গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন মহাপুরুষগণের পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবার রহস্যের কথা , অর্থাৎ কেনই বা তারা অবতীর্ণ হন সেইসব কথা ! শাস্ত্র প্রমাণ থেকে আমরা প্রায় সকলেই জানি গীতার মহাবাক্যটি – “পরিত্রাণায় সাধুনাং ………সম্ভবামি যুগে যুগে “৷ কিন্তু এর মধ্যেও অনেক কথা আছে , ওই সংস্কৃত শব্দগুলির নানারকম ব্যাখ্যাও আছে ! কিছুদিন আগেই এই প্রসঙ্গে স্বামী বাউলানন্দের কিছু আলোচনা করা হয়েছিল , যেখানে উনি বলেছিলেন – জৈব বিবর্তন একটা continuous and spontaneous flow বা প্রবাহ ! এই প্রবাহের ধারাতে পড়েই এককোষী নিম্নশ্রেণির জীব_ উচ্চতর সিস্টেম বিশিষ্ট শরীর প্রাপ্ত হবার জন্য স্বতঃই জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে ! কিন্তু এই অগ্রগতি বা flow এসে slow হয়ে যাচ্ছে বা থেমেই যাচ্ছে জীবের মনুষ্য-শরীর লাভের পর থেকে ! কোন গাড়ির ইঞ্জিনের গতিই যদি slow হয়ে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ওর সাথে সংলগ্ন বাকি বগিগুলির কি অবস্থা হবে! তাদের গতিও শ্লথ বা বন্ধ হোতে বাধ্য হবে! তাই নয় কি?
এখন জিজ্ঞাসা _কেন এমনটা হচ্ছে ? স্বামী বাউলানন্দের আলোচনায় পাওয়া যায় যে মনুষ্য ব্যতিরেকে বাকি জীব সম্পূর্ণরূপে Nature বা প্রকৃতি-অধীন ৷ তারা প্রকৃতির অনুকূলে তাদের সমগ্র জীবনচক্র কাটায়! তাই তাদের বিবর্তনের Flow ঠিকভাবে বজায় থাকে!
কিন্তু মানুষে এসে evolution তখন involution-এ রূপ নেয়। সেখানে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বলবতী ! মানুষ মনণশীল – তাই তার চিন্তাশক্তি , ইচ্ছাশক্তি এইগুলি রয়েছে! মানুষের মনোজগতে হাজার ফ্যাকাল্টি রয়েছে ! স্নেহ , প্রেম , মায়া-মমতা , লিপ্সা , প্রমাদ ইত্যাদি নানাবিধ ফাঁসে জড়িয়ে পড়ে মানুষ । মহাজনগন বলেছেন_ যেমন রেশম কীট নিজেই তার লালা দিয়ে একপ্রকার শক্ত সুতো তৈরি করে এবং শরীরের চারিদিকে জড়িয়ে জড়িয়ে একটা শক্ত খোলক তৈরি করে – পরে আর বেরোতে পারে না (তবে অবশ্য এই একই উদাহরণ টেনে গুরু মহারাজ বলেছিলেন যে শুককীট গুলি ওই ফাঁস কেটে বেরোতে পারে তারা আর শুককীট থাকে না – হয়ে যায় _উড়ে বেড়ানো, রংবাহারি_মুক্ত প্রজাপতি) ! এইভাবে মানুষকুল পার্থিব জগতের রূপ-রসাদির জালে পড়ে জীবনের বিভিন্ন এষণা মেটাতে গিয়ে বদ্ধ হয়ে যায় – অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায় ! ফলে জীবজগতের বিবর্তনের যে দীর্ঘ flow-টা চলছিল তা শ্লথ হয়ে যায় বা রুদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়! আর তখনই প্রয়োজন হয় মহাপুরুষের আগমনের ! তাঁরা যেন এসে একেবারে মানবত্রানে লাফিয়ে পড়েন এবং বদ্ধ , ত্রিতাপক্লিষ্ট মানবকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে তাদেরকে অগ্রগতি দান করেন! অষ্টকলায় প্রকাশিত মানবকে__ দশম কলায় প্রকাশিত দেব-মানবে অথবা দ্বাদশ কলায় প্রকাশিত ঋষি-মানবে উন্নীত হতে সাহায্য করেন !
