গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ)-এর বনগ্রাম আশ্রমে একদিনকার সকালের সিটিং-এর কথাগুলি এখানে আলোচনা হচ্ছিল । সেদিনের ওনার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল এই জগতে “হারায় না তো কিছু” ! অর্থাৎ কোন কিছুই তুচ্ছ নয় , কোন কিছুই নষ্ট হয়না – সব কিছুরই কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে এবং যত তুচ্ছ বা বৃহৎ কিছুই হোক না কেন – সবকিছুই প্রকৃতির বাতাবরণে একটা ‘ছাপ’ রেখে দেয় ! আর এই ‘ছাপ’টা দীর্ঘদিন ধরে সূক্ষ্ম অবস্থায় থেকেই যায় – যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য কোন ‘ছাপ’ এসে আগেরটাকে ম্লান বা ক্ষীণ করে দেয় !
আগের সংখ্যায় বলেছিলাম , গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ইথিওপিয়া দেশের কথা । যে দেশটা বারো বছর ধরে অনাবৃষ্টিতে ভুগছিল (তখন অর্থাৎ ১৯৯৫/৯৬ সালের কথা) , দেশটির চাষবাস তো বন্ধ হয়েছিলই , এমনকি গাছপালাও শুকিয়ে যাচ্ছিল মাটির নিচের জলস্তর হু হু করে নিচে নেমে যাওয়ায়। গোটা দেশে দুর্ভিক্ষ! অসহায় ভাবে সহস্র সহস্র মানুষের মৃত্যু ঘটছিল সেখানে ! মানুষজন যারা বেঁচে ছিল – তারা অস্থিচর্মসার কঙ্কালের মতো হয়ে গিয়েছিল ! নারী ও পুরুষ আলাদা করে চেনা যেতো না, তাদের শরীরগুলো শুকিয়ে একই রকমের হয়ে গিয়েছিল – এগুলো তখন টিভিতে মাঝে মাঝেই দেখাতো [ গুরু মহারাজ এই আলোচনা করার পর শুনেছিলাম বহুদিন পরে ওখানে বৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু আরও দু-চার বছর পরে শুনলাম ওখানে আবার অনাবৃষ্টি চলছে ] !
দেশটির একদিকে সমুদ্র রয়েছে – দেশের মানুষজন মরতে মরতে যে কজন বেঁচে ছিল , তারা সকলেই সমুদ্র তীরে এসে হাজির হয়েছিল ৷ কিন্তু বিধাতার কি পরিহাস ; লক্ষ লক্ষ গ্যালন জল – অথচ সেগুলি অপেয় – ফলে তৃষ্ণা নিবারণ হয় না ! প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে লবণ গোলা জল খেয়েও অনেকের মৃত্যু হচ্ছিল ! মানুষ মানুষের রক্ত চুষে খেয়েছে – এমন ঘটনাও সেখানে ঘটেছে ! গোটা বিশ্ব থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় , পরেরদিকে সেখানকার জীবিত মানুষগুলির খানিকটা সুরাহা হয়েছিল (যেগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো সব ঐ ১৯৯৫/৯৬ সালের কথা) ।
সেদিন সকালের সিটিংয়ে গুরু মহারাজ বলছিলেন – ” ইথিওপিয়ার মানুষজনের এত কষ্ট আমাকে খুবই ব্যথিত করেছিল ! একদিন আশ্রমের (বনগ্রাম) ঘরে বসে বসে ভাবছিলাম ওখানে মহাপ্রকৃতি এত রুষ্ট কেন ? এই রকম মারাত্মক প্রাকৃতিক অভিশাপ ওখানে কি করে নেমে এল ? এত বছর ধরে অনাবৃষ্টির সঠিক কারণটা কি ? চেতনার গভীরে প্রবেশ করে দেখলাম যে ___বহুকাল ধরে ইথিওপিয়ার মানুষজন ওদের নিজস্ব ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতিনীতি পালন করে আসতো ! ওরা যখন কোন অনুষ্ঠান করতো তখন ওরা খোলা আকাশের নিচে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে জড়ো হয়ে হাত ধরাধরি করে নাচতো – গান গাইতো ! আর নাচের তালে তালে ওদের একটা নিজস্ব বিশেষ বাদ্যযন্ত্র বাজতো যা কিছুটা সাঁওতালদের ‘ধামসা’-র সাথে মিল কিন্তু আকারে বিশাল এবং লম্বা লম্বা ! এগুলো বাজালে এক বিশেষ ধরনের আওয়াজ বেরোতো – “মা-বু-বু-বু” , “মা-বু-বু-বু” , ….” ! এই বিশেষ আওয়াজ ওখানকার প্রকৃতির বাতাবরণে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছিল – এই আওয়াজের সাথে আকাশে মেঘ সঞ্চারের একটা সম্পর্ক ছিল ! আমাদের এখানে যেমন ব্যাঙের ডাক , চাতক পাখির ডাকের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের বা আকাশে মেঘ সঞ্চারের একটা সম্পর্ক রয়েছে – ঠিক তেমনি ব্যাপার !
