গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন সিটিং-এ যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তখন তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর কান্তি আর তাঁর অপূর্ব দিব্য মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে আমরা নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতাম তা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারতাম না ! তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু যেমন মাথার মধ্যে ঢুকে যেন print হয়ে যেতো – ফলে কিছুক্ষণ পর থেকেই আমরা নেশাচ্ছন্নের ন্যায় বুঁদ হয়ে যেতাম – আর সিটিং শেষে আমাদের মাথাগুলো ঝাঁ ঝাঁ করত!!
আর একটা ব্যাপারও সেই সময় খুব লক্ষ্য করতাম _গুরুমহারাজ সিটিং ছেড়ে উঠে যাওয়ার পর দেখতাম আমাদের পা-গুলোও যেন অবশ হয়ে গেছে! কখন যে বসে থাকতে থাকতে পায়ের রক্ত চলাচল কমে গিয়ে পা-গুলোকে আরষ্ট করে দিয়েছে – তা বুঝতেই পারতাম না ! শুধু আমারই নয় – অনেকেই দেখতাম এক চান্সে উঠতে পারছে না , অন্য কাউকে ধরে ধরে উঠে দাঁড়াচ্ছে ! গুরু মহারাজ আমাদের এই রকম দশা একবার লক্ষ্য করেছিলেন এবং বিধানও দিয়ে দিয়েছিলেন! উনি বলেছিলেন – ” যখনই দেখবি বসে থাকতে থাকতে একটা পা আরষ্ট হয়ে গেছে , তখন যে পা-টা নিচে আছে – তাকে উপরে তুলে নিবি এবং উপরের পা-টাকে নিচে দিয়ে বসবি ” অর্থাৎ উনি পা-দুটির position change করে নিতে বলেছিলেন । এতে চমৎকার কাজ হতো ! ভগবানের বিধান একেবারে instanttabous এবং যথাযথ !!
তবে অনেক সময় দেখতাম ওনার দেওয়া বিধান (হয়তো সিটিংয়ে সবার সামনেই একজনকে উদ্দেশ্য করে বলছেন)– যাকে বলছেন তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য , অন্যের ক্ষেত্রে নয় । আবার এমনও দেখেছি – উনি যা বলছেন , তা হয়তো ওই ব্যক্তির সেই মুহূর্তের জন্য কার্যকরী – তারপর আর কথাগুলি কার্যকরী হচ্ছে না!
মনে পড়ছে ওই রকম দু-একটি ঘটনার কথা, যদিও আগে একবার বলা হয়ে গেছে কিনা মনে পড়ছে না! তবু একবার বলছি!! বনগ্রাম আশ্রম তৈরির একেবারে জন্মলগ্নের দিকের কথা – অর্থাৎ তখন সবে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়ে দুটো একটা মাটির ঘর তৈরি হয়েছে , মুরারী মহারাজের একতলা অফিস ঘরটি হয়তো সবে শেষ হয়েছে ! তখন বনগ্রামে মোটরসাইকেল প্রায় ঢুকতো না বললেই চলে ৷ শীতকালের সময় রাস্তাঘাট শুকনো খটখটে থাকতো বলে দু-একটা পুরনো মডেলের রাজদূত মোটরসাইকেল প্রাণপণে আওয়াজ তুলে ধোঁয়া আর ধুলোর ঝড় তুলতে তুলতে বনগ্রাম আশ্রমে ঢুকতো । যে দু-একজন লোক তখন মোটরসাইকেলে আসতো – সবাই তাদেরকে খুবই খাতির বা সন্মানের দৃষ্টিতে দেখতো ! খুব সৌখিন মানুষ ছাড়া তখন পাড়া-গ্রামের মানুষ মোটরসাইকেল কিনতো না ৷ কারণ কিনে কি করবে ? বছরের মধ্যে ছয় সাত মাস তো ওটাকে বাইরে বের করতেই পারতো না ! গ্রামের মাটির রাস্তায় তখন ছয় সাত মাস ধরে জল-কাদা থাকতো – সাইকেলই চলতো না , তা আবার মোটরসাইকেল !!
