কন্যা , প্রতিবেশী , আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে পৃথক পৃথক ভাবে সুসম্পর্ক বজায় রেখে জীবন কাটানো একটা কত বড় Art ! বিশ্বের কোন দেশে মায়ের এত সহনশীলতা দেখা যায় না ! সেমেটিক চিন্তা ধারায় বিশ্বাসী দেশগুলিতে নারীদেরকে জোর করে , ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করা হয় – সম্পূর্ণ ভাবে পুরুষ এর অধীনে থাকতে বাধ্য করা হয় ! ভারতীয় মেয়েরা কিন্তু Sacrificeকরে স্বেচ্ছায় – পরিবারের মানুষজনকে ভালোবেসে !
পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর সময় ছোটবেলা থেকে আমি যখনই কোন ভীষণ সমস্যায় পড়েছি – তখন তখনই কোন না কোন স্নেহময়ী রমণীর স্নেহ-স্পর্শ পেয়েছি আমি, যা আমাকে সমস্যা মুক্ত হতে সাহায্য করেছে! স্বামী বিবেকানন্দের জীবনেও এই একই ঘটনা ঘটেছিল – উনি বিদেশ-বিভুঁইয়ে কদর্পশূন্য অবস্থায় শীতের রাতে আশ্রয়হীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলেন । এমন সময় এক সহৃদয় রমণী-ই তাকে আশ্রয় দিয়ে মায়ের ভূমিকা পালন করেছিলেন! পরবর্তীতেও পাশ্চাত্যের নারীরা ভীষণভাবে স্বামীজীকে সাহায্য করেছিলেন ৷ বেলুড় মঠ তৈরির সময় প্রাথমিকভাবে যে মোটা টাকার প্রয়োজন ছিল – তারও যোগান দিয়েছিল দু-জন নারী !
আমার এখানে অর্থাৎ বনগ্রাম আশ্রমেও কয়েকজন নারীকে আমার বিশেষ কাজের জন্য Sacrifice করতে হয়েছে! তাদের এই শরীরে ব্রহ্মচারিণী হয়ে জীবন কাটানোর কথা কিন্তু ওই কাজ সম্পন্ন করার জন্য এখন সংসার করছে! এতে অবশ্য তাদের বিশেষ কর্মফল হবে না – আবার পরের শরীরে যেখান থেকে ছেড়ে এসেছে সেখান থেকেই শুরু করবে ৷
আশ্রমে যে সমস্ত ব্রহ্মচারী ছেলেদের নিঃস্বার্থ সেবা করার ভাব জাগ্রত হয়েছে – তাদের মধ্যেও নারীত্বের গুন জাগ্রত হয়েছে !___ কি বললাম বোঝা গেল না তো! আসলে ‘সেবা’ ব্যাপারটাই নারীদের যেন একচেটিয়া অধিকার । দেখবে এখনো সমাজে ‘Nursing’ বা ‘সেবা’ কাজের জন্য ‘নারী’দের-কেই Select করা হয় !
এই জগতে ঈশ্বরের সৃষ্ট মানুষের দুটি জাতি _’নারী’ ও ‘পুরুষ’। বাকি যত ভেদ, জাতি, শ্রেনী তৈরি হয়েছে তা সবই মনুষ্যসৃষ্ট! যদি ভয়ঙ্কর কোন প্লাবনে মানুষসৃষ্ট ভেদ যুক্ত সমাজের কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেনী বা ধর্মমতের, এমনকি অসম বয়সের নারী-পুরুষ _কোন এক নির্জন দ্বীপে গিয়ে স্থান পেয়ে, সেখানেই থাকতে বাধ্য হয় ____কিছুদিন পর দেখা যাবে, তারা সমস্ত sentiment ভূলে এক একটা নারী _এক একটা পুরুষকে নিয়ে পরস্পরে স্নেহ-প্রেম-প্রীতির সুন্দর সংসার পেতে বসে আছে!! এটা একেবারেই স্বাভাবিক বা natural!
তবে যদি তোমরা চেতনাকে আরো গভীরে প্রবেশ করাতে পারো_তখন দেখা যাবে যে নারী পুরুষ অভেদ তত্ত্ব! নারীশরীরেই পুরুষ বিদ্যমান এবং পুরুষশরীরের মধ্যেই নারী রয়েছে! সাধন-ভজন, যোগ-সাধনার দ্বারা সাধক-সাধিকারা এই তত্ত্বেরই সন্ধান করেন। নিজের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের অবস্থিতি একবার জানতে পারলে, তখন আর বাইরের বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্যের প্রয়োজন হয় না _বা আকর্ষণই অনুভুত হয় না। সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসীনীদের একা একা জীবন কাটানোর এটাই রহস্য!!
ভগবানের অবতারগনের শরীরে নারী পুরুষ উভয়ের লক্ষন এবং ধর্ম বিদ্যমান থাকে _এইজন্যই তাঁদেরকে বলা হয় অর্ধনারীশ্বর!!!
সাধারণভাবে উন্মুক্ত নারীশরীর বা পুরুষশরীর কে যদি ভালো করে নিরীক্ষণ কর, তাহলে যেন মনে হয় শরীর গুলির সামনেটা খোলা বা উন্মুক্ত এবং পিছন দিকটা যেন বন্ধ বা closed! এইবার একটা উন্মুক্ত নারীশরীরকে যদি একটা উন্মুক্ত পুরুষশরীর সামনাসামনি আলিঙ্গন করে থাকে, তাহলে যেন একটা closed circuit সৃষ্টি হয়! উভয়দিকেই closed! যুগলসাধনার এটাই রহস্য! শিব-দুর্গা, রাধা-কৃষ্ণ, আত্মা-পরমাত্মার যুগল মিলনের স্থুল রূপ সাধারণ নারী পুরুষের মিলন!
সাধকের মধ্যে যখন বিপরীত লিঙ্গের প্রকাশ ঘটে যায়, তখন পুর্বের শত শত জীবনের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে আকর্ষণ তা নষ্ট হয়ে যায়, বাইরের জগতের মিলনাকাঙ্খা থাকে না__সাধকের তখন নিজের মধ্যে নিজের শক্তির সাথে সতত মিলন হয়! সাধকের জীবনে এ বড় আনন্দ! প্রতি রোমকূপে রমনের আনন্দ!!” (ক্রমশঃ)