গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ প্রায়ই একটা কথা বলতেন – ” আমি তোদের দোষ দেখি না ! যদি তোদের দোষ দেখতাম তাহলে কি তোরা এখানে থাকতে পারতিস , না আমার কাছে আসতে পারতিস ? আশ্রমের এক ব্রহ্মচারিণী (তৎকালীন) একদিন বিকেলে গুরু মহারাজকে চা দেবার জন্য আসছিল – গুরু মহারাজের কাছটায় এসে হঠাৎ করে তার মনঃসংযোগ হারিয়ে গেল , সে উপস্থিত লোকজনের দিকে তাকিয়ে ফেলল এবং সাথে সাথে তার পা টা সিটিংয়ে পাতা ত্রিপলের ধারে লেগে গেল এবং তার হাতে গুরু মহারাজের জন্য আনা চা ছলকে গিয়ে একেবারে গুরু মহারাজের গেরুয়ায় – ! আর ঐ গুরু মহারাজের বকা ! উনি যখন যাকে বকতেন – তার একেবারে ছাল ছাড়িয়ে দিতেন ! সেদিন ও তার ব্যত্যয় হলো না !
সেদিন ওই ব্রহ্মচারিণীকে ‘বকা’ দেওয়ার সময়-ই ওই কথাগুলো শুনেছিলাম যে , উনি কারও দোষ দেখেন না – তাই আমরা ওনার কাছে যেতে পারি ! না হলে ওনার ত্রিসীমানায় কেউ পৌঁছাতেই পারতাম না ! সেই দিনই আমরা প্রথম শুনলাম ‘খিদমত’ ও ‘সেবা’-র মধ্যে পার্থক্যের কথা ! উনি বললেন – ” কোন কাজ কর্তব্য মনে করে করা , বা শুধু করতে হয় – তাই করা – এটাই খিদমত খাটা ! আর কোন প্রিয়জনের প্রীত্যর্থে যে কাজ – তাই সেবা ! সেবায় সম্পূর্ণভাবে আত্নত্যাগের ভাব থাকে _ সেবা নিঃস্বার্থ হয় ! সবাই সেবার অধিকারী নয় – আমি ইচ্ছা করে ওদেরকে আমার কাজ করার অধিকার দিয়েছি , যাতে ওদের কল্যাণ হয় !”
এই প্রসঙ্গে উনি বললেন – ” ভগবান বুদ্ধের সর্বক্ষণের সেবা কার্যের জন্য ওনার শিষ্যদের মধ্যে থেকে ‘আনন্দ’ কে বেছে নেওয়া হয়েছিল ! কিন্তু আনন্দ ছিল বুদ্ধিমান ছেলে – ও দেখল বুদ্ধের সেবা করতে গেলে – কোন না কোন সময় –কোন না কোন ভুল হবেই ! তাই সেবা ভার গ্রহণের পূর্বে আনন্দ – ভগবান বুদ্ধের কাছে গিয়ে নত মস্তকে তার মনের ভাব ব্যক্ত করল ! বলল “হে ভগবান ! আমি অবোধ বালক ! আপনার সেবা কার্য করতে গিয়ে আমার নানান ভুল হতে পারে ৷ যেমন – আপনাকে খাবার পরিবেশন করার সময় আমার খাদ্যে লোভ হতে পারে , আপনার বিশ্রামের সময় পদসেবা করতে গিয়ে আমার নিদ্রাকর্ষণ হতে পারে – ইত্যাদি আরো অনেক ভুল হতে পারে ! কিন্তু হে ভগবান ! আপনি আমাকে কথা দিন যে – এই ধরনের যে ভুলগুলি আমার দ্বারা হবে – তা আপনি ক্ষমা করবেন ! তবেই আমি আপনার সেবার ভার নেব – অন্যথায় আপনি অন্য কাউকে এই কাজের জন্য নির্বাচন করুন !”
ভগবান বুদ্ধ বালক আনন্দের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং তাকে আশ্বস্ত করে সেবার অধিকার দিয়েছিলেন!
আমরা তো ভগবান পরমানন্দের কাছে প্রার্থনা করে রাখিনি! তাই করুণাময় ভগবান পরমানন্দ বলে দিলেন – ” আমি তোদের দোষ দেখিনা , অপরাধ নিই না !”
তাইতো করুণাময় ভগবান পরমানন্দের কথা মনে পরলেই চোখে জল ভরে আসে – ” হে ভগবান ! এত করুণা তোমার ! তুমি আমাদের দোষ দেখো না , আমাদের অপরাধ নাও না , সব মার্জনা করে দাও ! তোমার এই মহিমা বর্ণনা করার সাধ্য কার ?”
