গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের শক্তিতেই আমরা শক্তিমান , তাঁর বলেই আমরা বলীয়ান ! সেই সব কথাই হচ্ছিল – কিভাবে গুরু মহারাজের শক্তিতে তাঁর ভক্তরা বিভিন্ন স্থানে রক্ষা পেতেন , এই ধরনের নানা কাহিনী ! এর কিছু কিছু গুরু মহারাজ সিটিং-এ কথা প্রসঙ্গে আলোচনা করতেন , আবার কিছু কিছু যার জীবনে ঐ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল তার মুখ থেকে শুনে এখানে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে । আমাদের গুরুভাই-বোনেদের জীবনে কোন না কোনভাবে গুরু মহারাজের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কৃপা লাভ হয়নি এমন কেউ নাই !! প্রত্যেকেরই বলার মত কথা রয়েছে – কারও কম কারও হয়তো একটু বেশি । কেউ কেউ হয়তো আমার মতো হুডখোলা – হড়বড় করে বলে দেয় , কেউ হয়তো চাপা-স্বভাবের –বলতে চায় না !! ‘না-বলা’টাও একটা সংযম ! আমার মনে আছে – তখন গুরু মহারাজের সিটিং শুনে মাঠের দিকে যখন বেড়িয়ে আসতাম , আমাদের মাথাগুলো ঝাঁঝা করত , সমস্ত শরীর মনে হত যেন শূন্য হয়ে গেছে , আমরা যেন এতক্ষণ সম্পূর্ণ এক অজানা জগতে বাস করছিলাম , সামনের চেনা জগৎটা যেন অচেনা লাগতো ! সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন – সেই সময় আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথাও মনে থাকতো না ! মনে থাকতো না সমাজ-সংস্কার-পৃথিবীর কথা ! পৃথিবীর এত এত সমস্যার কথা !
সিটিং ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগত । কারো সাথে কথা কইতে ইচ্ছাই করত না ! কিন্তু সিটিং ছেড়ে যেই না মাঠে পা দিয়েছি অমনি মদন মহারাজ (অর্থাৎ স্বামী চিৎবিলাসানন্দ , অনেক সময় নানু মহারাজ বা নির্বেদানন্দ , জ্যোতির্ময়ানন্দরাও থাকতেন) বটতলা থেকে হেঁকে ডেকে চিৎকার করে বলতেন – ” এ—ই এসো!! এখানে এসে একটু বসো ! গুরু মহারাজ কি বললেন সেসব কথা বল ! দেখছো না এতগুলো ছেলের দায়িত্ব নিয়ে আমরা পা-পোঁতা হয়ে আছি ! সিটিং-এর ধার দিয়ে যেতে পারি না – কোনদিন যদিও বা যেতে চাই – গুরুজীর বকুনি খেয়ে পালিয়ে আসতে হয় ( ওই মহারাজেরা সকলেই আশ্রমেরবালক ভবনের দায়িত্বে ছিলেন । আশ্রমের অনাথ বালকদের পড়াশোনা করানো , তাদের স্নান করানো , খেতে নিয়ে যাওয়া , খেলাধুলা করানো , সন্ধ্যায় প্রার্থনা করানো , ভোরে যোগব্যায়াম-প্রাণায়াম করানো – সমস্ত দায়িত্বই ওনারা কয়জনে পালন করতেন ! তাই বালকদের দায়িত্বে থাকা মহারাজরা প্রায়ই কোথাও যেতে পারতেন না ) !”
মদন মহারাজের হম্বিতম্বিতে বাধ্য হয়ে বটতলায় বসে বসেই শুরু হয়ে যেতো, এতক্ষণ গুরু মহারাজ কি কি প্রসঙ্গ করলেন – সেগুলিকে বলা ! প্রায়শই আশ্রম থেকে বাড়ি ফেরার পর (কাটোয়ায়) এখানকার ভক্তমন্ডলী অর্থাৎ ধীরুভাই , সুব্রত , জহরদা – এরাও উন্মুখ হয়ে থাকতো – কতক্ষণে গুরু মহারাজের বলা কথাগুলো শুনবে! সেখানেও একপ্রস্থ ওই কথাগুলির আলোচনা হোত !
একবার একদিন বনগ্রাম আশ্রমে সিটিং-এ গুরু মহারাজের সামনে বসে আছি । উনি বললেন – ” আমার কথা শুনে গিয়ে অনেকেই কতক্ষণে তা ‘বমি’ করে দেবে – তার জন্য যেন ছটফট করে ৷ আরে – এগুলো নিজের মধ্যে রেখে আত্তীকরণ কর্ ! তবে তো তুই নিজে পুষ্ট হবি ! তা না করে সঙ্গে সঙ্গে যদি বমি করে দিস – তাহলে তোর পুষ্টি কোথায় হ’ল ?” – আমরা সেদিন বুঝতে পারলাম আমরা কতটা অর্বাচীন , কতটা অনুপযুক্ত ! তাঁর কথা শ্রবণ করে ভেতরে লালন করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপারগ ! নিজেকে খুবই ধিক্কার দিতে মনে হয়েছিল সেদিন !