কোন সময় তাঁরা সাধারণ মানুষকে সরাসরি উন্নীত করেন , কোন সময় তাদেরকে উন্নত হবার সহজ সরল রাস্তা এমনভাবে বাৎলে দেন – যে মানুষ সেই পথ অবলম্বন করে দ্রুত উন্নত হয়! এর ফলে আবার বিবর্তনের flow-টা গতি পায় এবং সুমুখপানে এগিয়ে চলতে থাকে ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “মহাপুরুষদের বারবার এই পৃথিবীতে শরীর নিতেই হবে , স্বয়ং ঈশ্বরকেও বারবার অবতীর্ণ হতে হবে – নাহলে যে সৃষ্টিচক্র একদিন শুরু হয়েছে, তাকে mature করে পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবে কে ?”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন একটা বড় পচা কুমড়োর মধ্যে যত কোটি ভাইরাস , ব্যাকটেরিয়া , কীটেরা রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সংখ্যা (৭০o কোটি বা তার সামান্য বেশী) তার চাইতে কম ! সুতরাং পৃথিবীতে জনসংখ্যা আজ থেকে ১০০ বছর আগে হয়তো ৪০০-৪৫০ কোটি ছিল কিন্তু এখন তা ৭০০-৭৫০ কোটি হলো কেন – এই জিজ্ঞাসার উত্তরে গুরু মহারাজ ওই Example-টি দিয়ে বলেছিলেন _’ বিবর্তনে দ্রুত নিম্নতর প্রাণীরা উঠে আসছে এবং শরীরের শেষ বিবর্তনের ধাপ ‘মানুষে’ এসে পৌঁছে যাচ্ছে ৷এখানে আর শরীরের বিবর্তন নয় এবার মনোজগতের বিবর্তন! কিন্তু মানুষশরীর প্রাপ্ত হবার পর আর উন্নতির প্রচেষ্টা নাই ! ফেঁসে যাচ্ছে মায়া-মোহের বন্ধনে ! এইভাবে যখনই মানবের অগ্রগতিতে stagnancy আসছে তখনই আবির্ভূত হচ্ছেন মহামানবেরা, তাদেরকে গতি দান করতে !’
এই আবির্ভাব হতে পারে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে, সমভূমিতে , ইউরোপের পার্বত্য অঞ্চলে অথবা আরবের মরুভূমিতে ! যেখানেই হোক না কেন –তাঁদের কাজ সেই একটাই_
মানবজাতির উন্নয়ন!! মানুষের চেতনার উত্তরণ ঘটিয়ে “মানসিকভাবে শিশু” – মানবজাতিকে, পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া!
কিন্তু পৃথিবীগ্রহের যে অন্যতম ধর্ম সবকিছুকে নিচের দিকে টেনে নামানো (অভিকর্ষ)! এই ধর্মের জন্যই মানুষের চেতনার অগ্রগতিও বাধাপ্রাপ্ত হয়! সাধনার প্রয়োজনটা এইজন্যেই!
আমি ছোটবেলা থেকেই মহাপুরুষের জীবন নিয়ে চিন্তা করার সময় ভাবতাম _’আচ্ছা, বেশিরভাগ মহাপুরুষকেই একাকী শ্মশানে, দুর্গমস্থানে সাপ-হিংস্র জীবজন্তু-মাছিমশার উপদ্রব সহ্য করে, না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে (যদিও পরে বুঝেছিলাম যে সাধনার একটা বিশেষ স্তরে উন্নীত হলে খাদ্যের বা ঘুমের অতটা প্রয়োজন হয় না) _সাধনা করতে হয়েছে!