তবে ‘সেবা’ করায় ত্রুটি হলে যে সেবা অপরাধ হয় এবং বৈষ্ণবরা সেবা অপরাধ ব্যাপারটার খুবই মান্যতা দেয় – এইটা গুরু মহারাজ একদিন আলোচনা করছিলেন __! বৈষ্ণব মতে নানা ধরনের বৈষ্ণব অপরাধ রয়েছে ৷ উনি সেদিন উদাহরণ হিসাবে একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন_ সেটা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন – তবু আর একবার বলছি__!!
মহাপ্রভু রূপ ও সনাতনকে পাঠিয়েছিলেন লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের নিমিত্ত ! তখন বৃন্দাবন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল ! রূপ এবং সনাতন সেই জঙ্গলের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসতেন এবং মহাপ্রভুর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতেই চোখের সামনে ভেসে উঠত – “দ্বাপরের কৃষ্ণলীলার প্রত্যক্ষ চিত্র !”
রুপ গোস্বামীর অন্তর্ধানের পর সনাতন গোস্বামীই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন! তিনি বনের মধ্যে ধ্যান করতে করতে কোথাও দেখতেন বালক শ্রীকৃষ্ণ রাখালদের সাথে স্নান করছেন, কোথাও দেখতেন রাধারানী সখীদের নিয়ে নাইছেন আর আনন্দ করছেন__উনি বুঝতে পারতেন কোনটা ‘রাধাকুন্ড’, কোনটা ‘শ্যামকুন্ড’! এইভাবে হাজার হাজার বছর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস _মহাপ্রভূর নির্দেশে আবিস্কার করেছিলেন, ছয়গোঁসাই-এর শিরোমনি রুপ ও সনাতন!
একদিন সনাতন গোস্বামী আশ্রম থেকে অনেকটা দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রত্যক্ষ করছেন _’রাধাকুন্ডে রাধারানী সখীদের নিয়ে জলক্রীড়া করছেন _এমন সময় হঠাৎ করে সেখানে চপলমতি কিশোর কৃষ্ণ গিয়ে হাজির! তাকে দেখেই সখীরা জল ছিটিয়ে কৃষ্ণকে ভিজিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল _আর চতুরচূড়ামনি সুকৌশলে এড়িয়ে এড়িয়ে যেতে লাগলেন। হটাৎ করে রাধারানীর ছিটানো জলে কৃষ্ণ একেবারে ভিজে কাতর!! আর সঙ্গে সঙ্গে সখীদের খিলখিল করে সে কি হাসি! ধ্যানে নিমগ্ন সনাতনও এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলেন, তাই তিনিও হো হো করে হেসে উঠছিলেন! অপরদিকে ভগবান যখন জল ছিটিয়ে রাধারানীকে ভেজানোর চেষ্টা করছিলেন _তখন রাধারানীও সরে সরে যাচ্ছিলেন _কিন্তু একবার যেই কৃষ্ণের ছোঁড়া জলে রাধারানী ভিজলেন _তখন কৃষ্ণকিশোরের সে কি হাসি! ভগবানের হাসি দেখে _সনাতনের হাসি আর ধরে না!!
কিন্তু এদিকে ঠিক সেই সময়ে একটা অঘটন ঘটে গেল! একটি ঘন কৃষ্ণবর্নের কুৎসিত দর্শন এক বৃদ্ধ, নুব্জ-কুব্জ বৈষ্ণব সেখানে এসে হাজির হয়েছিল! সে বহুদিন ধরে পরম বৈষ্ণব সনাতন গোস্বামীর নাম শুনে আসছিল_তাই ভাবল মৃত্যুর আগে অন্তত একবার ঐ পরমপাবনের সাথে দেখা করতে পারলেও তার জীবন সার্থক হবে __এই ভেবে সে বহুদূর থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করে ওখানে পৌঁছেছিল!
কিন্তু যে মুহূর্তে ঐ বৈষ্ণব ওখানে পৌঁছেছিল _ঠিক সেই মুহূর্তেই ধ্যানমগ্ন সনাতনের মানসপটে ভেসে ওঠা রাধাকৃষ্ণের জলক্রীড়ার দৃশ্য দেখে _ঐ হো হো করে হাসি!!
