গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ আশ্রমে সিটিং-এ বহুবার বলেছিলেন যে , পৌরাণিক সমস্ত গল্প বা ঘটনার দ্বারা রূপকাকারে বিশাল বিশাল তত্ত্বকে প্রকাশ করা হয়েছে ! এটা ঋষিদের একটা বিরাট Art ! যে কোন কঠিন জিনিসকে সহজ করে গল্পাকারে প্রকাশ করার এই বিশেষ কৌশলটি প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বের বিস্ময় ! গুরু মহারাজ বহু পৌরাণিক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত বা সামাজিক এবং অন্যান্য দিক গুলি নানাভাবে ব্যাখ্যা করে আমাদের শোনাতেন ৷ উনি প্রায়ই বলতেন – আমি পুরানের ঘটনাবলীর যে বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা করি, সেইগুলি লিখবি এবং সবার কাছে পুরানের ঘটনাকে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করবি ! ‘চরৈবেতি’ পত্রিকায় আমাদের আশ্রমের বিভিন্ন ভক্তরা যেসব Article লিখতেন – সেখানে কোথাও কোথাও হুবহু পৌরাণিক আখ্যানটি অনেক সময় তুলে ধরা হতো । গুরু মহারাজ এগুলি Notice করতেন – তারপর সিটিং-এ এসে বলতেন – ” আমি নানা পৌরাণিক ঘটনার প্রকৃত ব্যাখ্যাগুলি তোদের কাছে করি তো ! তবু এরা কেন এখনও পুরানের সেই ঘটনাগুলিই হুবহু তুলে ধরেছে – আমি বুঝতে পারিনা !”
কিন্তু হায় ! আমরা দুর্বল মেধা সম্পন্ন ক্ষীণস্মৃতিশক্তি সম্পন্ন অাধার ! তাঁর বলা সব পৌরাণিক ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা আমাদের স্মৃতিতে নাই, অন্য কারো থাকলেও _আমার নাই ! যেগুলি রয়েছে, সেগুলি বলার চেষ্টা নিশ্চয়ই করব – সেইসঙ্গে গুরু মহারাজের বিভিন্ন ভক্তদের কাছে অনুরোধ রাখব যে তাদের কাছে যদি কোন পৌরাণিক গল্পের তাৎপর্য জানা থাকে (যেগুলি গুরু মহারাজ বলেছিলেন) – তারাও লিখে ফেলুন ! বর্তমান এবং আগামী দিনের যুব সমাজের কাছে তা পৌঁছাতে পারলে – পুরাণাদি শাস্ত্রের প্রতি আবার সবার interest তৈরি হবে – তারা আবার এগুলিকে নিয়ে Reserch করবে এবং আরো নতুন নতুন তথ্য ও তত্ত্ব খুঁজে পেয়ে নিজেরাও সমৃদ্ধ হবে – দেশ তথা সমগ্র বিশ্বকে সমৃদ্ধ করতে পারবে ৷
আমরা পৌরণিক ঘটনার (গুরু মহারাজের বলা) ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পরে আসবো – তার আগে আমরা আগের দুটি এপিসোডে যে প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম সেইটায় একটু ফিরে যাব । এখানে আমরা দেখেছিলাম যে সাধক যখন সাধনার গভীরে প্রবেশ করে – তখন নানা রকম ‘প্রাপ্তি’ ঘটে ! বিভিন্ন ধর্মপুস্তকে আমরা এই নিয়ে অনেক আখ্যান পড়েছি বা কারো কাছ থেকে শুনেছি – গুরু মহারাজের জীবনের ঘটনা তো আমাদের অনেকেরই জানা – তিনি মহাজীবন তাই তাঁর কথা সকলের ঊর্ধ্বে ! কিন্তু আমাদের মধ্যে গুরু মহারাজের শিষ্য বা সন্তানদের মধ্যে যারাই একটু মনোযোগী হয়ে ধান-জপ করেছেন – তাদের জীবনেই এই ধরনের নানান বিভূতির প্রকাশ ঘটেছে । গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন – “পরশমনির স্পর্শে লোহা সোনা হয় ; কিন্তু কৌস্তভমণির স্পর্শে পাথর পরশপাথর হয় !”
তাই পরমানন্দ রূপ মহান মানুষটির স্পর্শে কত পরশমণির সৃষ্টি হয়েছে – তাদের সকলের খবর আর ক’জনারই বা জানা আছে ? আমি নিজের চোখে এক পরমানন্দ ভক্তের জীবনের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম – তাঁর সাধনার স্তর এবং অনুভূতির কথা কিছু বলছি [অবশ্য যেগুলি এখানে আলোচনা করছি সেগুলি উনি নিজেই একটা ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন (ডায়েরিটা উনি আমাকে দিয়েছিলেন _পড়ে দেখার জন্য!) ৷ আদিত্যপুর আশ্রমের নন্দ মহারাজের কাছে যেটি সযত্নে রাখা আছে ৷ ওই লেখাগুলি প্রকাশিত হলে সাধারণ পাঠকের কাজে না এলেও সাধক-দের জীবনে ওই সব শিক্ষা বা guide-line গুলি খুবই কাজে লাগবে ।] !