কিন্তু এমনটা কেন?? এই ক্রমটাই কি মহাপুরুষ হোতে হলে পালন করতে হয়?? সারারাত মশার কামড় খেতেই হবে?? বনে-জঙ্গলে, শ্মশানে-মশানে, পর্বতের গুহায় সাপখোপের সাথে রাত্রি কাটাতেই হবে???
গুরুমহারাজকে এই জিজ্ঞাসাটি করা হয়ে ওঠে নি! কিন্তু ন’কাকাকে (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) একবার শুধিয়েছিলাম_”আচ্ছা ন’ কাকা! এইটাই কি ক্রম? সব সাধক কে কি এই ভাবেই সাধনা করতে হবে? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ করলেন, বামদেব করলেন, এনারা ছাড়া আরও অসংখ্য মহাপুরুষের জীবনী থেকে এই ষরকম উদাহরন দেওয়া যায়! তাহলে _এই ব্যাপারে আপনি কিছু বলুন?’
ন’কাকা উত্তর দিয়েছিলেন _”মহাপুরুষের বা অবতারপুরুষদের তো এইরকমটা করতেই হবে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন না _’আমি ষোলটাং করলে তবে তোরা একটাং করবি’! ওনারা করেন আমাদের (সাধারণ মানুষের) _জন্য। আমরা তো অত কষ্ট করতে পারবো না _তাই ওনারা আমাদের সকলের হয়ে _করে দেন। এইটাই প্রকৃতির নিয়ম _শক্তিমান ব্যক্তিই দূর্বলদের রক্ষা করে, যার ধন উপার্জনের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে _সেই পারবে গরীবদুঃখীদের পাশে দাঁড়াতে! গুরু হলেন শক্তিমান _তাইতো তিনি আমাদের মতো দুর্বল ব্যক্তিদের ভার নেন! এইজন্যই ‘গুরুভার’ বলা হয়েছে বাবা! গুরু যখন সে হয়েছে _তখন তাকে তো গুরুভার বহন করতেই হবে!”
তারপর ন’কাকা আরও বললেন _” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে যা করেছিলেন, তা কি উনি ওনার শিষ্যদের করতে বলেছিলেন _বলেন নি! বামদেবের পরে কয়েকজন উন্নত সাধক(তারাখ্যাপা ইত্যাদি) ছিল বটে _কিন্তু’ তারামায়ের খ্যাপাছেলে'(বামদেব) – ঐ একজনই!
দ্যাখো, গুরুজী(স্বামী পরমানন্দ) যতই বলুক _’আধ্যাত্মিক সম্পদ পৈতৃক সম্পদের ন্যায় পিতা থেকে পুত্রে আসে না’___এটি নিজেকে অর্জন করতে হয়! কিন্তু বাবা! তাই কি হয়! এক্ষেত্রেও গুরুর ধন(আধ্যাত্মিক সম্পদ) – শিষ্যে সঞ্চারিত হয় বই কি! না হলে ‘গুরুপরম্পরা’ কথাটি সৃষ্টি হয়েছে কেন? শক্তিশালী গুরুর সান্নিধ্যে থাকলেই গুরুর শক্তি আপনা আপনি শিষ্যের মধ্যে চলে আসে। আর তাঁর প্রিয় হয়ে উঠতে পারলে হু হু করে শক্তি transfer হয়!
গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”গুরু একটা post! গুরুর আসন একটা শক্তিপীঠের মতো, আধ্যাত্মিক শক্তির উচ্চ vibration সেখানে সবসময় বিদ্যমান থাকে! _একজন শক্তিশালী গুরুর পর ঐ আসনে যে বসবে _তার মধ্যে দিয়েই ঐ শক্তির ক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।”(ক্রমশঃ)