অঘটন টা ঘটল তখনই _ঐ বৃদ্ধ বৈষ্ণব ভেবে বসল যে, তার কুৎসিত চেহারা দেখে আর পাঁচজনের মতো সনাতনও বোধহয় হাসছে!! তাহলে আর এই লোকটার সাথে দেখা করে কি লাভ! তাই মনে গভীর দুঃখ নিয়ে বৃদ্ধ যেই না পিছু হটেছে _অমনি সনাতনের ধ্যানের অন্তর্লীন অবস্থা কেটে গেল! শত চেষ্টাতেও আর মনঃসংযোগ করতে পারলেন না, মানসপটে ভেসে ওঠা দৃশ্যও বন্ধ হয়ে গেল!
কাঁদতে লাগলেন সনাতন _কেন এমনটা হোল!! তাহলে কি তিনি কোন বৈষ্ণবের মনে আঘাত দিয়েছেন!! ছুটলেন আশ্রমে _সবাইকে জনে জনে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন _’তিনি কি কারো প্রতি কোন অন্যায় করে ফেলেছেন! আশ্রমিক রা তো সবাই গুরুস্থানীয় এই মহান বৈষ্ণবের এ হেন আচরণ দেখে খুবই কুন্ঠিত বোধ করতে লাগল এবং সনাতনকে আশ্বস্ত ও শান্ত করতে চেষ্টা করতে লাগল! কিন্তু সনাতন স্থির হতে পারছিলেন না, এদিক-ওদিক চাইতেই দুরে দেখলেন একজন বৃদ্ধ বৈষ্ণব চলে যাচ্ছে! উনি তখন ছুটে গিয়ে সেই বৈষ্ণবের পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন _”আমি কি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আপনার প্রতি কোন অন্যায় করে ফেলেছি?
সেই ব্যক্তি প্রথমটায় খুবই অবাক হোল, তারপর সনাতনের ব্যাকুলতা দেখে ঘটনাটা সব বলল। সব শুনে সনাতন ঐ বৈষ্ণবকে আসল রহস্যটা খুলে বললেন! সে সব কথা শুনে ঐ বৈষ্ণব কাঁদতে লাগলেন_তিনিও সনাতনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন! কিন্তু সনাতন ঐ কুৎসিতদর্শন বৈষ্ণবের হাতদুটি ধরে বললেন_ “কিন্তু আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো? আমি আপনার মনে আঘাত দিয়ে বৈষ্ণব-অপরাধ করে ফেলেছি _আপনি ক্ষমা করলে তবেই ঐ অপরাধ খন্ডন হবে!!”
বৃদ্ধ তাঁকে আশ্বস্ত করলেন এবং সনাতন আবার তাঁর পূর্বাবস্থা ফিরে পেলেন। সেই বৃদ্ধ বৈষ্ণব সেদিন এক মহাবৈষ্ণবের সান্নিধ্য লাভ করে জীবন ধন্য করেছিলেন এবং জীবনের বাকি কটা দিন ঐ আশ্রমেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন!!! (ক্রমশঃ)
সেদিন ওই ব্রহ্মচারিণীকে ‘বকা’ দেওয়ার সময়-ই ওই কথাগুলো শুনেছিলাম যে , উনি কারও দোষ দেখেন না – তাই আমরা ওনার কাছে যেতে পারি ! না হলে ওনার ত্রিসীমানায় কেউ পৌঁছাতেই পারতাম না ! সেই দিনই আমরা প্রথম শুনলাম ‘খিদমত’ ও ‘সেবা’-র মধ্যে পার্থক্যের কথা ! উনি বললেন – ” কোন কাজ কর্তব্য মনে করে করা , বা শুধু করতে হয় – তাই করা – এটাই খিদমত খাটা ! আর কোন প্রিয়জনের প্রীত্যর্থে যে কাজ – তাই সেবা ! সেবায় সম্পূর্ণভাবে আত্নত্যাগের ভাব থাকে _ সেবা নিঃস্বার্থ হয় ! সবাই সেবার অধিকারী নয় – আমি ইচ্ছা করে ওদেরকে আমার কাজ করার অধিকার দিয়েছি , যাতে ওদের কল্যাণ হয় !”