ঐ ভক্তের নাম ছিল পঙ্কজ বক্সী। পঙ্কজ বক্সীর বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগরে ( গুরুমহারাজ ওনাকে করিমপুর আশ্রমে থাকার জন্য বলেছিলেন, উনি করিমপুর আশ্রমে যাবার পর গুরুমহারাজ কথা প্রসঙ্গে ওখানকার ভক্তদের বলেছিলেন _”তোদের ওখানে একজন #সাধু প৷ঠালাম!) যুবক বয়সেই উনি কোন এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন ৷ উনি ওখানে প্রাইমারি শিক্ষক ছিলেন । ধীরে ধীরে ওনার ওই মারাত্মক ধরনের Rheumatic Problem ( যেটার কোন চিকিৎসা বা ঔষধ ছিল না , শুধু যন্ত্রনা নিবারণ এর ঔষধ খেতে হতো ।) বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকল এবং উনি চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন !
গুরুমহারাজের সাথে পঙ্কজ বক্সীর আলাপ করিয়েছিলেন পঙ্কজ মন্ডল অর্থাৎ পঙ্কজ মহারাজ(করীমপুরের আর এক পঙ্কজদা, যিনি শিলিগুড়িতে আশ্রম করেছিলেন এবং এখনো বেঁচে আছেন, বর্তমানে রসবেরুলিয়া আশ্রমে থাকেন ।) গুরু মহারাজের সাথে তার যখন প্রথম দেখা হয় বা কথা হয় _তখন উনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিলেন! রোগটি এমনই যে, এর বিশেষ কোন চিকিৎসা নাই! উনি কলকাতা, ভেলোর, চেন্নাই ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার দেখিয়েছিলেন _সকলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যন্ত্রণা নিবারক ওষুধ দিয়েছেন– ব্যস্ ঐটুকুই! এর বেশি কিছু নয়! ফলে শেষমেশ উনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাতেন এবং নিজেও হোমিওপ্যাথি অনেক বই কিনে পড়াশুনা করতেন। কালক্রমে উনি নিজেই একজন ছোটখাটো ডাক্তারে পরিণত হয়েছিলেন (আমরা ওনাকে যখন আদিত্যপুর আশ্রমে দেখলাম _তখন উনি রীতিমতো চিকিৎসক! অনেকের বহু জটিল রোগ উনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সাড়িয়েও দিয়েছিলেন।)!
গুরুমহারাজের সাথে প্রথম দেখাতেই উনি ওনার ব্যাধির কথা বলেছিলেন (তখনও উনি ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটতে পারতেন)। সব কথা শুনে গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”দেখুন আপনার এই ব্যাধি সারবে না (এই কথা বড় বড় ডাক্তাররাও বলেছিল)! _আপনি তো হোমিওপ্যাথি করেন, তাহলে আপনি ‘—-‘ ওষুধটা ব্যবহার করে দেখতে পারেন!”
এই কথা শুনে পঙ্কজ বক্সী সেদিন যৎপরোনাস্তি অবাক হয়েছিলেন! উনি তখন প্রচুর হোমিওপ্যাথি পুস্তক পড়ে ফেলেছেন _প্রতিদিনই কোন না কোন মোটা বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকেন! উনি নিজের রোগলক্ষন, শরীরের গঠন বা মন-মেজাজের লক্ষন মিলিয়ে নানা রকম ওষুধ নিজের জন্য ব্যবহার করতেন (আসলে ওনার হোমিওপ্যাথি বই পড়ার কারণ ছিল _নিজের ব্যাধির জন্যই!), কিন্তু কখনো ‘ঐ’ ওষুধটা প্রয়োগ করার কথা ওনার মাথাতেই আসে নি! গুরুমহারাজের কাছে শুনে উনি ব্যবহার করে অনেকদিন সুফল পেয়েছিলেন!
এরপরই উনি গুরুমহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন ।গুরুমহারাজ দীক্ষা দানের সাথে সাথে কিছু ক্রিয়াযোগ, প্রানায়াম এবং ধ্যানের পদ্ধতি শিখিয়ে দিতেন _ওনাকেও দিয়েছিলেন! পঙ্কজ বক্সী নিষ্ঠাভরে গুরুর সমস্ত নির্দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করতে লাগলেন! এর ফলে পঙ্কজ বক্সীর জীবন কিভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেল _সেটাই এখন বলা হবে!!
পঙ্কজ বক্সীর রোগটার একটা বিশেষত্ব ছিল _সর্বক্ষণ যন্ত্রণাভোগ! যতক্ষণ কোন কাজে যুক্ত থাকতেন অথবা ঘুমিয়ে থাকতেন _ততক্ষণ relief, আর বাকি সবসময় যন্ত্রণা হয়েই যেতো! যন্ত্রণা নিবারক(painkiller) ওষুধ খেলে কিছুক্ষণ ভালো থাকতেন, action কেটে গেলে আবার যন্ত্রণা! শেষের দিকে ঐ ওষুধও তেমন কাজ করত না! গুরুমহারাজের কাছ থেকে ক্রিয়াযোগ, প্রানায়াম ও শেষে ধ্যান practice করতে করতে ওনার ধ্যানে তন্ময়তা আসতে শুরু করল! তন্ময়তা আসার অনেকক্ষণ পরে, যখন ওনার ধ্যানের রেশ কেটে যেতো _উনি একটা বিষয় feel করতে শুরু করলেন যে _যতক্ষণ তন্ময়তা থাকে, ততক্ষণ ওনার শরীরে যন্ত্রণাবোধ মোটেই থাকে না!!
ব্যস! পঙ্কজ বক্সী পেয়ে গেলেন তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধির নতুন দাওয়াই!! এই দাওয়াই-ই পঙ্কজদা কে নিয়ে গিয়েছিল সাধনার সু_উচ্চ শিখরে! সেই কথাগুলি পরের দিনে…..! (ক্রমশঃ)