গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা বলতে গেলেই একটা কথা থেকে অনেক কথাই চলে আসে । মনোজগতে এত কথার সমাবেশ হয় যে, কলমটা কোন কথা থেকে কোন কথায় কখন যে চলে যায় – তা লেখক বুঝতেই পারে না । প্রসঙ্গ শেষ হবার পর মনে হয় – ” এই রে ! শুরুতে যে কথাটা ভেবে ছিলাম ‘ঐ কথাটা’ লিখব – সেটা তো লেখা হলো না ! ঠিক আছে পরের দিন ঐটা-কেই প্রসঙ্গ করে না হয় লেখা যাবে ৷ কিন্তু দেখা গেল সেটাও হয় না – আবার কথার পৃষ্ঠে কথা এসে যাওয়ায় সেই ‘বিশেষ কথাটা’-ও হারিয়ে যায় !
কেন এত কথা উপক্রমণিকায় বলা হলো – সেইটা আজকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করি । কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরদিন থেকে যখন পুনরায় ‘পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা’ লিখতে শুরু করেছিলাম – তখন কোজাগরী পূর্ণিমার তিথি – যে একটি বিশেষ তিথি, এবং এই তিথিতে কোন দেবস্থান, জনকল্যাণমূলক কেন্দ্র, দেব দেবীর মন্দির ইত্যাদি স্থাপন করার পক্ষে শুভ তিথি – এই কথা দিয়ে শুরু করা হয়েছিল । তখন মনে হয়েছিল এবারের লেখাটা ‘ঐ তিথি-নক্ষত্র’-এর শুভাশুভ প্রসঙ্গে গুরু মহারাজ কি কি আলোচনা করেছিলেন, সেই নিয়ে হবে ৷ কিন্তু পরপর দুটো প্রসঙ্গেই সেই আলোচনাগুলি মনেই এলো না – অন্যান্য প্রসঙ্গ এসে গেল ! তাহলে কি সিদ্ধান্ত হল – “হে প্রভু ! তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক !”
তিথি-নক্ষত্রের প্রভাব যে মানবজীবনে বা সমাজজীবনে রয়েছে তা কিন্তু গুরুমহারাজ অস্বীকার করেন নি ! প্রকৃতপক্ষে গুরু মহারাজ সমাজে প্রচলিত কোন ধ্যান-ধারণাকেই অস্বীকার করেন নি – তা সে সমাজের মঙ্গলকারক হোক বা অহিতকারক ! উনি শুধুমাত্র সেগুলির খুঁটিনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন এবং মানুষের বিবেকের জাগরণ ঘটিয়ে তাদের বুঝতে সুযোগ করে দিতেন যে, সেই ব্যক্তির পক্ষে কোন মতটি বা কোন পথ অথবা কোন জীবনাদর্শ মেনে চললে তার নিজের মঙ্গল হবে । কোন ব্যক্তির নিজের মঙ্গল সাধিত না হলে বা সেই ব্যক্তি নিজেকে উন্নত না করতে পারলে – অপরের কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ করতে যাওয়াটা নিছক আহাম্মকি ! এতে অপর কারো মঙ্গল তো হয়ই না – বরং নিজের চরম সর্বনাশ হয় । এই ব্যাপারটি গুরুমহারাজ আমাদেরকে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া সমাজের দিকে চোখ মেললেই আমরা এই কথার স্বপক্ষে ভুরি ভুরি নিদর্শনও দেখতে পাবো ৷ রাজনৈতিক লোকেরা – এর সপক্ষে সব চাইতে বড় উদাহরণ ! যেকোনো দলের নীতির দিকে চোখ মেললে দেখা যাবে – নীতিগুলি কি সুন্দর ! কিন্তু যেই সেই নীতিগুলি Implement বা Execute করার জন্য যেই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা হাত লাগালো – অমনি নীতি-আদর্শগুলি সব Finish হয়ে গেল !!
কেন হলো – কারণ ওই ব্যক্তিগুলি নিজেরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারেনি ৷ গুরু মহারাজ বলেছিলেন – জনকল্যাণমূলক কাজ বা যেকোনো বড় কাজ করার জন্য “বড় মনের প্রয়োজন ।” আর সেই “বড় মন” তৈরি করতে হলে ধ্যান-জপ, সাধন-ভজন করা – সদ্গুরুর সঙ্গ করে বিবেকের জাগরণ এবং আত্মিক উত্তরণ ঘটানো একান্ত প্রয়োজন । সমাজ সেবামূলক কাজের জন্য পৃথিবীতে তো আর কম Organisation নেই, কত মঠ-মিশন, কত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে! হয়তো কোন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি সেগুলি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তখন সবকিছু ঠিকঠাক চলেছিল। কিন্তু উপযুক্ত মানুষের অভাবে পরবর্তীতে প্রায় সব জায়গা থেকেই ‘সেবা’ – কথাটি বাদ চলে গেছে ! কাজ হয়তো হচ্ছে – কিন্তু প্রকৃত অর্থে ‘সেবা’-র অভাব হয়ে যাচ্ছে ! এইবার এইসব প্রতিষ্ঠানগুলিতে যদি পুনরায় কোন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি এসে যায় – আবার শুরু হয়ে যায় প্রকৃতপক্ষে ‘সেবা’-মূলক কাজ !
