ওঁ শ্রীভগবতে স্বামী পরমানন্দায় নমো নমঃ।
গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরছিলেন – তখনকার নানা ঘটনার কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল ! স্বামী বিবেকানন্দ ইউরোপ ভ্রমণ কালে জার্মানি গিয়েছিলেন। উনিও জার্মানির মানুষজনের শরীর-স্বাস্থ্য এবং তাদের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করেছিলেন ৷ গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দও যখন জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরছিলেন – তখন এই ব্যাপারগুলি-উনিও দেখেছিলেন ৷ উনি ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি জাতির খুবই প্রশংসা করেছিলেন !
তুলনায় ফ্রান্স দেশের ব্যাপারে উনি কিন্তু খুব একটা ভালো সার্টিফিকেট দেন নি! একদিন উনি ‘পৃথিবীতে ফরাসি জাতির অবদান’ – নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন – “দ্যাখো ! তোমরা যে যাই বলো , আমি চিন্তা করে দেখেছি __ফরাসিরা আধুনিক বিশ্বকে ভালো বিশেষ কিছু দেয়নি, বলা যায় কেবল Nudity দিয়েছে ! চিত্রশিল্পে , সাহিত্যে , স্থাপত্যে শুধু Nudity-র ছড়াছড়ি ! অকারনে ফ্রান্সের প্রকাশ্য জনবহুল রাস্তায় আমি তরুণীদেরকে উলঙ্গ হয়ে প্রতিবাদ করতে দেখেছি ! পরে শুনলাম – এটাই নাকি ওখানকার রীতি-রেওয়াজ ! যার যখন কোন ব্যাপারে প্রতিবাদ করার সাধ জাগে , সে যে কোন রাজপথের একটা জনবহুল বা importent স্থানে প্রকাশ্যে পটাপট জামাকাপড় খুলে ফেলে প্রতিবাদ জানায় ! পরে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং জামাকাপড় পড়িয়ে পরে ছেড়েও দেয় ! হয়তো কিছু fine-ও করতে পারে ৷”
সেদিন এই প্রসঙ্গে যখন গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রমের সিটিং-এ আলোচনা করছিলেন, তখন জনৈক ভক্ত গুরু মহারাজকে বলেন – “কিন্তু গুরুমহারাজ ! স্বামীজী (স্বামী বিবেকানন্দ) ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসার পর ফরাসি জাতির জীবনযাত্রা , কৃষ্টি-সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য নিয়ে বেশ প্রশংসা করেছিলেন !”
গুরু মহারাজ এর উত্তরে বীরত্বব্যন্জকভাবে বলেছিলেন – “১০০ বছর আগে উনি কি বলেছিলেন – স্বামী পরমানন্দ কি তার Repeat করবে নাকি ? ১০০ বছর আগে স্বামীজী যেমন দেখেছিলেন – তেমন মন্তব্য করেছেন ৷ এখন আমি যা দেখেছি – যা বুঝেছি, সেটা তোমাদের বলছি ! দ্যাখো , আমি তোমাদের মতো অতীতের চর্বিত-চর্বণ করি না ! আমি সর্বদা নিত্য বর্তমানে থাকি এবং সেখান থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলি । স্থান-কাল-পাত্র পাল্টালেই আমার বক্তব্য পাল্টে যায় !” সেদিন আমরা গুরু মহারাজের মৃগেন্দ্রকেশরীর গর্জন শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম !
