গুরু মহারাজের (স্বামী পরমানন্দ) বলা নানা কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ! সেই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে কিছু অন্যান্য প্রসঙ্গও এসে যাচ্ছে ! কিন্তু যে প্রসঙ্গ-ই আসুক না কেন আমাদের যা কিছু জ্ঞান_ সে তো গুরু মহারাজের কাছ থেকেই পাওয়া ! জীবনে ভালো যা কিছু সে তো সব তাঁরই দান – তাই যে প্রসঙ্গ-ই আসুক না কেন – তার কেন্দ্রে সেই “স্বামী পরমানন্দ” !
সাধনার গভীরে প্রবেশ করলে প্রথমেই সাধকের জীবনে নানান প্রলোভনের বস্তু (এতদিন যেগুলির প্রতি সে লালায়িত ছিল) লাভ হতে থাকে , তারপর আসতে থাকে সিদ্ধি ! এটাকেই গুরু মহারাজ আলোচনা করেছিলেন সমুদ্র মন্থনের সঙ্গে ! ভারতীয় পুরাণাদি শাস্ত্রে দেবাসুরে মিলেমিশে অমৃত কুম্ভ পাবার জন্য সমুদ্র মন্থন করেছিল ৷ এতে মন্থন দন্ড হয়েছিল মন্দারপর্বত এবং মন্থন দড়ি হয়েছিল বাসুকি নাগ ৷ গুরু মহারাজ এগুলির আধ্যাত্মিক রহস্য উন্মোচন করেছিলেন ! উনি বলেছিলেন – মানুষের মধ্যেই ভালো ও মন্দ রয়েছে , মানুষ তার ইন্দ্রিয়দের সাহায্যে খারাপ কাজও করতে পারে, আবার সে ওই গুলির সাহায্যে ভালো কাজ বা মানব কল্যাণমূলক কাজও করতে পারে ! এটাই সুর ও অসুরের তাৎপর্য্য ! (সাধারণভাবে আমরা বলি সাধকের শরীরের সমস্ত গ্রন্থি এবং নিশ্বাস প্রশ্বাস (বায়ু) যখন সাম্য অবস্থায় থাকে তখন সে সুরে আছে অর্থাৎ সে ‘সুর’ ! আর যার জীবনে সবকিছুই অসাম্য অবস্থায় আছে জীবনটাই বিশৃঙ্খলাময় – সেই ‘অসুর’ !) – যা প্রতিটি মানবের অন্তর্জগতেই রয়েছে !
এইবার মেরুদন্ড হল মন্দারপর্বত আর কুলকুণ্ডলিনী হলো বাসুকি নাগের রূপক ! সাধক তার শরীরাভ্যন্তরস্থ গ্রন্থিগুলির সু এবং কু উভয়বিধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং প্রাণ ও অপান বায়ুকে সাম্যে আনতে পারলে তা সুষুম্মায় প্রবেশ করে। এখানে ‘সমান’- বায়ুর ক্রিয়ার প্রভাবে কুলকুণ্ডলিনীর ঘুম ভাঙে – শুরু হয় মেরুদন্ড বরাবর এর অগ্রগতি ! কুলকুণ্ডলিনী সাড়ে তিন পাকে মূলাধারে নিজেকে জড়িয়ে রাখে – এরপর যথাক্রমে সাধিষ্ঠান , মনিপুর , অনাহত , বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্রগুলির একটি একটি করে ভেদ করতে করতে ঊর্ধ্বমুখে এগিয়ে আসে ! কুলকুণ্ডলিনীর এক একটি চক্র ভেদ হতে শুরু হোলেই সাধকের জীবনে আসে নানান ‘প্রাপ্তি’ বা সিদ্ধি ! এগুলিকেই পুরানকারেরা সমুদ্র-মন্থন থেকে প্রাপ্ত বস্তুসমূহ যেমন উচ্চৈঃশ্রবা , ঐরাবত , কৌস্তুভমণি , স্বয়ং লক্ষীদেবী ইত্যাদি আরও অনেক নামে বর্ণনা করেছেন ৷ এগুলি সবই সিদ্ধি ! সঠিক অধিকারীর হাতে এক-একটি উত্থিত বস্তুকে দেওয়া হয়েছিল ওখানে! আর বাস্তব ক্ষেত্রে যোগলব্ধ শক্তি (power) যোগ্য ব্যক্তির কাছেই গচ্ছিত থাকে , অনধিকারী সেইসব প্রাপ্ত শক্তির প্রদর্শন করতে গিয়ে সবকিছুই হারিয়ে ফেলে ! তাই পুরাণে দেখানো হয়েছে সমুদ্র মন্থন থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী অসুর কুলকে দেওয়া হয়নি – দেবরাজ ইন্দ্র অথবা স্বয়ং নারায়ন প্রমুখেরা সেগুলি গ্রহণ করেছেন !
