গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ এইরকমভাবেই দেখা যায় পৃথিবীর যে কোন মহান বা উল্লেখযোগ্য ঘটনার সঙ্গে তিথি-নক্ষত্রের একটা যোগ রয়েছে ! গুরু মহারাজ অবশ্য বলেছিলেন যে পৃথিবী একটাই গ্রহ – মহাকাশ থেকে বা অনেক উঁচু থেকে দেখলে সেই অখন্ড পৃথিবীকেই দেখা যায়, যত খণ্ড-বিখণ্ড, ভাগ-বিভাগ সব নিচুতলায় । সেই অর্থে স্থান-কাল-পাত্রের মহিমা সর্বস্বীকৃত হলেও এর বাইরেও কিছু কথা রয়েই যাচ্ছে ! স্থানের মতো ‘কাল’ও সেই অখন্ড মহাকালেরই অংশ, তাই সেখানেও খন্ড-বিখন্ড বা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র করার বা তার আবার ভালো-মন্দ বিচার করার কি প্রয়োজন ?
কিন্তু প্রয়োজন রয়েছে ! অখন্ডের বোধে যিনি সদা বিরাজমান, তাঁর জন্য অখন্ড তত্ত্ব, অদ্বৈত তত্ত্ব কার্যকরী ৷ আর যারা সদাসর্বদা দ্বৈত চিন্তায়, ক্ষুদ্র বা খন্ড-খন্ড ভাবনার জগতে রয়েছে – তাদের জন্য স্থান-কাল-পাত্রের, তিথি-নক্ষত্রের, বারবেলা-কালবেলার, অশ্লেষা-মঘার প্রয়োজন রয়েছে। সেই জন্যেই বিভিন্ন মহাপুরুষগণ যখন যখন শরীর ধারণ করেছেন, তখন তিনি ভক্তদেরকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করে – যেমন যেমন ব্যক্তি, তাকে ঠিক তেমন তেমন উপদেশ দান করেছেন । সবার জন্য এক কথা – এক বিধান – একই নিয়ম হয় না – হতে পারেও না । মহাপ্রভুর সম্বন্ধে বলা হয় – ” বহিরঙ্গ সঙ্গে করে নাম-সংকীর্তন, অন্তরঙ্গ সঙ্গে করে প্রেম-আলাপন ।”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – এখানে যারা আসে তাদেরকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন – আর্ত, অর্থাথী, জিজ্ঞাসু, জ্ঞানী ও প্রেমিক । এদের মধ্যে পিরামিডের গঠনের মতোই আর্ত-অর্থাথীর সংখ্যা অধিক, জিজ্ঞাসু-জ্ঞানী-প্রেমিকের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে শেষে কোটিতে গুটিক ! গুরু মহারাজের কাছে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন ‘মা’ এবং কিছু উন্নত সাধক ছাড়া ‘প্রেমিক’ ভক্ত আর কোথায় ! আমাদের মতো বেশীরভাগ ব্যক্তিরা তো গুরু মহারাজের বোঝা-ই বাড়িয়েছি, তাঁর ভার লাঘব করার চেষ্টা আর কোথায় করেছি ! যদি তা করতে পারতাম – তাহলে কি আর উনি এত তাড়াতাড়ি চলে যেতেন – ভালোবাসার টানে আরো বেশ কিছুদিন থেকেই যেতেন ।
স্বামী পরমানন্দের লীলায় এবার মধুর ভাবের লীলার প্রকাশ ঘটা divine plan-এ ছিল না ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাতেও ছিল না ! দক্ষিণেশ্বরে এক পাগলী এসে প্রায়শই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে জ্বালাতন করতো, বলতো – ” আমাকে মনে ঠেলে দিলে!(অর্থাৎ মনে জায়গা দিলে না!) ঠাকুর জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাকে – ” তোর কি ভাব ?” সে বলেছিল – ” আমার মধুর ভাব ৷” উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন – ” কিন্তু আমার যে সকল নারীতেই মাতৃজ্ঞান, সব মাতৃযোনী ৷” সুতরাং শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাতেও মধুর ভাবের প্রকাশ ঘটেনি । যদিও গৌরী মা (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এক অন্যতম সন্ন্যাসিনী শিষ্যা)-র কাছে মধুর ভাবের পাঠ নিয়েছিলেন স্বামী নিগমানন্দ ৷ তাই নিগমানন্দের চার গুরুর মধ্যে প্রেমিক গুরু ছিলেন গৌরী মা (অন্য তিন গুরুর মধ্যে তান্ত্রিক গুরু – বামদেব, যোগীগুরু – সুমের দাস বাবাজী, জ্ঞানীগুরু – স্বামী সচ্চিদানন্দ। খুব সম্ভবত এই সচ্চিদানন্দ এবং আমাদের পরমগুরু রামানন্দ অবধূতজী ছিলেন পরস্পরের গুরুভ্রাতা)!
