গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন (তখন ঠাকুরদাস আশ্রম) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ যদিও কোজাগরী পূর্ণিমার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই উনি বনগ্রাম আশ্রমে যাতায়াত শুরু করেছিলেন – কিন্তু পাকাপাকিভাবে আশ্রম প্রতিষ্ঠার দিন হিসাবে উনি ওই বিশেষ দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। গতকাল (13/10/2019__কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে) রায়না তপোবন আশ্রমে (পরমানন্দ মিশনের অন্যতম একটি শাখা)-র মূল মহারাজ স্বামী পূর্ণানন্দ ওই আশ্রমের প্রার্থনাগৃহ (যার নিচে ডাক্তারখানা) উদ্বোধনের আয়োজন করেছিলেন । এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন আশ্রমের মহারাজরা এবং ভক্তবৃন্দ যোগদান করে অনুষ্ঠানটিকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলেছিল । তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘কোজাগরী তিথি’-তে কোন দেবস্থান বা ধর্মস্থান অথবা লোক-কল্যাণমূলক কাজের জন্য নির্মিত গৃহের উদ্বোধন করা এই যুগে প্রশস্ত । এই বিশেষ তিথিতে এসব কাজের শুভ সূচনা করলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায় – প্রকৃতি অনুকূল থাকে, কালের বুকে কাজটি স্থায়িত্ব পায়, মা মহামায়া প্রসন্ন হন – গুরুকুল (যাঁদের ওপর বর্তমান পৃথিবীর ভার) সহায় থাকেন ৷
গুরু মহারাজ কোজাগরী পূর্ণিমার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন – সেগুলি আগে আগে অনেক আলোচনাও হয়েছে – তবে যে কথাটা আজও আমাদের কানে বাজে, তা হ’ল – “কোজাগরী মানে কি জানিস ? এর বাংলা অর্থ করলে হবে – ‘কে জাগে রে!’, ‘কো – জাগরী’!! কোজাগরী পূর্ণিমার রাত – রাত্রি জাগরনের রাত !”
আমাদের মনে পড়ে যেতো ছোটবেলার কথা, মা-ঠাকুমার কাছে শুনতাম – এই রাতে মা লক্ষ্মী আকাশ পথে যেতে যেতে দেখেন তাঁর ভক্তরা কে কে আলো জ্বেলে জেগে রয়েছে ! যারা জেগে থাকে – তাদের তিনি কৃপা করেন ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন এই বিশেষ তিথিতে সারারাত জেগে জেগে সাধনা করার কথা ! সাধারণ মানুষ যে অর্থে লক্ষ্মীলাভ বোঝে – গুরু মহারাজ তার অন্য ব্যাখ্যা করেছিলেন ।
একদিন বললেন – জগৎ-সংসারে মানুষের দুঃখ-কষ্ট-অভাব দেখে ‘লক্ষ্মী’-র উপর আমার খুবই রাগ হল, আমি অন্ন-ত্যাগ করলাম (সেই সময় গুরুমহারাজ ভাত-রুটি-মুড়ি-বিস্কুট কিছুই খেতেন না, শুধু সব্জি খেতেন ! শাক-সব্জি শাকম্ভরী মা অন্নপূর্ণার রূপ !)! তারপর একদিন বনগ্রামে গুরু মহারাজের কুঠিয়ার দরজার কাছে মা লক্ষী ছোট্ট মেয়ের রূপ ধরে দাঁড়িয়ে ঘরে ঢোকার জন্য অনুনয় করেছিলেন । গুরুমহারাজ বললেন – ” প্রথমটায় আমি ভেবেছিলাম হয়তো বনগ্রামের কোন ছোট মেয়ে অথবা কোন ভক্তের মেয়ে এই ভরদুপুরে মা-বাবার হাত ছাড়িয়ে আমার কাছে চলে এসেছে ! আমি তাই বললাম – ‘ যাও, এখন যাও, পরে আসবে !’
