গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ছিলেন দয়ার অবতার , করুণার অবতার , প্রেম ভালোবাসার অবতার ! ন’কাকা (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী) প্রায়ই নজরুল ইসলামের লেখা একটি গানের লাইন গুরু মহারাজকে উদ্দেশ্য করে বলতেন – ” সখি ! সে হরি কেমন বল , নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে , চোখে আসে এত জল !” সত্যি সত্যিই তাঁর করুণার কথা , তাঁর প্রেমের কথা ভাবলেই চোখে জল ভরে আসে – কেউ বলতেই পারেন এটি হৃদয়দৌর্বল্যের লক্ষণ ! তা – হতে পারে , কিন্তু এটা আমাদের সত্যি সত্যিই হয় – তাই বললাম !
আর দূর্বলতার কথা বলবেন – ‘বল’ তো তাঁরই ! তাঁর ‘বলে’ই তো আমাদের সবলতা – না হলে প্রকৃতপক্ষে তো আমরা দুর্বলই ! গুরু মহারাজ বলতেন – ” তোরা কি পুরুষ ? পুরুষ একমাত্র সেই পুরুষোত্তম ! বাকি সবাই তো প্রকৃতি !” উনি আরও বলতেন – “দেখবি বৈষ্ণবরা এইজন্যেই কাছা দিয়ে কাপড় পড়ে না , গলায় মালা পরে , বড় চুল রাখে – ওরা ‘প্রকৃতি’ সাজে ! কিন্তু ‘সাজা’টা উদ্দেশ্য নয় – উদ্দেশ্য হ’ল _’হয়ে ওঠা’ ৷ সাজতে গেলেই ‘সাজা’ পেতে হবে । তাই শুধু সাজা নয় – ‘হয়ে ওঠা’ ! যারা হয়ে উঠতে পারে – তাঁরাই প্রকৃত বৈষ্ণব , তাঁরা ধন্য ! বাকিদের শুধু সাজা আর তারজন্য ‘সাজা’ ভোগ অর্থাৎ বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরে ফিরে আসা !”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” প্রকৃত বৈষ্ণব হতে গেলে আগে পরম শাক্ত হতে হবে !” কথাটা আমরা ভালো করে বুঝতে পারিনি দেখে উনি আমাদেরকে বুঝিয়ে বলেছিলেন – শাক্ত মানে শক্তির উপাসক । শক্তিমান না হলে কোন সাধনাই সুসম্পন্ন করা যায় না ! বৈষ্ণবদের পরম পুরুষার্থ হ’ল প্রেম ! আর সে প্রেম যে সে প্রেম নয় – “রাধার প্রেম” ! এই অপার্থিব প্রেম লাভ করা যেমন তেমন কথা নয় ! সমস্ত সাধনা সমাপ্ত হলে _তবে এই প্রেমলাভ হয়! এরপর গুরু মহারাজ এক লাইনে সার কথা বলে দিয়েছিলেন – “তোমার কর্ম হোক ধ্যান , ধ্যানে ভর করুক জ্ঞান , আর জ্ঞানের সিংহাসনে বিরাজ করুক প্রেম – এটাই অধ্যাত্ম বিজ্ঞান , বলে দিলাম যাও ৷”
আমরা ফিরে আসি আগের কথায় – যেখান থেকে আগের এপিসোড শেষ করেছিলাম , সেখান থেকে আবার পুনরায় শুরু করা যাক ! বলা হচ্ছিল করুণাময় গুরুদেব স্বামী পরমানন্দ তাঁর ভক্তদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে অকাতরে করুণা বিতরণ করতেন ! এটাই প্রত্যাশা বিহীন ভালোবাসা – তাই এই অকাতরে করুণা বিতরণ! এই বিতরণের মধ্যে তাঁর নিজের ‘আয়ুদান’ও ছিল ! এইজন্যেই গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন — রবি ঠাকুরের লেখা , “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ”– এইসব কথা গুলি সেই সব মহাপুরুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – যাঁরা সত্যি সত্যিই তাঁদের মৃত্যুহীন প্রাণটাও মানব কল্যাণের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সদা সর্বদা বিতরণ করে যান! তাঁরা পাত্রাপাত্র বিচার করেন না – ছোট-বড় , উচ্চ-নীচ দেখেন না ! তাঁরা করুনার পাত্র পেলেই করুণা করেন!
