গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ জার্মানি সম্বন্ধে আরও নানা কথা বলেছিলেন ৷ ওখানে ঘটে যাওয়া অন্যতম উল্লেখযোগ্য আরেকটি ঘটনা ছিল ফ্রেডরিকা বা জার্মান শান্তির দিদি ফ্রান্সিস্কার রোগমুক্তি ও জীবনদান । সে কথা যেহেতু আগে আলোচনা করা হয়ে গেছে তাই ওটা আর এখানে পুনরুক্তি করছি না ! তবে যদি কোনদিন এই লেখাগুলি সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয় – তখন ওই ঘটনাটিকে “জার্মানী প্রসঙ্গ” হিসাবে এক জায়গায় ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করা হবে । এছাড়াও ইস্ট জার্মানী এবং ওয়েস্ট জার্মানীর একত্র হওয়ার কথাও সম্ভবত আগে আলোচনা হয়েছিল ৷ কিন্তু ওটি এখনও আলোচনা করা যেতে পারে – কারণ ওই সম্বন্ধে গুরুমহারাজ অনেক কথাই বলেছিলেন । আজ ওই প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন “Divide and Rule”– এটা ব্রিটিশ policy ! ওরা এই কাজটা করেই একসময় ⅓-rd বিশ্বকে নিজেদের অধীনে আনতে সমর্থ হয়েছিল । যেহেতু পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী-ই সবচাইতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল এবং জার্মানির দ্বারাই ইংল্যান্ড-ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের সবচাইতে ক্ষতি সাধন হয়েছিল – তাই জার্মানীর পরাজয় (ও সাথে সাথেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া) – এর পরই শাস্তিস্বরূপ জার্মানির উপর নানান এমন এমন শর্ত চাপানো হলো, যাতে করে আগামী বছরগুলিতে এই দেশটি বা জার্মানী জাতি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে !
ওদের এই Policy-র অন্যতমটি ছিল জার্মানীর বিভাজন ! তৈরি হল ইস্ট জার্মানী এবং ওয়েস্ট জার্মানী ! বার্লিন প্রাচীর নামে বিখ্যাত উঁচু পাঁচিল দিয়ে পৃথক করে দেওয়া হয়েছিল – দুই জার্মানীকে ! পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঢেউ লেগে পূর্ব জার্মানী , পশ্চিম জার্মানী থেকে সম্পূর্ণভাবে (সবদিক থেকেই অর্থাৎ রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সামাজিক) আলাদা হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওদের প্রতি যে অবিচার হয়েছিল – সেটা দুই জার্মানির জনগনই ভোলেনি , সেই অপমান – সেই প্রতিশোধ-স্পৃহা ওদের অস্থিতে-মজ্জায় সঞ্চারিত হয়ে ছিল ! সময় কেটে গেছে – আগের জেনারেশন আর নাই , কিন্তু মনের মধ্যে ‘জোশ’ টা রয়ে গেছিল ! তাই যেই মুহূর্তে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতারা আপোসে সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাইলো – অমনি দুই দেশের জনগণ নিজেদের আগ্রহে এবং চেষ্টায় বার্লিনের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে ফেলেছিল ! বন্যার জলের মতো দুই দেশের জনগণ একে অপরের দিকে ছুটে গিয়ে ‘ভাই’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল !
জার্মানিতে থাকাকালীন গুরুমহারাজ এই দৃশ্য ওখানকার টিভিতে দেখেছিলেন । উনি ওখানকার মানুষজনের সেদিনকার আবেগ-উচ্ছ্বাস-আনন্দের অভিব্যক্তি দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন ! উনি আমাদেরকে বলেছিলেন – এক দেশের জনগণ অন্য দেশের নাগরিকদের Refugee বলেনি – ‘ভাই’ বলে আলিঙ্গন করেছিল ! গুরু মহারাজের জার্মানীতে যাওয়া এবং দুই জার্মানীর মিলন ঘটা , এটাও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল !
জার্মানীর কথা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলতে গেলে হিটলারের কথা আসবে না – তা কখনোই হতে পারেনা ! গুরু মহারাজ আমাদের কাছে হিটলারকে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন ! এর সবটা হয়তো বলতে পারবো না – তবু যতটা মনে আছে তার কিছুটা তো নিশ্চয়ই বলা যাবে ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – জার্মানির পরাজয়ের পর হিটলারের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি! এটাও একটা রহস্য !
