গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) ‘সহজতা ও প্রেম’ -বইটিতে লিখেছিলেন – “পূর্বে ভারতবর্ষ পর্যটন করেছিলাম অন্তরে আত্মতত্ত্ব বা সত্যলাভের আকুতি নিয়ে ৷ গিরি, গুহা, দেশ, নগর, গ্রাম, মাঠ, নগর, আখড়া, আস্তানা, বহু পুণ্যক্ষেত্র এবং তীর্থস্থান – সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখেছি ৷ ঐ পর্যটনকালে সৌভাগ্যবশতঃ কতিপয় সহজ ও প্রেমিক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়েছিল । তাঁরা যেন নিষ্কপটতা ও প্রেমের মূর্ত্ত প্রকাশ ! আবার অনেকের মধ্যে এও দেখলাম যাঁরা নিজেরা নিজেদেরকে অবতার, মহাপুরুষ, মহর্ষি, মহাত্মা, জগৎগুরু, ভগবান, সাধু, ভক্ত, শাস্ত্রজ্ঞ, বেদজ্ঞ, সমাজপতি, মহাপন্ডিত, নীতিবাদী – ইত্যাদি নানা উপাধিতে ভূষিত করেছেন । এঁরা সকলেই মানবশরীরেই অবস্থান করছেন । কিন্তু বেশভূষা, অলঙ্কার এবং প্রতীকে ওঁরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন । আর এদের ব্যাবহারে বা শিষ্যগণের ব্যাবহারে দেখা গিয়েছিল ঘৃণা, দ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, সংকীর্ণতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, আত্মাভিমান, স্বার্থচেতনা, শ্রেণীচেতনা, সম্প্রদায়চেতনা, গোষ্ঠীচেতনা, ছুৎমার্গ ও কামনা বিকার । এদের কথায় ও কাজে সামঞ্জস্য নেই ৷ এদের মধ্যে এরূপ অসহজ ভাব লক্ষ্য করে তখন ভেবেছিলাম – এই অসহজ অবস্থাসম্পন্ন মানব হওয়া অনেক সুবিধা, কিন্তু সহজ মানব হওয়া খুবই কঠিন !” – [সহজতা ও প্রেম – পৃষ্ঠা ১১/১২]
এই প্রসঙ্গে উনি সিটিং-এ আরও বলেছিলেন – এই সব কারনে এই শরীরে ওনার গেরুয়া কাপড় পড়ার ইচ্ছাই ছিল না । বেলুড়মঠ-দক্ষিণেশ্বর পরিভ্রমণকালে একদিন স্বামী বিবেকানন্দ প্রকট হয়ে গুরু মহারাজকে গেরুয়া পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বললে – উনি রাজি হ’ন ৷সেইসময় রামেশ্বরানন্দ মহারাজ এবং হরি মহারাজ গুরু মহারাজের সাথেই ছিলেন ৷ এই প্রসঙ্গে কথা শেষ করে উনি বলেছিলেন – “আমি গেরুয়া পড়লে কি হবে – তৃষাণ, জয়দীপ এরা তো দেখছি আমার পূর্বের ইচ্ছার মর্যাদা রাখছে (তৃষাণ মহারাজ পরে অবশ্য হৃষীকেশের কৈলাশ আশ্রম থেকে সন্ন্যাস নিয়েছেন) !{ন’কাকা যেহেতু সাদা কাপড় পড়া মানুষ, তাই এই রেফারেন্স দেওয়া হোল}। আর একবার আলোচনা প্রসঙ্গে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্ত্রীকে যথার্থ নারী বা ‘মা’ হিসাবে মর্যাদা দিয়ে যেভাবে নিজের কাছে রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন — এটা ছিল পৃথিবীগ্রহের দৃষ্টান্ত ! এছাড়া ঠাকুর আগামী পৃথিবীর জনবিস্ফােরণের কুফলের কথা আঁচ করে বলেছিলেন দুটি-একটি সন্তান হয়ে গেলেই স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোনের মতো থাকবে । ঠাকুরের প্রদর্শিত পথে এই ১০০ বছর বা বেশী সময় কেটে গেলেও সাধারণ মানুষ চলতে পারে নি । ন’কাকা তাঁর জীবনে ঠাকুরের ওই আদর্শটিকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে গেলেন । এবার দেখবে অনেক ছেলে-মেয়ে ঐভাবে জীবন কাটাবে ।”
ন’কাকা ছিলেন সহজ মানুষ । ন’কাকা ছিলেন সহজ সরল মানুষ ! ‘সরল’ মানুষ প্রসঙ্গে ন’কাকা নিজেই একদিন বলেছিলেন – ” সরল হলে তো হয়েই গেল – দেখো না গুণ, ভাগ, বিয়োগ, যোগ সবকিছু থাকলে তবে অংকের সরল হয় !”