যাইহোক, এসব কথা থাক ! আজকেও আমরা কথায় কথায় অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি ! আমরা কথা বলছিলাম মানব জীবনে বা মানবসমাজের তিথি-নক্ষত্রের সম্পর্কে ৷ গুরু মহারাজ একদিন আলোচনা করছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব সম্বন্ধে ৷ উনি বলছিলেন – বেশিরভাগ মহাপুরুষেরই জন্ম হয়েছে বিশেষ কোন তিথি নক্ষত্রে ! এর ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই রয়েছে – কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা হয় ৷ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মগ্রহণ করেছিলেন দোল পূর্ণিমা তিথিতে ! গুরু নানক ঝুলন পূর্ণিমায় এবং ভগবান বুদ্ধর বৈশাখী পূর্ণিমায় – যেটা এখন বুদ্ধ পূর্ণিমা নামেই বিখ্যাত হয়ে গেছে _ইত্যাদি ইত্যাদি !
তবে, এসব বলার পর গুরুমহারাজ যে কথাটি বলেছিলেন সেটা সত্যি সত্যি অভিনব ! উনি বলেছিলেন – মহাপ্রভুর সময় এই বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খুবই জটিল ! হুসেন শাহ্ তখন বাংলার শাসনকর্তা – আর ঠিক তার আগে আগেই বাংলায় ছিল প্রকৃত অর্থেই ‘অন্ধকারময় যুগ’! পরপর হাবসী ক্রীতদাসরা একে অপরকে মেরে ‘রাজা’ হচ্ছিল,আর সাধারণ প্রজাদের উপর চরম অত্যাচার চালাচ্ছিল– সেই সময়টা ছিল বাংলার ইতিহাসে চরম একটা অরাজক অবস্থা ! হুসেন শাহের আমলে সেই অরাজক অবস্থার সামান্য উন্নতি ঘটে ছিল, কিন্তু হিন্দু সনাতন ধর্মীয়দেরকে ধর্মান্তকরণের কাজ চলছিল দ্রুত গতিতে ! হিন্দু সনাতনধর্মী ব্রাহ্মণ্য প্রথার দাপটে নিচুতলার মানুষদের কোন সম্মান বা মর্যাদাই ছিল না । আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছিল মুসলমান শাসক হুসেন শাহ্ ! সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সুবাদে দলে দলে মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করে নিচ্ছিল।
তখন নবদ্বীপের শাসনভার ছিল কাজী-র উপর (কাজীর পুরা নাম ছিল ‘চাঁদকাজী’) ৷ সেই কাজীও হিন্দু-সনাতন ধর্মীয় বিশেষতঃ বৈষ্ণবদের উপর খুবই অত্যাচার করত ! সেই সময় কিছু হিন্দু দূরাচারীরাও রাজ কর্মচারী হিসেবে কাজীকে ‘সাথ’ দিতো । চাপাল-গোপাল, মাধব-জগন্নাথ (জগাই-মাধাই) প্রমুখরা এদের অন্যতম ছিল ৷ এই অত্যাচার যখন চরমে উঠেছিল – সমস্ত বৈষ্ণবরা একজোট হয়ে মহাপ্রভুর কাছে কাজীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালো এবং মহাপ্রভুকে কিছু করার জন্য কাতর আবেদন জানালো ৷ মহাপ্রভু রাজি হলেন –সকল বৈষ্ণব কে আশ্বাস দিয়ে বললেন _” হবে কাজীদলন! নবদ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সমস্ত বৈষ্ণব একজোট হয়ে আমার সঙ্গে যাবে কাজীর বাড়ি অভিযানে! তারপর সেখানেই হবে কাজীর সাথে চূড়ান্ত মোকাবিলা! যে দিনটি কাজীদলনের জন্য মহাপ্রভূ নির্দিষ্ট করেছিলেন _সেই দিনটিও ছিল “দোলপূর্নিমা” – র দিন!!! (ক্রমশঃ)