“গুরুমহারাজের লীলায় মধুর ভাব” _প্রসঙ্গে একবার ‘শ্রুতি’ লেখক শ্রী রমেন্দ্র বা রমেনবাবু সরাসরি গুরুমহারাজকে এই জিজ্ঞাসা করেছিলেন ! তার উত্তরে গুরুমহারাজ রমেন বাবুকে বলেছিলেন – “এবার এই শরীরে _’মধুর ভাবে’-র কোন লীলা হবে না ! আমার এই শরীরে মন যদি নাভির নিচে নামে তাহলে এই শরীরটা পাত হয়ে যাবে ৷” এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি __গুরু মহারাজের নাভি সাধারণের থেকে একটু বড় এবং ভিতরে ঢোকা ছিল ৷ ন’কাকাদের বাড়িতে একবার গুরুমহারাজ তার নাভির ভিতরটা বাড়ীর মেজো কাকা (তপিমা-র বাবা) সহ অন্যান্যদেরকে দেখিয়েছিলেন । তখন ওনার নাভি দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল ! ওনারা দেখেছিলেন যে নাভির ভিতর দিয়ে ভিতরটাও দেখা যাচ্ছে ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন, ” আমার নাভি পদ্মের ন্যায় – তাইতো বলা হয় পদ্মনাভ !”
যাইহোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি__সেদিন গুরুমহারাজ রমেনবাবুর জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছিলেন – “রমেন বাবু ! এই লীলায় অর্থাৎ পরমানন্দ শরীরে মধুর লীলার প্রকাশ ব্যাপারটা divine plan-এ নাই, তাই ওসব হবে না । কিন্তু তাই বলে ভেবোনা যে – কোন মধুর ভাবের সাধকের কোন অসুবিধা হবে ! তেমন কোনো উন্নত আধার পেলে – তাদেরকে আমি অন্য কোন নক্ষত্রলোকের এমন কোন গ্রহে পাঠিয়ে দেবো – যেখানে একই সাথে আমার অন্য শরীরে মধুর ভাবের লীলা চলছে ! সেখানে সে যত খুশি মধুর ভাবের লীলা করুক না !”
সেইদিন গুরুমহারাজ পুরুষোত্তম ভাবে ছিলেন ! যে কেউ যে কোনো জিজ্ঞাসা করছিল – উনি এক সেকেন্ডে সেই কথাটি কেটে দিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছিলেন ! ঐদিন ম্লান হ্যারিকেনের আলো_আঁধারিতে বনগ্রামের মুখার্জি বাড়ি (ন’কাকা দের বাড়ি)-তে সেই আশ্চর্য অপার্থিব মানুষটির বল-বীর্যদীপ্ত ভঙ্গিমা এবং ‘পরা’-স্থিতি থেকে বলা ‘ঋক’-বানী গুলির কাছে, ওনার সামনে বসে থাকা কতিপয় ব্যক্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিজ্ঞাসারাজি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল_প্রবল বন্যার স্রোতে পড়া খড়কুটোর মতো অকুলে ভেসে যাচ্ছিল! সেই রাত্রি তে গুরুমহারাজকে দেখে মনে হচ্ছিল _তিনি যেন আমাদের গুরুদেব, আমাদের স্নেহময় পিতা স্বামী পরমানন্দ নন–তিনি যেন অন্য কোন আলাদা মানুষ! মানুষ-ই বা বলি কেন ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল _সত্যি সত্যিই উনি ভগবান স্বয়ং _স্বয়ং পুরুষোত্তম!!!!(ক্রমশঃ)