কিছুদিন পরে একটু সুযোগ পেয়ে একান্তে ওই কথাটিই তুলে ধরেছিলাম গুরু মহারাজের কাছে , – ___”গুরুজী! যখন আশ্রম থেকে ফিরে যাই_তখন ওখানকার অনেকেই অধীর আগ্রহে আপনার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে, তাহলে কি এবার থেকে কাউকে কিছুই বলব না?”
আমার কথা শুনে সেদিন উনি হেসে ফেলেছিলেন, তারপর বললেন _” বলবি বই কি! সবাই তো আর আশ্রমে সব সময় আসতে পারে না! যারা আগ্রহী তাদের কে তো বলতেই হবে!এতে তোর ও মঙ্গল, তাদেরও মঙ্গল! মানুষের মঙ্গলের জন্যই তো আসা! মানুষের ভালো হয় _এমন কাজ সবসময় করবি! সে কাজে সর্বদা আমার আশীর্বাদ পাবি!” সেই থেকেই ‘হড়বড়’ – করে বলা শুরু ! যা করেন গুরুমহারাজ! জয় গূরূজী! জয় স্বামী পরমানন্দ!!!
যাইহোক, কথা হচ্ছিল জার্মান শান্তির দিদিকে নিয়ে! ঐ ঘটনার পর উনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন এবং বেশ কয়েকবার বনগ্রাম আশ্রমেও এসেছিলেন। আশ্রমে যখনই আসতেন _তখনই অনেক দিন করে থাকতেন! উনি গুরুমহারাজকে সন্তানবৎ জ্ঞান করতেন। গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম _”জার্মান শান্তির দিদি ফ্রানসিসকা এই পৃথিবীর অশান্তিময় পরিস্থিতি নিয়ে খুবই চিন্তিত! উনি চিন্তা করে দেখেছিলেন যে আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া (তখনও অবিভক্ত ছিল) যদি পরস্পরের প্রতি মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলেই পৃথিবীতে শান্তি বজায় থাকবে [কারন তখন ঐ দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে cold war-চলছিল! মাঝে মাঝেই বিশ্বের যে কোন দেশের সমস্যা নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হোত _এবং এটা হলেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল!]! আমার ঐ মা-টি (ফ্রানসিসকা) মনে মনে বিশ্বাস করত যে তাঁর তিনটি ছেলে _প্রথমজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রেগন(তৎকালীন), দ্বিতীয়জন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ(তৎকালীন) এবং তৃতীয় বাচ্চাটি আমি! [‘তৃতীয় বাচ্চা’ _কথাটা শুনে উপস্থিত সকলের সে কি হাসি! গুরুজী ও হাসছিলেন, উনি তো ইচ্ছে করেই মজার মজার কথা বলে সবসময় উপস্থিত জনেদেরকে একেবারে মাতিয়ে রাখতেন!]
আমার ঐ মা-টি তিনজনকেই তাঁর চিন্তার কথা ব্যক্ত করে নিয়মিত চিঠি লিখতেন! ওনার বাকি দুটো ছেলে (রেগন এবং গরবাচেভ) চিঠির উত্তর দিতো কিনা আমার জানা নেই কিন্তু আমি ওনার সব চিঠির উত্তর দিতাম। প্রায় সব চিঠিতেই উনি বিশ্বের পরিস্থিতি এবং বিশ্ববাসীর নানান দূর্গতির উল্লেখ করে, আমাকে অনুরোধ করতেন _আমি যেন সবার কষ্ট দুর করি! উনি এটাও বলতেন ওনার বাকি দুটো ছেলে দুষ্টু _আমি ওনার ভালো ছেলে। তাই আমাকেই বাকি দুটো ছেলের দায়িত্ব নিতে হবে যাতে ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি না করে! প্রত্যেক চিঠির উত্তরে ওনাকে আশ্বস্ত করতে হোত আমাকে!
আসলে ওনার ভয় ছিল যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হোলেই পরমানূ অস্ত্রের প্রয়োগ হবে _এবং প্রচুর মানুষ মারা পড়বে!! এটা চিন্তা করেই উনি কষ্ট পেতেন!! ”
দেখুন __আমরা কিন্তু এইটাই বলতে চাইছিলাম! গুরুমহারাজের কাছে শক্তিলাভ করে মানবকল্যাণে, জগৎকল্যাণে, নিদেনপক্ষে আত্নকল্যানে(আত্মনোমোক্ষার্থং) ব্রতী হওয়াটাই তো বান্ছনীয়! নাহলে সেই মহান মানুষটির চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে তিল তিল করে মানবকল্যানের জন্য জমানো শক্তি পেয়ে _আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের ন্যায় জীবন যাপন কাটিয়ে দেওয়া টা তো অপরাধ!! গুরুমহারাজ ইউরোপীয়দের এই গুনটির খুবই প্রশংসা করতেন, উনি বলতেন _”ইউরোপীয়রা আমার কাছ থেকে যেটা শোনে _সেটা তারা জীবনে যোজনা করার চেষ্টা করে, আর তোদের শুধুই মুখে ফুটানি!! Practical – করার কোন চেষ্টাই নেই!”
এই কারণে উনি একদিন কাঁকুরে-সহজপুরের সুদেববাবুকে একটু বকাবকি করলেন _সে ঘটনা পরের দিন! (ক্রমশঃ)