যাইহোক , আবার আমরা জার্মানির কথায় ফিরে আসি! জার্মানিতে থাকাকালীন গুরুমহারাজের অন্যতম কাজ ছিল বিভিন্ন নামকরা ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্য রাখা ! ওখানে প্রায় সমস্ত ইউনিভার্সিটিতেই Indology Section রয়েছে ! সেখানে India অর্থাৎ ভারতবর্ষের প্রাচীন পরম্পরা , ভারতবর্ষের ইতিহাস , ঋষিদের জ্ঞান ও শিক্ষা , মহাপুরুষদের অধ্যাত্ম জীবন এবং মানুষের প্রতি তাদের উপদেশ – এইসব নানা কিছু পড়ানো হয় ৷ জার্মানিতে সংস্কৃত শিক্ষার বিশেষ চল রয়েছে ৷ বহু জার্মানি পন্ডিত বিশুদ্ধ সংস্কৃতে কথা বলতে বা লিখতেও পারে। এমন বহু পন্ডিতদের সাথে গুরু মহারাজের যোগাযোগও হয়েছিল । গুরু মহারাজ একবার মজা করে বলেছিলেন – ” ভাগ্যিস আমি ঋষিকেশে কৈলাস আশ্রমে বিদ্যানন্দ গিরির তত্ত্বাবধানে কয়েক মাস সংস্কৃত ক্লাস করেছিলাম – তাই ভারতে তার কোন Utility না হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে _ঐ শিক্ষাটা কাজে লেগে গেল (যদিও আমরা ভালভাবেই জানি যে , গুরু মহারাজ সংস্কৃতের ন্যায় ভারতীয় ভাষা কেন – পৃথিবীর যে কোনো ভাষাতেই অনায়াসে কথা বলতে পারতেন ৷ আফ্রিকায় ঘোরার সময় উনি ওখানকার মানুষজনের সাথে জুলু ভাষা সহ বিভিন্ন ভাষায় Communication করেছিলেন) !”
আসলে ইউরোপীয়দের সংস্কৃত ভাষার প্রতি আকর্ষণের একটা কারণ রয়েছে। পন্ডিত ম্যাক্সমুলার বা মোক্ষমুলার সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদ-বেদান্ত ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন । শোনা যায় উনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সংস্কৃত শিক্ষা করা , ভারতীয় শাস্ত্রগুলি পড়া ও তার মর্মার্থ জ্ঞাত হওয়া এবং পরে সেগুলির Translation করা – এই কাজগুলি করেছিলেন । এ এক বিরাট সাধনা ! ম্যাক্সমুলার অবশ্য তার অনুবাদের বহুস্থানে বেদ বা বেদান্তের সিদ্ধান্তকে বুঝতে না পেরে বিকৃত করে ফেলেছেন – তবু এই অসাধ্য কাজটি সম্পন্ন তো করেছেন! তাঁর এই সাধনাকে সম্মান জানাতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং ওনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন ! ইউরোপের জনগণ ম্যাক্সমুলারের এই অনুবাদ পড়ে অবাক হয়ে যায়! আর হবে নাই বা কেন_ এত বিশাল এবং তথ্য সম্বলিত গ্রন্থ আর পাবে কোথায়!
গুরু মহারাজ আমাদেরকে বলেছিলেন – ইউরোপের বহু দার্শনিকের চিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল উৎস হল প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রাদি ! নতুন কোনো চিন্তা , নতুন দিশা , নতুন কোনো Clue – পৃথিবীর আর কোন দেশের গ্রন্থেই পাওয়া যায় না! বহু কিছু তত্ত্ব ও তথ্য সূত্রাকারে বেদ-বেদান্ত – পুরাণাদি শাস্ত্রে সূত্রাকারে লেখা রয়েছে। সেগুলি ওরা বুঝতে পেরেছে– আর বুঝতে পেরেছে বলেই সংস্কৃত শাস্ত্রগুলি নিয়ে জার্মানিতে প্রচন্ড গবেষণা চলছে !
আর এই জন্যেই ভারতবর্ষ থেকে কোন পন্ডিত , যোগী , জ্ঞানী মানুষেরা জার্মানি গেলে, ওদের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির Indology Section তাদেরকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়, সেখানে কিছু বক্তব্য রাখার জন্য !
গুরুমহারাজ অবশ্য বেশিরভাগ স্থানেই বক্তৃতা দেন নি! অতি সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বা introduction করে নেবার পরই __উনি জিজ্ঞাসা উত্তরের আসর বসিয়ে দিতেন (যেটা আমাদের এখানে ‘সিটিং’ নামে পরিচিত।)! এতে আলোচনা সভাটি একটি মনোজ্ঞ এবং interesting অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে যেতো! এর ফলে কোন কোন ইউনিভার্সিটিতে গুরুমহারাজকে বেশ কয়েকবার করে যেতে হয়েছিল এবং সেখানে শুধু Indology সেকসনেই নয় _বিভিন্ন সেকসনে গিয়ে আলোচনা করতে হয়েছিল। (ক্রমশঃ)