এবার যে কথা হচ্ছিল, সেটা হোল__ভগবানের করুণা লাভ করেও, তা বিস্মৃত হওয়াটা যে অপরাধের – সেই প্রসঙ্গে ! একদিন আমরা বনগ্রাম আশ্রমে সকালের সিটিংয়ে বসে আছি – এমন সময় কাঁকুরে-সহজপুরের(বর্ধমান _কালনা রুটের বুলবুলিতলার সন্নিকট গ্রাম) সুদেব কর্মকার তার দলবলের সঙ্গে গুরু মহারাজের কাছে এসে হাজির হল [ সুদেব বাবু ওই অঞ্চলের মধ্যে একটু নামকরা ধনবান ব্যক্তি ছিলেন ।ওনার অনেক বিষয় সম্পত্তি তো ছিলই, তাছাড়াও ওনার তেজারতি কারবার সহ একটা বেশ চালু সোনা-রুপার দোকান ছিল)। ওনার সাথে সব সময় একদল মানুষ থাকতেন, যারা সকলেই গুরু মহারাজের ভক্ত ছিলেন । সুদেববাবু , বংশধর বিশ্বাস , সচিনদা (যাকে আমরা ‘ছোট গোবিন্দ’ বলতাম , কারণ বনগ্রামের প্রথম দিকে যখন থেকে মাটির রান্না ঘর তৈরি হলো , তখন ধাত্রীগ্রাম মালতিপুরের গোবিন্দ প্রামাণিক সকলের রান্নার দায়িত্ব নিয়েছিলেন , এই সচিনদা ওকে সাহায্য করতো । দুজনেরই একটু পেটটা মোটা মত (ভুঁড়ি) ছিল , দুজনেরই বড় বড় চুল এবং লম্বা দাড়ি ছিল ৷ তাই ছেলেপিলেরা ওদের দুজনকে মজা করে বলত ‘বড়গোবিন্দ’, ‘ছোটগোবিন্দ’) এবং সুদেব বাবুর দলের বাকি সকলে মিলে ওখানে একটা পরমানন্দ মিশনের শাখাও তৈরি করেছিলেন, যেটা এখনও কাজ করে চলেছে। ঐ ছোট গোবিন্দ বা শচীনদা পরবর্ত্তীতে বাণপ্রস্থ সন্ন্যাস নিয়ে ঐ আশ্রমের দায়িত্বে রয়েছে। বনগ্রাম থেকে এখন হরি মহারাজ (স্বামী সহজানন্দ), মুরারী মহারাজ (স্বামী নিস্কামানন্দ)-রা মাঝে মাঝে ঐ আশ্রমে যান এবং ওখানকার ভক্তদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।] __এবং আরও দু-চারজন সিটিং চলাকালীন সময়ে হুড়মুড় করে একেবারে গুরুমহারাজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল!
গুরুমহারাজ সেইসময় ২/৩-মাস বা হয়তো আর একটু বেশি সময় ধরে বনগ্রামের বাইরে ছিলেন _উনি বোধহয় মাত্র ২/৪-দিন আগে আশ্রমে এসে পৌঁছেছিলেন, তাই সবজায়গার ভক্তরা তখনও খবর পায়নি বলে সিটিং-এ ভিড়টা একটু কম ছিল। সুদেব বাবুরা তক্কে-তক্কেই ছিলেন _গুরুমহারাজের আসার খবর পেয়েই কাঁকুরে-সহজপুর থেকে দলবল নিয়ে ছুটে এসেছিলেন!