এই প্রসঙ্গে উনি বললেন – ” ভগবান বুদ্ধের সর্বক্ষণের সেবা কার্যের জন্য ওনার শিষ্যদের মধ্যে থেকে ‘আনন্দ’ কে বেছে নেওয়া হয়েছিল ! কিন্তু আনন্দ ছিল বুদ্ধিমান ছেলে – ও দেখল বুদ্ধের সেবা করতে গেলে – কোন না কোন সময় –কোন না কোন ভুল হবেই ! তাই সেবা ভার গ্রহণের পূর্বে আনন্দ – ভগবান বুদ্ধের কাছে গিয়ে নত মস্তকে তার মনের ভাব ব্যক্ত করল ! বলল “হে ভগবান ! আমি অবোধ বালক ! আপনার সেবা কার্য করতে গিয়ে আমার নানান ভুল হতে পারে ৷ যেমন – আপনাকে খাবার পরিবেশন করার সময় আমার খাদ্যে লোভ হতে পারে , আপনার বিশ্রামের সময় পদসেবা করতে গিয়ে আমার নিদ্রাকর্ষণ হতে পারে – ইত্যাদি আরো অনেক ভুল হতে পারে ! কিন্তু হে ভগবান ! আপনি আমাকে কথা দিন যে – এই ধরনের যে ভুলগুলি আমার দ্বারা হবে – তা আপনি ক্ষমা করবেন ! তবেই আমি আপনার সেবার ভার নেব – অন্যথায় আপনি অন্য কাউকে এই কাজের জন্য নির্বাচন করুন !”
ভগবান বুদ্ধ বালক আনন্দের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং তাকে আশ্বস্ত করে সেবার অধিকার দিয়েছিলেন!
আমরা তো ভগবান পরমানন্দের কাছে প্রার্থনা করে রাখিনি! তাই করুণাময় ভগবান পরমানন্দ বলে দিলেন – ” আমি তোদের দোষ দেখিনা , অপরাধ নিই না !”
তাইতো করুণাময় ভগবান পরমানন্দের কথা মনে পরলেই চোখে জল ভরে আসে – ” হে ভগবান ! এত করুণা তোমার ! তুমি আমাদের দোষ দেখো না , আমাদের অপরাধ নাও না , সব মার্জনা করে দাও ! তোমার এই মহিমা বর্ণনা করার সাধ্য কার ?”
তবে ‘সেবা’ করায় ত্রুটি হলে যে সেবা অপরাধ হয় এবং বৈষ্ণবরা সেবা অপরাধ ব্যাপারটার খুবই মান্যতা দেয় – এইটা গুরু মহারাজ একদিন আলোচনা করছিলেন __! বৈষ্ণব মতে নানা ধরনের বৈষ্ণব অপরাধ রয়েছে ৷ উনি সেদিন উদাহরণ হিসাবে একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন_ সেটা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন – তবু আর একবার বলছি__!!
মহাপ্রভু রূপ ও সনাতনকে পাঠিয়েছিলেন লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের নিমিত্ত ! তখন বৃন্দাবন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল ! রূপ এবং সনাতন সেই জঙ্গলের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসতেন এবং মহাপ্রভুর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতেই চোখের সামনে ভেসে উঠত – “দ্বাপরের কৃষ্ণলীলার প্রত্যক্ষ চিত্র !”
রুপ গোস্বামীর অন্তর্ধানের পর সনাতন গোস্বামীই এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন! তিনি বনের মধ্যে ধ্যান করতে করতে কোথাও দেখতেন বালক শ্রীকৃষ্ণ রাখালদের সাথে স্নান করছেন, কোথাও দেখতেন রাধারানী সখীদের নিয়ে নাইছেন আর আনন্দ করছেন__উনি বুঝতে পারতেন কোনটা ‘রাধাকুন্ড’, কোনটা ‘শ্যামকুন্ড’! এইভাবে হাজার হাজার বছর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস _মহাপ্রভূর নির্দেশে আবিস্কার করেছিলেন, ছয়গোঁসাই-এর শিরোমনি রুপ ও সনাতন!
একদিন সনাতন গোস্বামী আশ্রম থেকে অনেকটা দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রত্যক্ষ করছেন _’রাধাকুন্ডে রাধারানী সখীদের নিয়ে জলক্রীড়া করছেন _এমন সময় হঠাৎ করে সেখানে চপলমতি কিশোর কৃষ্ণ গিয়ে হাজির! তাকে দেখেই সখীরা জল ছিটিয়ে কৃষ্ণকে ভিজিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল _আর চতুরচূড়ামনি সুকৌশলে এড়িয়ে এড়িয়ে যেতে লাগলেন। হটাৎ করে রাধারানীর ছিটানো জলে কৃষ্ণ একেবারে ভিজে কাতর!! আর সঙ্গে সঙ্গে সখীদের খিলখিল করে সে কি হাসি! ধ্যানে নিমগ্ন সনাতনও এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলেন, তাই তিনিও হো হো করে হেসে উঠছিলেন! অপরদিকে ভগবান যখন জল ছিটিয়ে রাধারানীকে ভেজানোর চেষ্টা করছিলেন _তখন রাধারানীও সরে সরে যাচ্ছিলেন _কিন্তু একবার যেই কৃষ্ণের ছোঁড়া জলে রাধারানী ভিজলেন _তখন কৃষ্ণকিশোরের সে কি হাসি! ভগবানের হাসি দেখে _সনাতনের হাসি আর ধরে না!!
