” গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ কেমন ছিলেন ” – এই জিজ্ঞাসা তোদেরকে করবে আগামীর মানুষ – একথা গুরু মহারাজ নিজেই আমাদের কে বলেছিলেন – সেই প্রসঙ্গেই এখন আলোচনা করা হচ্ছে ! গুরু মহারাজের কথা শুনে সেই সময় আমরা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অতটা বেশি ধারণা করতে পারিনি – যেটা এখন আমাদেরকে face করতে হচ্ছে ! ওনার কাছে যখন বসে থাকতাম – ওনার পদপ্রান্তে বসে ওনার অলৌকিক জ্যোতিঃপুঞ্জ মাখা সহাস্য মুখখানির দিকে যখন নির্নিমেষে চেয়ে থাকতাম – তখন জগত সংসার সব ভুলে যেতাম ! সত্যি বলছি – সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি করে বলছি এই কথা !!
কিন্তু আবার যখন ওনার স্থূল সান্নিধ্যে থেকে একটু সরে আসতাম – তখন আবার মনে পড়তো__ সমাজ-সংসার-কর্মজগৎ ! তাই উনি সেই সময় আমাদেরকে ‘ভবিষ্যতের কথা’ বললেও আমরা আমাদের চিন্তাকে অতদূর পর্যন্ত যেতে দিতাম না ! আটকে দিতাম! চিন্তাকে বলতাম – ” এই! তুমি পরমানন্দ মিশন , পরমানন্দ সান্নিধ্য ছেড়ে বেশিদুর যেওনা !” তাই এখনকার আশ্রম এখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধে উনি অনেক সময় অনেক কিছু বলতে চাইলেও আমরা যেন সেসব কথা শুনতে চাইতাম না – শুনলেও বুঝতে চাইতাম না , আর বুঝলেও_ না বুঝতে চাওয়ারই চেষ্টা করতাম !
গুরু মহারাজ একবার বনগ্রাম আশ্রমে সিটিং-এ বললেন – ” আমার এই স্থূল শরীরটা না থাকলে দেখবি – তোরা অনেকেই তখন আর বনগ্রাম মিশনেই আসবি না ! এখন যারা আমার খুবই কাছে থাকে – তারাই আর আশ্রমমুখো হবে না !” গুরু মহারাজের কথা শুনে আমরা সেদিন অবাক হয়ে গেছিলাম – তাই আবার হয় নাকি ?? এইরকম ভাবার কারণটা বলছি!
নাম্বার ওয়ান – তখন আমরা কোন রকম কষ্ট কল্পনাতেই আনতে পারতাম না যে গুরু মহারাজ নাই অথচ আমরা বেঁচে আছি !
নাম্বার টু – বনগ্রাম আশ্রম এ আসবো না তাই আবার হয় ? এখানে মাটিতে , ঘাসে , গাছে , লতায় , পাতায়, বাতাসে , জলে_ পরমানন্দের ছোঁয়া রয়েছে , পরমানন্দের পায়ের স্পর্শ , তার গায়ের অপার্থিব পাগল করা সৌরভ – সবই তো ছড়িয়ে রয়েছে – পরমানন্দকে ছাড়া যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমরা সেইগুলি নিয়েই বাঁচবো ! আমরা বনগ্রাম আশ্রমের ধুলায় গড়াগড়ি দেবো ! এখানকার বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচবো আর তাঁর দেবদুর্লভ তনুর গন্ধ অঘ্রাণ করব ! আশ্রমের পুকুরে অবগাহন করে তাঁর শরীরের স্পর্শ পাবো ! আর দুইজন গুরু ভাইবোন এক জায়গা হলে –একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দুটো প্রাণের কথা কইব ! সেই প্রাণাধিক প্রিয়তমের কথা স্মরণ করে চোখের জলে বুক ভাসাবো !
কিন্তু হায় ! কাল বহুৎ বলবান ! গুরু মহারাজ চলেও গেলেন – আমরা বেঁচেও আছি ! বনগ্রামের মাটি , বাতাস , জলকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকাও হয়ে ওঠেনি ! তবে দুজন পুরোনো গুরু ভাই-বোন এক জায়গা হলে অবশ্য এখনো যথেষ্টই প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় ৷ কিন্তু জিজ্ঞাসা – শুধু এইটুকুই কেন ? বাকি গুলোই বা সাকসেসফুল হলো না কেন ? পুরোনো ভক্তরা এই জিজ্ঞাসার উত্তর ঠিকমতো দিতে পারে না, শুধু বলে – “কাল এর উত্তর দেবে !”