যাইহোক , তখন পাঁচুদা নামে একজন ভক্ত এবং বংশধর বিশ্বাস (কাঁকুড়ে, সহজপুর) মোটর সাইকেলে (রাজদূত) আশ্রমে আসতো – এছাড়াও মোটরসাইকেল নিয়ে আসতেন গোবিন্দ ডাক্তার (সাতগেছিয়া) , তাছাড়া ঘোড়ার ডাক্তারও একটা ‘মপেড’ নিয়ে আসতো ! এদের মধ্যে যে কোন একজন সেদিন মোটরসাইকেল নিয়ে আশ্রমে এসেছিল । গুরু মহারাজ আশ্রমের মাঠের মধ্যেই ছিলেন –তখন আসা যাওয়া করা লোকজনের সংখ্যাও ছিল কম ! সেদিন গুরুমহারাজের কাছাকাছি দু-চারজন জন বহিরাগত-র সাথে ছিল বনগ্রামের নগেনও । গুরুমহারাজ খুব সম্ভবত মাঠের মধ্যে তৃষাণ মহারাজকে মোটরসাইকেল চালানো শেখাচ্ছিলেন ! তৃষাণ মহারাজ চলে যাবার পর গুরুমহারাজ হটাৎ করে নগেনকে বলেন – “কিরে নগেন ! তুই মোটর সাইকেল চালানো শিখবি নাকি ?” নগেন তো এক কথায় রাজি ! গুরু মহারাজ নগেনকে মোটরসাইকেলের সিটে বসিয়ে গাড়িটা স্টার্ট করে দিয়ে গিয়ারের function এবং ক্লাচ্ ছাড়া-ধরার ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে ওকে চালাতে বললেন ৷ নগেন সাথে সাথেই ওই মোটরসাইকেলটি চালিয়ে মাঠটা ৩/৪ পাক ঘুরে আবার ঠিকঠাক দাঁড়িয়েও পরল ! এই ঘটনায় নগেন ভেবেছিল যে , সে বোধহয় মোটরসাইকেল চালানো শিখে গেল – কিন্তু হায় ! কদিন পরে যখন অন্য আরেকজন মোটরসাইকেল নিয়ে আশ্রমে এসেছিল তখন তার কাছে গাড়ি চালানোর পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নগেন যেমনি মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে আগাতে গেছে – অমনি একেবারে ‘গোঁ-ও-ও’ শব্দ করে ১০/১৫ হাত দূরে গিয়ে ও নিজে এবং মোটর সাইকেল গোত্তা খেয়ে পড়েছিল ! পরে নগেন আমাকে বলেছিল – গুরু মহারাজের উপস্থিতিতে এবং ওনার নির্দেশে যে কাজটা easy বলে মনে হয়েছিল – ওনার অবর্তমানে সেটাই Critical Task -এ পরিণত হয়েছিল ! নগেন আরও বলেছিল যে, ও উপলব্ধি করতে পেরেছিল _গুরুমহারাজ ইচ্ছামাত্রই খোঁড়াকে হাঁটাতে পারেন, বোবাকে কথা বলাতে পারেন _কিন্তু তাঁর ইচ্ছার বাইরে গেলে আর কোন miracle – ই ঘটবে না!!
নগেনের কাছে শুনেছিলাম _একবার ঝমঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছিল, সেই সময় নগেন মাঠ থেকে ফিরছিল! বনগ্রামের মাঠ থেকে ফেরার পথটা আশ্রমের মধ্যে দিয়ে _তাই ও আশ্রমের ভিতর দিয়েই ফিরছিল। হটাৎ ওর চোখ যায় আশ্রমের পুকুরের দিকে – সেখানে ও আশ্চর্য হয়ে দেখে যে, পুকুরের মাঝখানে গুরুমহারাজ! উনি জলের মধ্যে ভেসে থাকার নানারকম আসন করছিলেন। নগেন অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে লাফিয়ে জলে নেমে পড়ে সাঁতার কেটে একেবারে গুরুমহারাজের কাছে পৌঁছে যায়। তারপরে সহজ সরল নগেন গুরুমহারাজকে বলে যে, গুরুমহারাজ যেন ওকেও জলে ভেসে থাকার ঐসব কায়দা শিখিয়ে দেন। গুরুমহারাজ ওকে সব আসন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল শিখিয়ে দিলেন। ফলে নগেন ফটাফট্ জলের মধ্যে আসনগুলো করতেও পারলো।
এরপর গুরুমহারাজ সাঁতরে অন্য দিকে চলে গেলেন দেখে _নগেনও ফিরে এল! সেদিনকার পর থেকে নগেন সবাইকে বাহাদুরি করে এমনভাবে বলতো যেন _”রাজার ঘরে যে ধন আছে _টুনির ঘরেও সে ধন আছে”! কিন্তু পরে যেদিন নগেন জলের মধ্যে একা একা ঐ আসনগুলি করতে গেল _অমনি ভুক্ করে ডুবে গেল! সবার সামনে প্রেস্টিজ একেবারে পাংচার!!
নগেনের আর একটা ঘটনাও আমরা নিজের চোখে দেখেছিলাম! ইচ্ছামতো ডাননাসায় অথবা বামনাসায় শ্বাস আনার কৌশল (সাধারণত যে কোনো মানুষের শ্বাস দুটো নাসারন্ধ্রের মধ্যে কোন একটিতে বেশি প্রবাহিত হয় _ওইটা বদল করার কথা বলা হচ্ছে)-টা গুরুমহারাজ একদিন ন’কাকার বাড়িতে নগেনকে শিখিয়ে দিলেন! নগেন পদ্মাসনে বসে গুরুমহারাজের নির্দেশ অনুযায়ী পায়ের position change করে একটু প্রানায়াম করতেই ওর বাম নাসার শ্বাস ডানদিকে এবং ডান নাসার শ্বাস বামদিকে easily এসে যাচ্ছিল! কিন্তু কিছুক্ষণ পর গুরুমহারাজ যেইমাত্র উঠে গেলেন _নগেন ওখানেই বসে বসে অনেক চেষ্টা করেও আর শ্বাসের ধারা control করতে পারলো না!
আমরা যদিও “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা” – য় ধারাবাহিকভাবে ‘ইউরোপে গুরুমহারাজ’ _প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম, তবু আজ কথা প্রসঙ্গে অনেক দিনের পুরোনো কিছু কথা আলোচনা করতে গিয়ে, আমাদের আলোচনার ধারাবাহিকতায় ছেদ পরে গেল! তাই পরের দিন থেকে আমরা আবার ফিরে যাব ইউরোপের ঘটনায়! সেখানে আসবে ফ্রেডেরিকার অ্যাক্সিডেন্ট, অ্যালবার্তোর ঘটনা, অ্যাসগরের ঘটনা ইত্যাদি!! (ক্রমশঃ)