যাইহোক, ঘটনাতে ফিরে আসি! সুদেববাবু গুরুমহারাজের কাছে পৌঁছেই ধরাস্ করে গুরুমহারাজের পায়ের কাছে পড়ে গেলেন, এবং গুরুজীর রাতুল চরন দুটি ধরে _সে কি কান্না!! সুদেববাবুর আর কি দোষ___আমাদের মতো সাধারণ বিষয়ী লোকের বিষয়(ধনসম্পত্তি) চলে গেলে যে শোক হয় _তা সন্তানশোককেও ছাড়িয়ে যায়! এই জন্যই গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”কামকীটের মুক্তি আছে, বিষয়কীটের মুক্তি নাই!”
আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছি __ ফিরে আসি কথায়, ____সুদেববাবু গুরুমহারাজের পাদুটি ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন _”বাবা! আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে _ বাবা!! আমার কপালে নল(বন্দুকের) ঠেকিয়ে আমার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল বাবা!”[ঘটনাটা যেটা ঘটেছিল, সেটা হোল কদিন আগেই অর্থাৎ গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রমের বাইরে থাকাকালীন সময়ে, সুদেববাবুর সোনার দোকানে সন্ধ্যারাতেই চুরি হয়েছিল! তখনও উনি দোকানেই ছিলেন _সেই অবস্থায় বন্দুক দেখিয়ে, দোকানের মালপত্র নিয়ে চোরেরা চম্পট দেয়!]
সুদেববাবুর বলা শেষ হোতে না হোতেই গুরুমহারাজ গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন _”সুদেব! ছাড়্-ছাড়্-পা ছাড়্ বলছি! কাঁদবি না, কান্নার মতো তেমন কিছু হয়নি! গুরুর কাছে মিথ্যা বলতে নেই, আমি সব জানি _তুই চুপ কর্! নাহলে কিন্তু তোর আরো বড় অনর্থ হয়ে যাবে!”
গুরুমহারাজের শেষের কথাগুলো শুনে সুদেববাবু কান্না বন্ধ করে গুরুজীর পা-দুটো ছেড়ে দিলেন । তখন গুরুমহারাজ আবার বলতে লাগলেন __”সুদেব! তোর তো দুবছর আগেই মৃত্যু যোগ ছিল! মা জগদম্বার কৃপায় এখনও তুই বেঁচে আছিস! তোর এখন extention period চলছে ! নতুন জীবন পাবার পর তোকে আমি কি বলেছিলাম __বলেছিলাম যে তোর বিষয়_আশয়, সোনার দোকান, সংসার ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ভার তোর সন্তানের উপর দিয়ে _তুই শুধু ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে থাকবি, ধ্যান-জপ করবি, সাধন-ভজন করবি! কিন্তু তুই গুরুবাক্য লঙ্ঘন করলি! কর্তৃত্বের অভিমান ছাড়তে পারলি না! ছেলেদের বিবাহ হয়ে গেছে _সন্তানাদি হয়ে গেছে, তবু তোর চোখে _’ওরা ছোট, ওরা ব্যাবসা বোঝেনা?’
তাহলে এখন তুই বোঝ্!! নানা ঝামেলা ভোগ কর্!! প্রারব্ধ সৃষ্টি করছিস _তাই এসব ঘটছে! গুরুবাক্য লঙ্ঘনের ফল! এখনো এইভাবে চললে আরো বেশি বেশি অনর্থ ঘটবে!”
এরপর গুরুমহারাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলতে লাগলেন _” তুই কি বলছিলি _’তোর সর্বস্ব লুঠ হয়েছে’, সত্যি কি তাই হয়েছে? শুধু বন্ধকী কারবারের কিছু গহনা এবং অল্প কিছু টাকা তোর গেছে! তাছাড়া তুই যে বললি _’ কপালে নল(বন্দুকের) ঠেকিয়ে লুঠ করেছে’, এটাও কি ঠিক বললি? চোরেরা যখন তোর দিকে বন্দুক তাক্ করল _তখন তুই কি করছিলি?”
সুদেববাবু বললেন _”বাবা! আমি প্রানভয়ে একান্তভাবে শুধু আপনাকেই স্মরণ করছিলাম! ”
গুরুমহারাজ বললেন _”হ্যাঁ, তুই —‘গুরুদেব রক্ষা কর’ বলে উঠলি! তাহলে ঐ বন্দুকের নল আর তোর দিকে ‘তাক্ করা’ থাকল কোথায় _তুই তো নলটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলি!!”