একদিন বনগ্রামে সিটিং-এ আলোচনা প্রসঙ্গে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “আমার ভ্রাম্যমাণ জীবনে আমি যে কয়জন মহাত্মা, মহাপুরুষ, মহাজ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞ মানুষ দেখেছি – তাঁদের সবাই হয় সাদা কাপড়ের অথবা বস্ত্রহীন অবস্থার মানুষ ! অপরপক্ষে গেরুয়া বস্ত্র পড়া বহু মন্ডলেশ্বর , মোহান্ত , মহারাজ দেখেছি – যাদের আরম্বর বহুৎ রয়েছে কিন্তু আধ্যাত্মিকতা নাই !”
ন’কাকার কথা লিখতে বসে চোখের জল বাধা মানছে না । তিনি এতো বেশি ভালোবাসতেন – যার পরিমাপ করা যায় না ! গুরু মহারাজের শূন্যতা তিনি অনেকটাই পূর্ণ করে রেখেছিলেন ৷ তাই তাঁর স্তুতিগান , তাঁর স্মৃতিচারন করে অন্ততঃ মনটা একটু শান্ত হোক – এই ভগবানের চরণে প্রার্থনা করি ! কত মানুষ চোখের জল ফেলে কাঁদছে – কত মানুষ অন্তরে কাঁদছে ! কত মানুষের যে মনের মানুষ ছিলেন ন’কাকা তার ইয়ত্তা নাই ! আমি অনেক মানুষকে জানি — যারা অন্যত্র গুরুকরণ করেছেন কিন্তু ন’কাকার উপর তার নিজের ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছিলেন ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “গুরু করবি শত শত মন্ত্র করি সার, মনের মতো মানুষ পেলে তারে দিবি ভার !” এই কথার সার্থক রূপ দেখতে পেতাম ন’কাকাকে দেখে ! বিভিন্ন ভক্ত তাদের পরিবারের সকলে এমনভাবে ন’কাকাকে আপন করে নিয়েছিল যে – মা হয়তো বাচ্ছাকে বকেছে, বাচ্ছাটি ন’কাকা-কে ফোন করে মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতো ! আবার হয়তো মা-টি তার বাচ্ছা কথা শুনছে না , পড়তে বসছে না – তাও ন’কাকাকে ফোন করে জানাতো ৷ ফলে ন’কাকাকে সাড়াদিনে অন্ততঃ ১৫০/২০০ বার ফোন ধরতে হোত ! কিন্তু আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে – এই বিশাল ভক্তকুলের অনেককেই বা হয়তো প্রায় সকলকেই ন’কাকা স্বয়ং নিজেই ফোন করতেন — খোঁজখবর নিতেন ৷ আমি অনেক ভক্তকে বলতে শুনেছি – ” বাবা অন্তর্যামী ! আমার সেদিন ‘অমুক’ অসুবিধা ছিল – বাবা ঠিক সেইসময় ফোন করে খবর নিলেন , এতে আমার মনটা ঠান্ডা হয়ে গেল ।” ভোর ৩-৩০/৪-oo টের মধ্যে উঠে পড়ে উনি করুণাময়ী কালীমন্দিরে প্রাত্যাহিক কালীকীর্ত্তন বা ওনার অন্যান্য ক্রিয়া সেরে নিতেন । মন্দির থেকে বাড়ী ফিরলেই সকাল ৫টা থেকে ফোন কল শুরু হয়ে যেতো । আর সাধারণত শেষ হোত রাত্রি দশটা বা সাড়ে দশটায় । তবে সারারাত ফোন ধরার কথাও আমি জানি – আমাদের গ্রামের ধীরুভাই যখন কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্ত্তি ছিল , সেই সময় ধীরু হসপিটাল থেকে প্রায়ই ন’কাকা কে ফোন কোরতো। তারপর যেদিন ও মারা গেল (হয়তো ভোর 4.30 তে) __সেই দিন রাত্রিতে দশটা থেকে প্রতি ঘন্টায় ন্’ কাকাকে ফোন করেছিল __অর্থাৎ রাত্রি 10 টায়, রাত্রি 11টায়, রাত্রি 12 টায়, 1টায় _2টোয়-3টেয়,শেষ ফোন করেছিল 4-টেয়।ঐ সময় প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট চলছিল _নিদারুণ কষ্ট! ঐ অবস্থাতেই শেষ ফোন করে ন’ কাকাকে বলেছিল_”ন’কাকা! আর বোধহয় আপনাকে ফোন করতে পারবো না _আপনি নিজেও দেখবেন আর গুরুমহারাজকেও আমার কথা বলবেন!”