তবে এডলফ হিটলার নিজে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে নিজের জীবন শুরু করে নিজের প্রতিভাবলে ও আপন দক্ষতায় ধীরে ধীরে এতটা উপরে উঠেছিলেন । উনি সৈনিক এবং সেনানায়ক হিসাবে যে ক’টি যুদ্ধ করেছিলেন – সবকটিতেই অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন – তাই টপাটপ ওনার পদোন্নতি হয়েছিল ৷ যার ফলে পরে যখন উনি রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হ’ন তখন ওনার সৈন্যবাহিনী ওনার প্রতি চরমভাবে বিশ্বস্ত ও আজ্ঞাবহ ছিল ! তবে অনেকের মতে হিটলারের বশীকরণ ক্ষমতা ছিল ! এডলফ হিটলার বা ফ্যুয়েরার – উঁচু পাহাড়ের মাথায় ‘ঈগল নেস্ট’ নামে একটি সাধন কুঠির নির্মাণ করে ওখানে সাধনা করতেন ! আফ্রিকান ভুডু ও ভারতীয় তন্ত্রের সংমিশ্রণে উনি ভৈরবী সাধনা বা চক্র সাধনা করতেন । এর জন্য ওনার নির্দিষ্ট শক্তিশালী ভৈরবী ছিল! এই সাধনার শক্তিতেই হিটলারের মধ্যে একটা অসাধারণ সম্মোহিনী শক্তি (যার ফলে উনি জার্মানীর আপামর জনগণ এবং সেনাবাহিনীকে ওনার একান্ত আজ্ঞাবহ করতে পেরেছিলেন ।) সৃষ্টি হয়েছিল !
তার এই সম্মোহনী শক্তি বা অসাধারণ নেতৃত্বের শক্তি যাই হোক না কেন – তা এতটাই প্রবল ছিল যে , শোনা যায় – তার হুকুমে সৈন্যদল পাহাড় থেকে নিচে ঝাঁপ মারতেও এতটুকু দ্বিধা করত না ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর জোটকে (ইংল্যান্ড . ফ্রান্স , আমেরিকা সহ আরো কয়েকটি দেশ) নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল হিটলারের বাহিনী। তাদের নামই হয়ে গিয়েছিল অপরাজেয় বাহিনী অর্থাৎ হিটলারের সৈন্যদল বিপক্ষের সাথে যে সব স্থানে লড়াই করছিল – সব জায়গাতেই তাদের জয় হয়েছিল এবং ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের বাহিনী হয় মারা পড়ছিল অথবা পিছু হটছিল!
এমন সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানীতে হিটলারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন ! ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত একটি দেশ – যার নিজস্বতা বলতে কিছুই নাই , সেই দেশের একজন প্রতিনিধি , যার তেমন কোন পরিচয় পত্রও নাই –তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচাইতে ব্যস্ততম রাষ্ট্রনায়ক _যার সৈন্যরা তখন প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন রনাঙ্গনে তাকে পরপর জয় এনে দিচ্ছে _সেই বিশ্বত্রাস হিটলার পাত্তা দেবে কেন!! জার্মানিতে গিয়ে তাই নেতাজী ফ্যুয়েরারের সাথে দেখা করার কোন date-ই পাচ্ছিলেন না! কিন্তু দেশ মাতৃকার জন্য নিবেদিত প্রাণ, মহাসাধক সুভাষচন্দ্রও হাল ছাড়ার পাত্র নন _রয়ে গেলেন জার্মানিতেই! প্রতিপদে বিপদ, জার্মানির গুপ্তচরেরা _একজন বৃটিশ উপনিবেশভুক্ত দেশের নাগরিককে _”বৃটিশের চর”-সন্দেহ করেছিল, তাঁর উপর সদা সর্বদা নজর রাখছিল _একটু বেচাল দেখলেই তাঁকে arrest কোরতো বা হয়তো প্রানেই মেরে ফেলতে পারতো।
গুরুমহারাজ এই সম্বন্ধে আরো যা বলেছিলেন _তা পরের দিন…..!(ক্রমশঃ)