তাহলে তাই হোক – কালের প্রসন্নতার জন্য অপেক্ষা করা হোক , আমরা ফিরে আসি পূর্বের কথায় ৷
গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল – শতভিষা নক্ষত্র থেকে তাঁকে আধ্যাত্মিক শক্তি আনতে হয়েছিল কেন ? উনি তার উত্তর দিয়েছিলেন! এরপর আমরা তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ , স্বামীজী বা অন্যান্য আরও অনেক মহাপুরুষ সেই সময় ভারতবর্ষে শরীর নিয়েছিলেন – এতে পৃথিবীর পজিটিভ শক্তির ভান্ডার শেষ হয়ে গেল ! তাহলে তো মহাপুরুষের জন্ম না হওয়াই ভাল , কারণ তাতে অন্ততঃ পৃথিবীতে পজিটিভ শক্তির ভান্ডারটা বেশ পুষ্ট হবে ?”
এই জিজ্ঞাসা শুনে গুরুমহারাজ একটু হেসেছিলেন _তারপর উত্তর দিয়েছিলেন _”দূর পাগল! পৃথিবীতে প্রচুর পজিটিভ এনার্জির ফিল্ড থাকলেই বা তোর কি? মহাসমুদ্রের মোট জলের পরিমাণ জানিস তো! পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর মাত্র এক ভাগ স্থলভাগ! এত গ্রাম, নগর, শহর, এত দেশ-মহাদেশ, কত স্থলভাগ বল্ তো! তাও এই বিশাল স্থলভাগ মাত্র ১/৪-ভাগ, আর ৩/৪-ভাগ ভাগই জল! তাহলে বুঝতে পারছিস _পৃথিবীর বিশাল জলভান্ডারের পরিমাণ কতখানি!
কিন্তু এই বিশাল বিশাল মহাসাগরগুলি(জলভান্ডার) থেকে তুই তোর তৃষ্ণাটুকুও মেটাতে পারবি না! কৃষিকার্য্য বা অন্যান্য কিছুও করতে পারবি না!
তাহলে _এখন উপায়! ঐ অপেয় জলকে সুপেয় করার জন্য ঈশ্বর কি বিধান করে রেখেছেন, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক_সূর্যের আলোয় বা উত্তাপে মহাসাগরের জল বাস্পীভূত হয়ে মেঘ আকারে উপরে উঠে যায়! এই মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা যখন ঝরে পড়ে ধরনীতে__তখন তা সুপেয় হয়। এই জল থেকে জীবজগৎ অর্থাৎ উদ্ভিদজগৎ ও প্রানীজগৎ উপকৃত হয়! আর শুধু উপকার ই বা কেন _এই জলই তো মানুষের জীবন!”
এরপর গুরুমহারাজ আরও যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হোল এই যে __পৃথিবীতে positive field – এর ভান্ডার বেশি থাকলেই বা সাধারণ মানুষ সেই শক্তি সরাসরি কখনই নিতে পারে না ! মহাপুরুষগনই ঐ শক্তিকে ধারন করে, তা সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যান! আর মানুষ তার সুফল পায়! এইজন্যই কোন মহাপুরুষের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে যে কোন মানুষের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ সাধনা করার পর যেগুলি পাওয়া যায় __মহাপুরুষের সংসর্গে সেগুলি তখন সহজেই করায়ত্ত হয়!
কামনা-বাসনা-মায়া-মোহ-এষণা-আসক্তিতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়া সাধারণ মানুষ নিজের চেষ্টায় কোনদিনই এই মায়ার বাঁধন কেটে বেরোতে পারে না। মহাপুরুষগন-ই সদগুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে এক লহমায় মানুষকে তার সমস্ত বাঁধন কাটিয়ে বের করে নিয়ে আসেন!
এ যেন জটিলা-কুটিলার হাত ছাড়িয়ে, নজর এড়িয়ে “বড়াই বুড়ি” (সদগুরু)-র সাথে রাধার যমুনার উজানে ছল করে জল আনতে যাওয়া!! এই অভিসারের শুরু _কৃষ্ণ দরশনের অভিসার!! প্রথমে গুরুর হাত ধরে যাওয়া-আসা, তারপর গভীর নির্জন পথ ধরে নিজে নিজেই যাওয়া! আরো পরে এই অভিসার হয় আঁধার রাতে, কন্টকাকীর্ন পথে! কষ্ট না করলে যে কেষ্ট পাওয়া যায় না! তাই আঁধার রাতে কন্টকাকীর্ন পথ ধরে যমুনার উজানে (সুষম্নামার্গ অবলম্বন করে) চলতে থাকলে (সাধনার দ্বারা) একদিন কদমতলায় ঠিক বংশীধারী হরির দেখা পাওয়া যায়!! (ক্রমশঃ)