ন’কাকা এই ঘটনাটা বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছিলেন, এবং প্রতিবারই ধীরুভাই-এর সেইসময়কালীন কষ্টের জন্য ব্যাথা অনুভব করতেন।তাই বলছিলাম _সেই অর্থে ওনার কোন রেস্ট-ই ছিল না।
গুরুমহারাজ ও বলতেন _”জানিস তো – আমার কোনো privacy নেই! সবসময়ই আমার ঘরে কেউ না কেউ যাচ্ছে _আসছে! তোরা যেমন ঘরে আসছিস _কিন্তু দরজা বন্ধ করে দিলে তো আর আসতে পারিস না! কিন্তু সুক্ষ বা কারন শরীরে যারা আছে_ তাদেরকে তুই কি ভাবে আটকাবি!!! তারা সবসময়ই থাকে। এমনকি যখন আমি বাথরুমে স্নান করি প্রাতঃকৃত্য সারি__তখনও দেখি কেউ না কেউ জোড়হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোরা হয়তো ভাবছিস _`এতো বড় লজ্জার ব্যাপার!!`কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয় _যারা ঐ সময় আসতে পারে, তাদের দেহ বা শরীর-চেতনাই নাই। আমিও চেতনাকে ওদের স্তরে তুলে নিই _ফলে কোন অসুবিধা হয় না।”
বনগ্রামে আসার পর থেকেই ন’কাকা সম্বন্ধে গুরুমহারাজ শ্রদ্ধামিশ্রিত কথাবার্তা বলতেন _ফলে আমরা যখন প্রথম প্রথম বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে গেলাম, তখন থেকেই দেখতাম সকল আশ্রমিকরাই ন’ কাকাকে একটা বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছিল। এইসব দেখে বহিরাগত ভক্তরা অনেকে হয়তো একটু অবাকই হোত__এই মানুষটি ন’ কাকা!!! খালি গায়ে, খালি পায়ে _মাঠে মাঠে কোদাল হাতে ঘুরছে — এ কি করে মহাপুরুষ হয়!!
মুখার্জী পরিবার যখন তাদের জমিজমা
সব আশ্রমকে দিয়ে দিল (হয়তো কিছুটা শর্তসাপেক্ষেই) _তখন থেকে ন’কাকার মাঠে মাঠে ঘোরা বন্ধ হোল। মাঠে মাঠে ঘোরাকালীন উনি জুতো ছাড়াই চলতেন কারন তখন বনগ্রামের রাস্তায় বেশিরভাগ সময়েই কাদা থাকতো। ফলে প্রায়ই দেখতাম ওনার পায়ের আঙুলে ন্যাকড়া বাঁধা অর্থাৎ হোঁচট খাওয়া লেগেই থাকতো।
ব্যাপারটা এতো frequent ছিল যে _তখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম _’উনি তো সবসময় আত্নস্থ হয়েই থাকেন, তাই হাঁটার সময় ওনার শরীরবোধ থাকেনা। আর এইজন্যই প্রায়শই এইরকম হয়।
আমি তখন পরমানন্দ মিশন হাইস্কুলের part time শিক্ষকতা করি। গুরুমহারাজ সবে সবে শরীর ছেড়েছেন _সেই সময় আশ্রমিকদের ভাঙাচোরা মনকে জোড়া লাগানোর কাজটি করতেন ন’কাকা। সব department এ গিয়ে সবাইকে সঙ্গ দিতেন, সবার কথা শুনতেন এবং সহজ সরল কথায় তাদের মনের জ্বালা দূর করে দিতেন।
পরমানন্দ মিশনে গুরুমহারাজের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন ন’ কাকা – শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন তিনি এই পদ সামলেছিলেন। গুরুমহারাজের শরীর ছাড়ার পর পুরোনো কমিটি ভেঙে যখন নতুন কমিটি তৈরি হোল_ সেই কমিটির president হলেন তৃষাণ মহারাজ (স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) ।
পরমানন্দ মিশন হাইস্কুলের শিক্ষক হিসাবেও কিছুদিন ক্লাস নিয়েছেন ন’কাকা। আমরা অনেকদিন ওনাকে হাইস্কুলের ক্লাস নিতে দেখেছি। ছাত্রদের হাজিরার খাতা একহাতে, অন্য হাতে চক-ডাস্টার নিয়ে ক্লাস নিতে যাওয়া ন’ কাকা _সে বড় চমৎকার দৃশ্য!! উনি তৎকালীন যুগের B. A. _পাশ ছিলেন। ওনার হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো ঝকঝকে। আমার কাছে ওনার হাতের লেখা কাগজ অনেক রয়েছে _পাঠকদের দেখার জন্য ওনার হাতের লেখার কিছু অংশ আমি ফোটো তুলে এই লেখার সাথে সংযোজন করে দেব।
আমি যখন পরমানন্দ মিশনে থাকতাম তখন একদিন আশ্রমের রাস্তায় তৃষাণ মহারাজ (স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) ন’কাকা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন _”কোন সাধকের পক্ষে সাধনার দ্বারা শক্তিলাভ, সিদ্ধিলাভ বা ঐশ্বর্যলাভ করা খুবই দুরহের। শক্তিমান ছাড়া শক্তিলাভ করা যায় না। এই ধরনের এক একটা শক্তিলাভ করতে এক একটা সাধকের কত জন্ম লেগে যায়! কিন্তু সমস্ত শক্তি থাকা সত্ত্বেও সেই শক্তির বহিঃপ্রকাশ না ঘটানো আরো অনেক বেশি শক্তির দরকার _আর সেই ব্যক্তি(ন’কাকা) আরো বেশি শক্তিমান! (ক্রমশঃ)
জয় গূরূজী ।জয় ন’ কাকা ।