কিন্তু হল কি – ইউরোপীয়রা ব্যবসা বাণিজ্যের নামে ওসব দেশে থাবা বসালো , উপনিবেশ স্থাপন করল ! ধীরে ধীরে ওইসব দেশের সহজ সরল মানুষগুলোকে ব্যাপটাইজ করতে থাকল – গ্রামে গ্রামে গীর্জা তৈরি হতে শুরু করল । ওই মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের Culture ভুলে গিয়ে গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা শুরু করল ! এখন আর হাজার হাজার গ্রামে ওদের সেই বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের “মা-বু-বু-বু” , “মা-বু-বু-বু” ধ্বনি সৃষ্টি হয় না – গির্জার ঘণ্টা ধ্বনি হয় “ঢং-ঢং”!
ওদের প্রকৃতির বাতাবরনে যে বহুকালের impression ছিল _তার সাথে বর্তমানের এই ঘন্টাধ্বনির “ঢং ঢং”-এর কোন মিল হচ্ছে না অর্থাৎ সেই পুরোনো সুক্ষ ‘ছাপে’-র সাথে এই স্থুল ঘন্টাধ্বনির tuning হচ্ছে না _তাই প্রকৃতিও confused!! ওখানকার প্রকৃতিতে নানান গোলমাল, বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছিল _আর তারই ফলস্বরূপ ইথিওপিয়ার দীর্ঘকালীন অনাবৃষ্টি!!
গুরুমহারাজের আলোচনা শুনে সেদিনই গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে বিকালের দিকে অজয় নদের চড়ায় বেড়াতে গিয়ে দেখি, “ভট্ ভট্” – করে বিকট আওয়াজ তুলে ভুটভুটি নৌকা, নদীর এপার-ওপার যাওয়া আসা করছে! নদীর ওপারের জমিগুলিতে চাষীরা ট্রাক্টরের সাহায্যে চাষ করছে _তারও তীব্র আওয়াজ চারিপাশের বহুকালের নিস্তব্দতাকে বিদ্রুপ করছে! উভয় যন্ত্রযান নিসৃতঃ কালো ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে গিয়ে আকাশকে আক্রমণ করছে!!
মনে মনে চরম ভয়মিশ্রিত ভাবনা এল__`তাইতো! বহুকাল ধরে আমাদের গ্রামের বাতাবরনে যে impression ছিল তা হাল-দাঁড়-পাল বিশিষ্ট নৌকার, _ভট্ ভট্ শব্দ করা ভুটভুটির নয়! জমিতে চলতো গরুতে বা মহিষে টানা লাঙল, _তীব্র শব্দকারী ‘কলের লাঙল’ (ট্রাক্টর) নয়!
তাহলে প্রকৃতির বাতাবরনের বহুকালের impression – এর সাথে এগুলি তো মিলছে না _তাই কি আমরা দেখছি প্রকৃতির এই খামখেয়ালীপনা! কোন বছর অতিবৃষ্টি তো পরের বছরগুলিতে অল্পবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি!! কোন ঋতুই তো আজকাল আর ঠিকমত সময়ে ঠিক কাজটি করছে না!! এগুলোর সুক্ষ কারন গুরুমহারাজের আজকের আলোচনা থেকে পরিষ্কার হোল!!
এখনকার বাস্তবের ক্রিয়াকলাপের সাথে বাতাবরনের সুক্ষভাবে থাকা impression-এর tuning হচ্ছে না বলেই পৃথিবীতে নেমে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়!!
এই সমস্যা সমগ্র বিশ্বের। কারন গোটা বিশ্ব জুড়ে বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির লহর চলছে _এই ‘নতুনের কেতন ওড়াতে’ গিয়ে সুক্ষাতিসুক্ষ পুরাতনকে আমরা প্রতিনিয়ত আঘাত করে চলেছি!! আর তারই ফলস্বরূপ “গ্লোবাল ওয়ার্মিং”, “গ্রীন হাউস এফেক্ট”, নানাবিধ মারাত্মক ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়!! __মনটা খারাপ হয়ে গেল!!!! (ক্রমশঃ)