তবু দেখি মেয়েটি মুখটি নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে , আর ঘরে ঢোকার অনুমতির জন্য অনুনয়-বিনয় করছে ! তখন আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম – ‘ আরে ! এ তো কোন মনুষ্য শরীর নয় ! এ তো কোন দেবী শরীর ! কারণ পা মাটিতে স্পর্শ করে নেই – আর পা-দুটি নিটোল, আলতার আলপনা আঁকা !!’ তখন ভালো করে তাকাতেই দেখলাম – স্বয়ং লক্ষ্মী ছোট মেয়ের রুপ ধরে অধোমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে – আর আমার কাছে আসার অনুমতি চাইছে ! ওকে দেখেই আমি প্রচন্ড জোরের সঙ্গে বলে উঠলাম – ” না ! তুই আমার ঘরে ঢুকবি না ! তুই চলে যা – এখান থেকে ! তোর সাথে আমার কোন কথা নেই !” তখন ও (মা লক্ষ্মী) কাঁচু-মাঁচু করে বলতে থাকলো – ” কি করবো, মানুষের প্রারব্ধ তো মানবে না-কি!” আমি বললাম – “কিন্তু ওরা আমার সন্তান – তবুও ওদের অন্নকষ্ট কেন হবে ?” তখন ও (মা লক্ষ্মী) বলল – ” আমার ভুল হয়ে গেছে ! দেখবে, এবার থেকে আমি সব ঠিক করে নেবো !” আমি বললাম – ” ঠিক আছে – আমিও দেখবো ! তুই যদি ঠিকঠাক সবকিছু করিস – আমিও আবার তোর উপর প্রসন্ন হব !” এরপর ‘ও’ চলে গেল – তবে পরবর্তীতে দেখেছি ‘ও’ ঠিকমতোই কাজ করে চলেছে !”
গুরু মহারাজ স্বয়ং এই কথাগুলি বলেছিলেন বনগ্রাম আশ্রমের সিটিং-এ ! ঠিক ঠিক কি কারণে গুরুমহারাজ মা লক্ষ্মীর উপর অতটা রুষ্ট হয়েছিলেন সেটা আমার জানা নেই! তবে পৃথিবীতে, বিশেষতঃ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে এমনকি বাংলাতেও বহু নিরন্ন মানুষের কষ্ট দেখে উনি খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। আমার মনে আছে একদিন উনি বলেছিলেন _”আমি যখন কোন গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে যাই _তখন খাবার সময় হয়তো বাড়ির মায়েরা আমাকে অন্যান্য খাবারের সাথে এক বাটি দুধও দেয় _(মা লক্ষ্মীর সাথে দেখা ও কথোপকথন হবার কিছুদিন পর থেকেই গুরুমহারাজ অন্নগ্রহন শুরু করে দিয়েছিলেন।) _কিন্তু ঐ দুধ আমি খেতে পারতাম না। কারণ ছোটবয়সে আমি যখন পথে পথে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরেছিলাম, তখন দেখেছিলাম শত শত পথশিশুরা এক ফোঁটা দুধ খেতে পায় না, অনেক আদিবাসী জনজাতি বা “পিছরে বর্গে”-র শিশুদেরকেও তাদের মায়েরা __বুকের দুধ ছাড়া অন্য দুধ খাওয়াতে পারে না! এই সব দেখার পর থেকে আমি আর কোনদিন দুধের বাটি মুখে তুলতে পারি নি!
তাছাড়া আমি চিন্তা করে দেখেছি, গরুর দুধ বা বিকল্প কোন দুধের প্রয়োজন হয়_ শুধুমাত্র শিশু ও বৃদ্ধদের, যাদের দাঁত নেই _তাদের! চিবিয়ে খাবার খেতে শুরু করলেই আর দুধ খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। দুধের সমস্ত পুষ্টিগুন ঐসব খাবার থেকেই পাওয়া যায়। পৃথিবীর সমস্ত পূর্ণবয়স্ক মানুষ যদি এই বিজ্ঞানটি বুঝে দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয় __তাহলে হয়তো অসহায়, অবহেলিত শিশুগুলোর মুখে একটু দুধ তুলে দেওয়া যায়। “(ক্রমশঃ)