গুরুমহারাজের কথা শুনে সুদেববাবু আবার কাঁদতে কাঁদতে গুরুমহারাজের পা ধরে বললেন _” বাবা! এবার থেকে আপনার নির্দেশ পালন করে জীবন কাটানোর চেষ্টা করব!”(ক্রমশঃ)
আর দূর্বলতার কথা বলবেন – ‘বল’ তো তাঁরই ! তাঁর ‘বলে’ই তো আমাদের সবলতা – না হলে প্রকৃতপক্ষে তো আমরা দুর্বলই ! গুরু মহারাজ বলতেন – ” তোরা কি পুরুষ ? পুরুষ একমাত্র সেই পুরুষোত্তম ! বাকি সবাই তো প্রকৃতি !” উনি আরও বলতেন – “দেখবি বৈষ্ণবরা এইজন্যেই কাছা দিয়ে কাপড় পড়ে না , গলায় মালা পরে , বড় চুল রাখে – ওরা ‘প্রকৃতি’ সাজে ! কিন্তু ‘সাজা’টা উদ্দেশ্য নয় – উদ্দেশ্য হ’ল _’হয়ে ওঠা’ ৷ সাজতে গেলেই ‘সাজা’ পেতে হবে । তাই শুধু সাজা নয় – ‘হয়ে ওঠা’ ! যারা হয়ে উঠতে পারে – তাঁরাই প্রকৃত বৈষ্ণব , তাঁরা ধন্য ! বাকিদের শুধু সাজা আর তারজন্য ‘সাজা’ ভোগ অর্থাৎ বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরে ফিরে আসা !”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” প্রকৃত বৈষ্ণব হতে গেলে আগে পরম শাক্ত হতে হবে !” কথাটা আমরা ভালো করে বুঝতে পারিনি দেখে উনি আমাদেরকে বুঝিয়ে বলেছিলেন – শাক্ত মানে শক্তির উপাসক । শক্তিমান না হলে কোন সাধনাই সুসম্পন্ন করা যায় না ! বৈষ্ণবদের পরম পুরুষার্থ হ’ল প্রেম ! আর সে প্রেম যে সে প্রেম নয় – “রাধার প্রেম” ! এই অপার্থিব প্রেম লাভ করা যেমন তেমন কথা নয় ! সমস্ত সাধনা সমাপ্ত হলে _তবে এই প্রেমলাভ হয়! এরপর গুরু মহারাজ এক লাইনে সার কথা বলে দিয়েছিলেন – “তোমার কর্ম হোক ধ্যান , ধ্যানে ভর করুক জ্ঞান , আর জ্ঞানের সিংহাসনে বিরাজ করুক প্রেম – এটাই অধ্যাত্ম বিজ্ঞান , বলে দিলাম যাও ৷”
আমরা ফিরে আসি আগের কথায় – যেখান থেকে আগের এপিসোড শেষ করেছিলাম , সেখান থেকে আবার পুনরায় শুরু করা যাক ! বলা হচ্ছিল করুণাময় গুরুদেব স্বামী পরমানন্দ তাঁর ভক্তদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে অকাতরে করুণা বিতরণ করতেন ! এটাই প্রত্যাশা বিহীন ভালোবাসা – তাই এই অকাতরে করুণা বিতরণ! এই বিতরণের মধ্যে তাঁর নিজের ‘আয়ুদান’ও ছিল ! এইজন্যেই গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন — রবি ঠাকুরের লেখা , “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ”– এইসব কথা গুলি সেই সব মহাপুরুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – যাঁরা সত্যি সত্যিই তাঁদের মৃত্যুহীন প্রাণটাও মানব কল্যাণের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সদা সর্বদা বিতরণ করে যান! তাঁরা পাত্রাপাত্র বিচার করেন না – ছোট-বড় , উচ্চ-নীচ দেখেন না ! তাঁরা করুনার পাত্র পেলেই করুণা করেন!