কিন্তু এদিকে ঠিক সেই সময়ে একটা অঘটন ঘটে গেল! একটি ঘন কৃষ্ণবর্নের কুৎসিত দর্শন এক বৃদ্ধ, নুব্জ-কুব্জ বৈষ্ণব সেখানে এসে হাজির হয়েছিল! সে বহুদিন ধরে পরম বৈষ্ণব সনাতন গোস্বামীর নাম শুনে আসছিল_তাই ভাবল মৃত্যুর আগে অন্তত একবার ঐ পরমপাবনের সাথে দেখা করতে পারলেও তার জীবন সার্থক হবে __এই ভেবে সে বহুদূর থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করে ওখানে পৌঁছেছিল!
কিন্তু যে মুহূর্তে ঐ বৈষ্ণব ওখানে পৌঁছেছিল _ঠিক সেই মুহূর্তেই ধ্যানমগ্ন সনাতনের মানসপটে ভেসে ওঠা রাধাকৃষ্ণের জলক্রীড়ার দৃশ্য দেখে _ঐ হো হো করে হাসি!!
অঘটন টা ঘটল তখনই _ঐ বৃদ্ধ বৈষ্ণব ভেবে বসল যে, তার কুৎসিত চেহারা দেখে আর পাঁচজনের মতো সনাতনও বোধহয় হাসছে!! তাহলে আর এই লোকটার সাথে দেখা করে কি লাভ! তাই মনে গভীর দুঃখ নিয়ে বৃদ্ধ যেই না পিছু হটেছে _অমনি সনাতনের ধ্যানের অন্তর্লীন অবস্থা কেটে গেল! শত চেষ্টাতেও আর মনঃসংযোগ করতে পারলেন না, মানসপটে ভেসে ওঠা দৃশ্যও বন্ধ হয়ে গেল!
কাঁদতে লাগলেন সনাতন _কেন এমনটা হোল!! তাহলে কি তিনি কোন বৈষ্ণবের মনে আঘাত দিয়েছেন!! ছুটলেন আশ্রমে _সবাইকে জনে জনে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন _’তিনি কি কারো প্রতি কোন অন্যায় করে ফেলেছেন! আশ্রমিক রা তো সবাই গুরুস্থানীয় এই মহান বৈষ্ণবের এ হেন আচরণ দেখে খুবই কুন্ঠিত বোধ করতে লাগল এবং সনাতনকে আশ্বস্ত ও শান্ত করতে চেষ্টা করতে লাগল! কিন্তু সনাতন স্থির হতে পারছিলেন না, এদিক-ওদিক চাইতেই দুরে দেখলেন একজন বৃদ্ধ বৈষ্ণব চলে যাচ্ছে! উনি তখন ছুটে গিয়ে সেই বৈষ্ণবের পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন _”আমি কি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আপনার প্রতি কোন অন্যায় করে ফেলেছি?
সেই ব্যক্তি প্রথমটায় খুবই অবাক হোল, তারপর সনাতনের ব্যাকুলতা দেখে ঘটনাটা সব বলল। সব শুনে সনাতন ঐ বৈষ্ণবকে আসল রহস্যটা খুলে বললেন! সে সব কথা শুনে ঐ বৈষ্ণব কাঁদতে লাগলেন_তিনিও সনাতনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন! কিন্তু সনাতন ঐ কুৎসিতদর্শন বৈষ্ণবের হাতদুটি ধরে বললেন_ “কিন্তু আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো? আমি আপনার মনে আঘাত দিয়ে বৈষ্ণব-অপরাধ করে ফেলেছি _আপনি ক্ষমা করলে তবেই ঐ অপরাধ খন্ডন হবে!!”
বৃদ্ধ তাঁকে আশ্বস্ত করলেন এবং সনাতন আবার তাঁর পূর্বাবস্থা ফিরে পেলেন। সেই বৃদ্ধ বৈষ্ণব সেদিন এক মহাবৈষ্ণবের সান্নিধ্য লাভ করে জীবন ধন্য করেছিলেন এবং জীবনের বাকি কটা দিন ঐ আশ্রমেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন!!! (ক্রমশঃ)