সমুদ্র মন্থন করতে করতে শেষের দিকে উঠেছিল বিষ – সে বিষ যে সে বিষ নয় কালকূট বিষ ! যে বিষের জ্বলনে দেব-দানব সহ সমগ্র বিশ্বের প্রায় ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গিয়েছিল ! সেই বিষকে Neutralize করতে আসরে নামতে হয়েছিল নীলকন্ঠ মহাদেব-কে ! এই ব্যাপারটাকে গুরুমহারাজ ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে যে __ সাধনার শেষ পর্যায়ে সাধক যখন আজ্ঞা চক্র ভেদ করতে উদ্যত হয়, তখন জাগতিক ভোগ-ঐশ্বর্য সহ সমস্ত প্রলোভনের বস্তু সহজলভ্য হয়ে তাকে টেনে নামাতে চেষ্টা করে – আর যখন আজ্ঞা চক্রে পৌঁছে এই সবকিছু জ্ঞানাগ্নিতে ভস্মীভূত হয়ে যায় – তখন ওই সিদ্ধ সাধকের মনে -প্রাণে জগতের যত দুঃখ-কষ্ট সেগুলি এসে প্রবেশ করতে থাকে ! এটিকেই ‘কালকূট’ বিষ বলা হয়েছে ! জীবজগতের বিশাল দুঃখ কষ্টের বোঝায় ছটফট করতে থাকে সাধক , তার বোধ হয় যেন সমস্ত দুঃখ কষ্ট সব তার ! সে-ই যেন সবকিছু তার নিজের শরীরে , নিজের মনে বয়ে বেড়াচ্ছে ! স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন – ” যত উচ্চ তোমার হৃদয় – তত দুঃখ জানিও নিশ্চয় !”
এই অসম্ভব জ্বালা থেকে মুক্ত হতে ছটফট করতে থাকে সাধক_আবার শুরু হয় ঊর্ধ্বগতি, এবার সহস্রারের দিকে! আর তখনই ক্ষরিত হোতে থাকে মাতৃকোলে অসহায় শিশুর একমাত্র আহার্য্য মাতৃদুগ্ধ রূপ “চন্দ্রবারুনী সুধা”(মা জগদম্বা কোলে নিয়ে শিবকে স্তনদুগ্ধ খাওয়ানো)! যার স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরনের সাথে সাধকের অন্তঃকরনের সমস্ত জ্বালা অন্তর্হিত হয়ে যায় এবং সে এক অদ্ভুত অপার্থিব আনন্দসাগরে ভাসতে থাকে! এই ‘চন্দ্রবারুনী সুধা’ সহস্রার থেকে কন্ঠ পর্যন্ত বা বিশুদ্ধ চক্র পর্যন্ত নামে _তাই মহাদেব ‘নীলকন্ঠ’! এই অবস্থার সাধক-ই নীলকন্ঠ _যাঁর মধ্যে জগতের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার বোধও রয়েছে এবং সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বা তাদেরকে neutralize করার উপায়ও জানা থাকে! এই সকল মহাপুরুষেরাই জগতের হলাহল পান কোরে _জগতকে শান্তি-সুধা দান করতে পারেন!
এইবার বাকি থাকল সমুদ্রমন্থনে অমৃত ওঠার রূপক!! অমৃত ওঠার পর সেই অমৃত কিন্তু শুধু দেবতারাই গ্রহণ করতে পারে _অসুরেরা নয়! অসুরেরা মোহিনী মায়ায় ভুলে গিয়ে তা থেকে বঞ্চিত হোল! শাশ্ত্রে বলেছে এই সমুদ্রমন্থনে ওঠা অমৃতভান্ড অসুরদের কবল থেকে নিয়ে চলে যাবার সময় চার জায়গায় চলকে দু-চার ফোঁটা পড়ে গিয়েছিল! সেগুলি হল হরিদ্বার, নাসিক, উজ্বয়িনী এবং প্রয়াগ! তাই ঐ চারস্থানে আজও কুম্ভ মেলা হয়। ১২-বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভ এবং ৬-বছর অন্তর অর্ধকুম্ভ!
রূপকাকারে এই অমৃতকুম্ভ হোল আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান শরীরকে মন্থন করতে পারলে _সর্বশেষ প্রাপ্তি এটাই!!
চারটি স্থানে অমৃত চলকে পড়ার অর্থ হোল _সাধক যখন কুলকুন্ডলিনীর জাগরণ ঘটিয়ে তাকে ঊর্ধ্বগতি দান করতে পারে, তখন ব্রহ্মাগ্রন্থি, বিষ্ণুগ্রন্থি, রুদ্রগ্রন্থি এবং শিবসতীগ্রন্থি(!) এই চারটি স্থানে পৃথক পৃথক ভাবে অমৃতত্বের বোধ হয়! এ যেন প্রচন্ড অন্ধকারে এক ঝলক আলো! দূর্গম এবং ঘন অন্ধকার যাত্রাপথে এই সাময়িক আত্মতত্বের আস্বাদ যেন সঠিক পথের মাইলফলক! যা দেখে সাধক বুঝতে পারে যে সে ঠিক পথে চলেছে!! সর্বশেষ গ্রন্থিতে সাধক প্রকৃতপক্ষে বোধ করেন _তিনিই ব্রহ্ম! ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ ইত্যাদি মহাবাক্যের বোধ হয় ! তখনই সাধক বোধে বোধ করেন যে, তিনি অজর-অমর-নিত্য-শাশ্বত-সনাতন আত্মাস্বরূপ!!!!
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ!! (ক্রমশঃ)