এবার যে কথা হচ্ছিল, সেটা হোল__ভগবানের করুণা লাভ করেও, তা বিস্মৃত হওয়াটা যে অপরাধের – সেই প্রসঙ্গে ! একদিন আমরা বনগ্রাম আশ্রমে সকালের সিটিংয়ে বসে আছি – এমন সময় কাঁকুরে-সহজপুরের(বর্ধমান _কালনা রুটের বুলবুলিতলার সন্নিকট গ্রাম) সুদেব কর্মকার তার দলবলের সঙ্গে গুরু মহারাজের কাছে এসে হাজির হল [ সুদেব বাবু ওই অঞ্চলের মধ্যে একটু নামকরা ধনবান ব্যক্তি ছিলেন ।ওনার অনেক বিষয় সম্পত্তি তো ছিলই, তাছাড়াও ওনার তেজারতি কারবার সহ একটা বেশ চালু সোনা-রুপার দোকান ছিল)। ওনার সাথে সব সময় একদল মানুষ থাকতেন, যারা সকলেই গুরু মহারাজের ভক্ত ছিলেন । সুদেববাবু , বংশধর বিশ্বাস , সচিনদা (যাকে আমরা ‘ছোট গোবিন্দ’ বলতাম , কারণ বনগ্রামের প্রথম দিকে যখন থেকে মাটির রান্না ঘর তৈরি হলো , তখন ধাত্রীগ্রাম মালতিপুরের গোবিন্দ প্রামাণিক সকলের রান্নার দায়িত্ব নিয়েছিলেন , এই সচিনদা ওকে সাহায্য করতো । দুজনেরই একটু পেটটা মোটা মত (ভুঁড়ি) ছিল , দুজনেরই বড় বড় চুল এবং লম্বা দাড়ি ছিল ৷ তাই ছেলেপিলেরা ওদের দুজনকে মজা করে বলত ‘বড়গোবিন্দ’, ‘ছোটগোবিন্দ’) এবং সুদেব বাবুর দলের বাকি সকলে মিলে ওখানে একটা পরমানন্দ মিশনের শাখাও তৈরি করেছিলেন, যেটা এখনও কাজ করে চলেছে। ঐ ছোট গোবিন্দ বা শচীনদা পরবর্ত্তীতে বাণপ্রস্থ সন্ন্যাস নিয়ে ঐ আশ্রমের দায়িত্বে রয়েছে। বনগ্রাম থেকে এখন হরি মহারাজ (স্বামী সহজানন্দ), মুরারী মহারাজ (স্বামী নিস্কামানন্দ)-রা মাঝে মাঝে ঐ আশ্রমে যান এবং ওখানকার ভক্তদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।] __এবং আরও দু-চারজন সিটিং চলাকালীন সময়ে হুড়মুড় করে একেবারে গুরুমহারাজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল!
গুরুমহারাজ সেইসময় ২/৩-মাস বা হয়তো আর একটু বেশি সময় ধরে বনগ্রামের বাইরে ছিলেন _উনি বোধহয় মাত্র ২/৪-দিন আগে আশ্রমে এসে পৌঁছেছিলেন, তাই সবজায়গার ভক্তরা তখনও খবর পায়নি বলে সিটিং-এ ভিড়টা একটু কম ছিল। সুদেব বাবুরা তক্কে-তক্কেই ছিলেন _গুরুমহারাজের আসার খবর পেয়েই কাঁকুরে-সহজপুর থেকে দলবল নিয়ে ছুটে এসেছিলেন!
যাইহোক, ঘটনাতে ফিরে আসি! সুদেববাবু গুরুমহারাজের কাছে পৌঁছেই ধরাস্ করে গুরুমহারাজের পায়ের কাছে পড়ে গেলেন, এবং গুরুজীর রাতুল চরন দুটি ধরে _সে কি কান্না!! সুদেববাবুর আর কি দোষ___আমাদের মতো সাধারণ বিষয়ী লোকের বিষয়(ধনসম্পত্তি) চলে গেলে যে শোক হয় _তা সন্তানশোককেও ছাড়িয়ে যায়! এই জন্যই গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”কামকীটের মুক্তি আছে, বিষয়কীটের মুক্তি নাই!”
আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছি __ ফিরে আসি কথায়, ____সুদেববাবু গুরুমহারাজের পাদুটি ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন _”বাবা! আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে _ বাবা!! আমার কপালে নল(বন্দুকের) ঠেকিয়ে আমার সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল বাবা!”[ঘটনাটা যেটা ঘটেছিল, সেটা হোল কদিন আগেই অর্থাৎ গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রমের বাইরে থাকাকালীন সময়ে, সুদেববাবুর সোনার দোকানে সন্ধ্যারাতেই চুরি হয়েছিল! তখনও উনি দোকানেই ছিলেন _সেই অবস্থায় বন্দুক দেখিয়ে, দোকানের মালপত্র নিয়ে চোরেরা চম্পট দেয়!]
সুদেববাবুর বলা শেষ হোতে না হোতেই গুরুমহারাজ গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন _”সুদেব! ছাড়্-ছাড়্-পা ছাড়্ বলছি! কাঁদবি না, কান্নার মতো তেমন কিছু হয়নি! গুরুর কাছে মিথ্যা বলতে নেই, আমি সব জানি _তুই চুপ কর্! নাহলে কিন্তু তোর আরো বড় অনর্থ হয়ে যাবে!”
গুরুমহারাজের শেষের কথাগুলো শুনে সুদেববাবু কান্না বন্ধ করে গুরুজীর পা-দুটো ছেড়ে দিলেন । তখন গুরুমহারাজ আবার বলতে লাগলেন __”সুদেব! তোর তো দুবছর আগেই মৃত্যু যোগ ছিল! মা জগদম্বার কৃপায় এখনও তুই বেঁচে আছিস! তোর এখন extention period চলছে ! নতুন জীবন পাবার পর তোকে আমি কি বলেছিলাম __বলেছিলাম যে তোর বিষয়_আশয়, সোনার দোকান, সংসার ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ভার তোর সন্তানের উপর দিয়ে _তুই শুধু ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে থাকবি, ধ্যান-জপ করবি, সাধন-ভজন করবি! কিন্তু তুই গুরুবাক্য লঙ্ঘন করলি! কর্তৃত্বের অভিমান ছাড়তে পারলি না! ছেলেদের বিবাহ হয়ে গেছে _সন্তানাদি হয়ে গেছে, তবু তোর চোখে _’ওরা ছোট, ওরা ব্যাবসা বোঝেনা?’
তাহলে এখন তুই বোঝ্!! নানা ঝামেলা ভোগ কর্!! প্রারব্ধ সৃষ্টি করছিস _তাই এসব ঘটছে! গুরুবাক্য লঙ্ঘনের ফল! এখনো এইভাবে চললে আরো বেশি বেশি অনর্থ ঘটবে!”
এরপর গুরুমহারাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলতে লাগলেন _” তুই কি বলছিলি _’তোর সর্বস্ব লুঠ হয়েছে’, সত্যি কি তাই হয়েছে? শুধু বন্ধকী কারবারের কিছু গহনা এবং অল্প কিছু টাকা তোর গেছে! তাছাড়া তুই যে বললি _’ কপালে নল(বন্দুকের) ঠেকিয়ে লুঠ করেছে’, এটাও কি ঠিক বললি? চোরেরা যখন তোর দিকে বন্দুক তাক্ করল _তখন তুই কি করছিলি?”
সুদেববাবু বললেন _”বাবা! আমি প্রানভয়ে একান্তভাবে শুধু আপনাকেই স্মরণ করছিলাম! ”
গুরুমহারাজ বললেন _”হ্যাঁ, তুই —‘গুরুদেব রক্ষা কর’ বলে উঠলি! তাহলে ঐ বন্দুকের নল আর তোর দিকে ‘তাক্ করা’ থাকল কোথায় _তুই তো নলটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলি!!”
গুরুমহারাজের কথা শুনে সুদেববাবু আবার কাঁদতে কাঁদতে গুরুমহারাজের পা ধরে বললেন _” বাবা! এবার থেকে আপনার নির্দেশ পালন করে জীবন কাটানোর চেষ্টা করব!”(ক্রমশঃ)